ঢাকা ১২:৫৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিদ্রোহীর সূফি সাধনা

  • আপডেট সময় : ১১:৪৬:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ অগাস্ট ২০২১
  • ৮৬ বার পড়া হয়েছে

শওকত আলী : কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে আমাদের মাঝে পরিচিত হলে-ও তিনি একজন প্রকৃত সূফী বা মরমি কবি।মূলত কাজী নজরুল ইসলাম পারিবারিকভাবে সূফী খান্দানভুক্ত ছিলেন।স্বাভাবিকভাবেই শৈশব থেকেই তিনি সূফী পথপরিক্রমের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।আমরা এটাও জানি যে,নজরুল ইসলাম সেই ছোটবেলায় গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করেছেন,কুরআন সহ ইত্যাদি ধর্মীয় কেতাবাদী।পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত করে,বাল্যকালে’ই তিনি মাজারের খাদেম হয়েছেন।করেছেন মসজিদে ইমামতি।আবার কখনো মক্তবে মৌলবিগিরি করেছেন,অর্থাৎ মক্তবের ছাত্রছাত্রীদের কুরআন ও ধর্মীয় পাঠদান করেছেন।কাজী নজরুল ইসলামের ভেতর সূফী বা মরমি যে প্রেরণা সঞ্চারিত ছিল,রক্তীয় ধারায় তাঁর সত্য-সুন্দরের ধ্যান-অনুধ্যানের যে চেতনা বিদ্যমান ছিল তার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় তাঁর বহু রচনাকর্মে।
নজরুল ছিলেন একজন খাঁটি মুসলিম।তাই তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করতে পারেন না।তার কাছে আল্লাহ প্রেম হল সকল প্রেমের ঊর্ধ্বে। আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই তার জীবনের মূল মন্ত্র।কবি তাঁর ভাষায় সেটা পাঠককূলকে জানিয়েছেন এভাবে-“ও মন,কারো ভরসা করিসনে তুই/এক আল্লাহর ভরসা কর/আল্লাহ যদি সহায় থাকেন/ভাবনা কিসের, কিসের ডর”।নজরুল আরো বলছেন-“মুখেতে কলমা হাতে তলোয়ার/বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার/হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহ”।কবি নজরুল ইসলামের মুসলমান পরিচয়ের পর।সর্বশক্তিমান আল্লাহ’কে পরম ভক্তি ও মনযোগের সাথে কবির মনের অবস্থার কথা ফুঁটিয়ে তুলেন।মহান আল্লাহর বিশালত্ব,তাঁর মহিমা,সম্পর্কে বর্ণনা করতে ইলমে মারেফতের জ্ঞান থাকা একান্ত জরুরী।এরকম ইলমে মারেফতের জ্ঞান থাকলেই মানুষ মুক্তির আশা করতে পারে না। পাশাপাশি প্রয়োজন ইলমে শরীয়তের জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।যে ইলমে শরীয়ত অর্জন করবে কিন্তু মারফতের জ্ঞান অর্জন করলোনা সে কাফের।এবং যে শুধু ইলমে মারফতকে ধারণ করলো,কিন্তু ইলমে শরীয়তকে ছেড়ে দিলো সে অগ্নিপূজক।তাই নজরুল ইসলাম শুধু একটিকে তাঁর হৃদয়ে ধারণা করেননি।তিনি সবকিছুই ধারণ করেছেন মননে।তাইতো কবি উল্লেখ করেন। একজন আশিকের যেমন তাঁর মাসুককে পাওয়ার মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।তেমনি আল্লার প্রেমে মশ্গুল্ হতে ও দুনিয়াদারির সব ছেড়ে এসে নামাজে দাড়াতে হবে।নামাজের মাধ্যে দাঁড়ানো মানে আল্লার সামনে দাঁড়ানো।যখন ভক্তি নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াবে তবেই পাওয়া যাবে প্রিয় প্রেমিককের দিদার।কবির ভাষায়ৃ“খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই প’ড়ে/ছেড়ে’ মস্জিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধ’রে/দুনিয়াদারির শেষে আমার নামাজ রোজার বদ্লাতে/চাইনে বেহেশ্ৎ খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত ক’রে/কায়েস যেমন লাইলী লাগি’ লভিল মজনু খেতাব/যেমন ফরহাদ শিঁরির প্রেমে হ’ল দিওয়ানা বেতাব/বে–খুদীতে মশ্গুল্ আমি তেমনি মোর খোদার তরে”।
কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ কাব্য সৃষ্টিতে আরিফের(যে আল্লাহকে চিনেন) বৈশিষ্ট্যসমূহের অনেক গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আরিফ যে মহামনা ও নির্ভীকচিত্ত,আরিফ যে সত্য-সুন্দর সমুন্নত রাখতে জিহাদী চেতনা ধারণ করেন এবং প্রয়োজনে জিহাদে অবতীর্ণ হন এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে “আরিফ বিল্লাহ”(যে আল্লাহকে চিনেন) স্তরে উন্নীত যিনি হন তিনিই এই সত্যগুলো যে অকাট্য সেই চেতনা ধারণ করে তাঁর আলোকধারায় উদ্ভাসিত হন।কাজী নজরুল ইসলাম সেই আরিফের ডাক দিয়েছেন এইভাবেৃ‘‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান,কোথা সে মুসলমান/কোথা সে আরিফ,অভেদ যাহার জীবন-মৃত্যু-জ্ঞান/যাঁর মুখে শুনি তওহিদের কালাম/ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম/যাঁর দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জ্বীন-পরী ইনসান/স্ত্রী-পুত্ররে আল্লারে সপি জেহাদে যে নির্ভীক/হেসে কোরবানী দিত প্রাণ হায়!আজ তারা মাগে ভিখ/কোথা সে শিক্ষা–আল্লাহ ছাড়া/ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা।/আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে ল’য়ে কোরআন’’।
নজরুল আরজি জানিয়েছেন তাঁর হৃদয় যেন আল্লার তাসবী জপে।ছেয়েছেন পবিত্র কালাম শুনতে ও অন্তরচোক্ষে অবলোকন করতে।ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মসজিদের ঝাড়ুদার হওয়ার।তিনি প্রতি মুহূর্তে আল্লার শুকরিয়া আদায় করতে ছেয়েছেন।হোক সেটা সুখে কিংবা দুঃখে।তাঁর ঈমানের পূর্নতা নিয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানিয়ে কবি লিখেছেনৃ‘‘শোনো শোনো ইয়া এলাহী আমার মুনাজাত/তোমারি নাম জপে যেন হৃদয় দিবস-রাত/যেন শুনি কানে সদা তোমারি কালাম,হে খোদা/চোখে শুধু দেখি যেন কোরানের আয়াত/মুখে যেন জপি আমি কলমা তোমার দিবস-যামী (তোমার)মসজিদেরই ঝাড়ু-বর্দার হোক আমার এ হাত/সুখে তুমি, দুখে তুমি,চোখে তুমি, বুকে তুমি,/এই পিয়াসী প্রানের খোদা তুমিই আবে- হায়াত’’।
নজরুল বিশ্বাস করতেন তাঁর ললাট লেখা।এটাও ঈমানদারের পরিচয়।তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর জীবনপ্রণালি কেমন হবে।কিভাবে কাটাবেন মর্ত্যে জীবন।আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় সৃষ্টি হলো মানুষ।তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন আপন হাতে।আল্লাহ মানুষকে পাপের শান্তি হিসেবে দেখিয়েছেন নরক ভীতি।অবার দিয়েছেন স্বর্গের সুসংবাদও।যখন কোন বান্দা পাপ করে আবার সত্য পথে ফিরে আসে তখন থাকে সব ভুল ক্ষমা করে দেন।টেনে নেন আপন বক্ষে। কবি কথা গুলো অনেক মায়া নিয়ে বলেছেন এভাবেৃ‘‘সৃজন-ভোরে প্রভু মরে স্রিজিলে গো প্রথম যবে/(তুমি) জানতে আমার ললাট-লেখা, জীবন আমার কেমন হবে/তোমারি সে নিদেশ প্রভু/যদিই গো পাপ করি কভু/নরক-ভীতি দেখাও তবু,এমন বিচার কেউ কি স’বে/করুনাময় তুমি যদি দয়া কর দয়ার লাগি/ভুলের তরে“আদমেরে’’করলে কেন স্বর্গ-ত্যাগী/ভক্তে বাঁচাও দয়া দানি/সে ত গো তার পাওনা জানি/পাপীরে লও বক্ষে টানি’করুনাময় কইব তবে’’।
আল্লাহ প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির শিক্ষক পেয়ারে নবীজী হযরত মোহাম্মদ (সা.) যার আগমনে ধরা পায় নতুন দিশা। যাঁর দেখানো পথে অনাচার,অত্যাচার ও অনিয়ম দূর হয়।সেই মহামানবের জীবনের শেষ দিনগুলো যেখানে কাটিয়েছ সেই স্থানকে স্মরণ করে নজরুল।নবীর শহর,প্রেমের শহর পবিত্র মদিনা মোনওয়ারা।সেই মদিনা নজরুলের কাছে কল্পনার প্রতীক নয়,আকাঙ্খা ও স্বপ্নের প্রতীক।তিনি মদিনায় যাবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন।হতে ছেয়েছেন মদিনার পথ।ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যেন মদিনার পথ হয়ে তাঁর উপর নবীজী হেঁটে চলে।যেখানে মা ফাতিমা এবং নবী দৌহিত্রী হাসান,হোসেন এসে নেচে নেচে খেলবে।তখন কবি তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে ফুলের রেনু হয়ে।বিশ্বের মুসলমান কা’বার জিয়ারতে এসে তাঁকে পায়ে দলত।কালির স্পর্শে লিখেছেনৃ“আমি যদি আরব হ’তাম,মদিনারই পথ/এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজর/পয়জার তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে/ঝণা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।সেই চিহ্ন বুকে পুরে/পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে/সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম্ জিয়ারত/মা ফাতেমা খেলত এসে’ আমার ধূলি লয়ে/আমি পড়তাম তারঁ পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে/হাসান হোসেন হেসে হেসে/নাচত আমার বখ্খে এসে/চখে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত/আমার বুকে পা ফেলে রে বীর আসহ্বা যত/রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর খত/কুল মুসলিম আসতে কাবায়/চলতে পায়ে দলত আমায়/আমি চাইতাম না খোদার দিদার শাফায়াত জিন্নত’’।পেয়ারে নবীজী করিম (সা)-কে ভালোবাসার এবং তাঁর প্রতি দরদভরা ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে যে শব্দমালা ব্যবহার করেছেন তা বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় কেউ করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়না।তাঁর গানের প্রতিটি শব্দের মাধ্যমে তিনি নবী সম্পর্কে যে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও নির্ভরতার নমুনা প্রদর্শন করেছেন তা খুব বড় মাপের সূফী না হলে সম্ভব হতো না।তিনি প্রাণের আকুতিতে যে সুর সৃষ্টি করেছে এবং যে অনবদ্য ভাবের সৃষ্টি করেছেন তা সচারাচর সাধারণ মানুষের বের হয় না।তিনি ভক্তি ভরা কালির স্পর্শে লিখেছেনৃ“বক্ষে আমার কাবার ছবি,চক্ষে মোহাম্মদ রসুল/শিরোপরি মোর খোদার আরশ্,গাই তারই গান পথ-বেভুল/লায়লির প্রেমে মজনুঁ পাগল,আমি পাগল ‘লা-ইলা’র,/বোঝে আমায় প্রেমিক দরবেশ,অ-রসিকে কয় বাতুল/হৃদয়ে মোর খুশির বাগান,
বুলবুলি তায় গায় সদাই/ওরা খোদার রহম মাগে,আমি খোদার ইশ্ক চাই/আমার মনের মসজিদে দেয় আজান প্রেমের ‘মুয়াজ্জিন’/প্রাণের পরে কোরান লেখা ‘রুহ’ পড়ে তা রাত্রিদিন/খাতুনে-জিন্নাত মা আমার/হাসান হোসেন চোখের জল/ভয় করি না‘রোজ- কিয়ামত’পুলসিরাতের কঠিন পুল”।
অন্য একটি গানে বলেছেন কবি বলেছেন।ৃ‘‘সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির/বিরাজে রওজা মোবারক যেথা মোর প্রিয় নবীজীর/বাতাসে যেখানে বাজে অবিরাম/তৌহিদ বাণী খোদার কালাম/জিয়ারতে যেথা আসে ফেরেশতা শত আউলিয়া পীর/মা ফাতেমা আর হাসান হোসেন খেলেছে পথে যার/কদমের ধূলি পড়েছে যেথায় হাজার আম্বিয়ার/সুরমা করিয়া কবে সে ধূলি”।কেবল আল্লাহ ও নবীজীর শানে সংগীত লিখে নজরুল ক্ষান্ত হননি।তিনি মুসলিম জাতির পরিচয়,তাদের অতীত, মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয় ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার সব লিখেছেন।মুসলমানদের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেনৃ“ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি/সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি/আমরা সেই সে জাতি/পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা/মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙ্গাড়ি শীতল শান্তিধারা/উচ্চ- নীচের ভেদ ভাঙ্গি দিল সবারে বক্ষ পাতি/আমরা সেই সে জাতি/কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি ক ইসলাম/সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম/আমির- ফকিরে ভেদ নাই সবে সব ভাই এক সাথী/আমরা সেই সে জাতি/নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার/মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার/আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি/আমরা সেই সে জাতি”।
শেষ বিদায়ের আগে পরকালীব চিন্তায় বিভোর ছিলেন কবি।মৃত্যুসত্য এবং কঠিন সেই সত্য।কবি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গেছেন যে,তাকে মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হলে তিনি মুয়াজ্জিনের আজান-নামাজিদের পায়ের আওয়াজও শুনতে পাবেন।পবিত্র কোরআন যারা অধ্যায়ন করেন অর্থাৎ পরহেজগার খোদার ভক্তরা যখন তা পড়বে তা শুনে যেন তাঁর পরান জুড়াতে পারেন।একজন মু’মিন সদা-সর্বদা তার পরকালীন মঙ্গল চিন্তায় মগ্ন থাকেন।কেননা সে জগতে নিজ আমল ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।মানুষ মরণশীল। আর মারা গেলেই তাকে করা হবে সমাহিত।মৃত্যুবরণের সাথে সাথেই মানুষের সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,হযযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিন টি আমল বন্ধ হয় না-(ক) সদকায়ে জারিয়া।(খ) এমন জ্ঞান(ইলম)- যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং(গ) এমন নেক সন্তান-যে তার জন্য দোয়া করে।–সহিহ মুসলিম(৪৩১০)অর্থাৎ নিজের কিছুই করার থাকে না।মুমিনগণ যদি মৃত মুমিনদের জন্য দুয়া করেন সেটাও হবে পরম পাওয়া।সেই দুয়ার বদৌলতে আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় মাফ পারেন।আর যদি চোখের সম্মুখে কোনো কবর থাকে তাহলে সেই কবরবাসীর জন্য মনের অজান্তেই দুয়া চলে আসে নামাজি ব্যক্তির।এরকমই আল্লাহর দরবারে নিজের আকাঙ্খা নিবেদন করে দুনিয়াবাসীর কাছে ওসিয়ত করে কবি নজরুল গেয়েছিলেনৃ“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই/আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে/পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে/গোর – আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই/কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত/ঐ মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত/সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই/কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে/আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে/আমি তাদের সাথে কেঁদে-কেঁদে(আল্লার নাম জপতে চাই)”।মরমি কবি কাজী নজরুল আল্লাহর বিশালত্ব,দয়া,করুণা এবং ক্ষমার ব্যাপ্তি সম্পর্কে এত উচু মার্গে চিন্তা করতেন যা সাধারণ মন-মস্তিষ্ক কল্পনাও করতে পারে না।মহা-জগতের অলৌকিক কানুন হলো-যে বান্দা তার মালিক সম্পর্কে যেরূপ দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করতে পারবে ঠিক তেমনি ভাবেই তার ভাগ্যে দুনিয়া ও আখিরাতে প্রাপ্তিগুলো হবে।পরকালের অপ্রত্যাশিত বিচারের ভয়ে কবি ফরিয়াদ জানান আল্লাহ্র কাছে।কবি নিজেকে গুনাহগার বান্দা হিসেবে জাহির করেন।আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন়-”লা-খওফুন আলাইমিন” অর্থাৎ তাদের(মুমিন মুসলমান)কোনো ভয় নেই।কবি আল্লাহর ঘোষণাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন।তাই তিনি হাশরের মাঠে ভয়ে ভীত না হয়ে বরং আল্লাহর সাক্ষাতে খুশি হয়ে উঠবেন।যে রোজহাশরে বিচার করতে একমাত্র কাজী হবে আল্লাহ নিজেই।সে দিন কবি আল্লার দিদারের আশা করেছেন।যে দিন আল্লার “কাহহার”রূপ দেখে,পীর-পয়গম্বর ভয়ে কাঁদবে “ইয়া-নফসি”ডেকে।সেই দিন কবি আল্লার রূপ দেখে হাজারবার দোজখ যেতে রাজি হয়েছেন?কবি তো জানতেন যে মানুষ আল্লার রূপ দেখবেন সে কখনো দোজখে যেতে পারে না।আল্লাহতায়ালা অসীম দয়ালু ও রহমান-রাহিম।কেয়ামত কঠিন বাস্তবতায় তাঁর নিজ রহমত-বরকত দ্বারা বান্দাকে ক্ষমা করবেন।এমনও অনেক বান্দা থাকবে যার কোন সাওয়াব নেই, কিন্তু থাকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন।সে কথাগুলো কবি কতোই মরমি গলায় গেয়েছেনৃ“সেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার /তুমি হবে কাজী/সেদিন তোমার দিদার আমি পাব কি আল্লাজী/সেদিন নাকি তোমার ভীষণ কাহহার রূপ দেখে/পীর-পয়গাম্বার কাঁদবে ভয়ে ইয়া নফসি ডেকে/সেই সুদিনের আশায় আমি নাচি এমন এখন থেকে/আমি তোমায় দেখে হাজারো বার দোজখ যেতে রাজি,/যেরূপ হোক-বারেক যদি দেখে তোমায় কেহ/দোজখ কি আর ছুঁতে পারে,পবিত্র তার দেহ/সে হোক না কেন হাজার পাপী হোক না বেনামাজী/ইয়া আল্লাহ তোমার দয়া কত!তাই দেখাবে বলে/রোজ হাশরে দেখা দেবে বিচার করার ছলে/প্রেমিক বিনে কি বুঝিবে তোমার এ কারসাজি”।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিদ্রোহীর সূফি সাধনা

আপডেট সময় : ১১:৪৬:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ অগাস্ট ২০২১

শওকত আলী : কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে আমাদের মাঝে পরিচিত হলে-ও তিনি একজন প্রকৃত সূফী বা মরমি কবি।মূলত কাজী নজরুল ইসলাম পারিবারিকভাবে সূফী খান্দানভুক্ত ছিলেন।স্বাভাবিকভাবেই শৈশব থেকেই তিনি সূফী পথপরিক্রমের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।আমরা এটাও জানি যে,নজরুল ইসলাম সেই ছোটবেলায় গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করেছেন,কুরআন সহ ইত্যাদি ধর্মীয় কেতাবাদী।পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত করে,বাল্যকালে’ই তিনি মাজারের খাদেম হয়েছেন।করেছেন মসজিদে ইমামতি।আবার কখনো মক্তবে মৌলবিগিরি করেছেন,অর্থাৎ মক্তবের ছাত্রছাত্রীদের কুরআন ও ধর্মীয় পাঠদান করেছেন।কাজী নজরুল ইসলামের ভেতর সূফী বা মরমি যে প্রেরণা সঞ্চারিত ছিল,রক্তীয় ধারায় তাঁর সত্য-সুন্দরের ধ্যান-অনুধ্যানের যে চেতনা বিদ্যমান ছিল তার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় তাঁর বহু রচনাকর্মে।
নজরুল ছিলেন একজন খাঁটি মুসলিম।তাই তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করতে পারেন না।তার কাছে আল্লাহ প্রেম হল সকল প্রেমের ঊর্ধ্বে। আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই তার জীবনের মূল মন্ত্র।কবি তাঁর ভাষায় সেটা পাঠককূলকে জানিয়েছেন এভাবে-“ও মন,কারো ভরসা করিসনে তুই/এক আল্লাহর ভরসা কর/আল্লাহ যদি সহায় থাকেন/ভাবনা কিসের, কিসের ডর”।নজরুল আরো বলছেন-“মুখেতে কলমা হাতে তলোয়ার/বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার/হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহ”।কবি নজরুল ইসলামের মুসলমান পরিচয়ের পর।সর্বশক্তিমান আল্লাহ’কে পরম ভক্তি ও মনযোগের সাথে কবির মনের অবস্থার কথা ফুঁটিয়ে তুলেন।মহান আল্লাহর বিশালত্ব,তাঁর মহিমা,সম্পর্কে বর্ণনা করতে ইলমে মারেফতের জ্ঞান থাকা একান্ত জরুরী।এরকম ইলমে মারেফতের জ্ঞান থাকলেই মানুষ মুক্তির আশা করতে পারে না। পাশাপাশি প্রয়োজন ইলমে শরীয়তের জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।যে ইলমে শরীয়ত অর্জন করবে কিন্তু মারফতের জ্ঞান অর্জন করলোনা সে কাফের।এবং যে শুধু ইলমে মারফতকে ধারণ করলো,কিন্তু ইলমে শরীয়তকে ছেড়ে দিলো সে অগ্নিপূজক।তাই নজরুল ইসলাম শুধু একটিকে তাঁর হৃদয়ে ধারণা করেননি।তিনি সবকিছুই ধারণ করেছেন মননে।তাইতো কবি উল্লেখ করেন। একজন আশিকের যেমন তাঁর মাসুককে পাওয়ার মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।তেমনি আল্লার প্রেমে মশ্গুল্ হতে ও দুনিয়াদারির সব ছেড়ে এসে নামাজে দাড়াতে হবে।নামাজের মাধ্যে দাঁড়ানো মানে আল্লার সামনে দাঁড়ানো।যখন ভক্তি নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াবে তবেই পাওয়া যাবে প্রিয় প্রেমিককের দিদার।কবির ভাষায়ৃ“খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই প’ড়ে/ছেড়ে’ মস্জিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধ’রে/দুনিয়াদারির শেষে আমার নামাজ রোজার বদ্লাতে/চাইনে বেহেশ্ৎ খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত ক’রে/কায়েস যেমন লাইলী লাগি’ লভিল মজনু খেতাব/যেমন ফরহাদ শিঁরির প্রেমে হ’ল দিওয়ানা বেতাব/বে–খুদীতে মশ্গুল্ আমি তেমনি মোর খোদার তরে”।
কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ কাব্য সৃষ্টিতে আরিফের(যে আল্লাহকে চিনেন) বৈশিষ্ট্যসমূহের অনেক গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আরিফ যে মহামনা ও নির্ভীকচিত্ত,আরিফ যে সত্য-সুন্দর সমুন্নত রাখতে জিহাদী চেতনা ধারণ করেন এবং প্রয়োজনে জিহাদে অবতীর্ণ হন এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে “আরিফ বিল্লাহ”(যে আল্লাহকে চিনেন) স্তরে উন্নীত যিনি হন তিনিই এই সত্যগুলো যে অকাট্য সেই চেতনা ধারণ করে তাঁর আলোকধারায় উদ্ভাসিত হন।কাজী নজরুল ইসলাম সেই আরিফের ডাক দিয়েছেন এইভাবেৃ‘‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান,কোথা সে মুসলমান/কোথা সে আরিফ,অভেদ যাহার জীবন-মৃত্যু-জ্ঞান/যাঁর মুখে শুনি তওহিদের কালাম/ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম/যাঁর দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জ্বীন-পরী ইনসান/স্ত্রী-পুত্ররে আল্লারে সপি জেহাদে যে নির্ভীক/হেসে কোরবানী দিত প্রাণ হায়!আজ তারা মাগে ভিখ/কোথা সে শিক্ষা–আল্লাহ ছাড়া/ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা।/আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে ল’য়ে কোরআন’’।
নজরুল আরজি জানিয়েছেন তাঁর হৃদয় যেন আল্লার তাসবী জপে।ছেয়েছেন পবিত্র কালাম শুনতে ও অন্তরচোক্ষে অবলোকন করতে।ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মসজিদের ঝাড়ুদার হওয়ার।তিনি প্রতি মুহূর্তে আল্লার শুকরিয়া আদায় করতে ছেয়েছেন।হোক সেটা সুখে কিংবা দুঃখে।তাঁর ঈমানের পূর্নতা নিয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানিয়ে কবি লিখেছেনৃ‘‘শোনো শোনো ইয়া এলাহী আমার মুনাজাত/তোমারি নাম জপে যেন হৃদয় দিবস-রাত/যেন শুনি কানে সদা তোমারি কালাম,হে খোদা/চোখে শুধু দেখি যেন কোরানের আয়াত/মুখে যেন জপি আমি কলমা তোমার দিবস-যামী (তোমার)মসজিদেরই ঝাড়ু-বর্দার হোক আমার এ হাত/সুখে তুমি, দুখে তুমি,চোখে তুমি, বুকে তুমি,/এই পিয়াসী প্রানের খোদা তুমিই আবে- হায়াত’’।
নজরুল বিশ্বাস করতেন তাঁর ললাট লেখা।এটাও ঈমানদারের পরিচয়।তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর জীবনপ্রণালি কেমন হবে।কিভাবে কাটাবেন মর্ত্যে জীবন।আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় সৃষ্টি হলো মানুষ।তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন আপন হাতে।আল্লাহ মানুষকে পাপের শান্তি হিসেবে দেখিয়েছেন নরক ভীতি।অবার দিয়েছেন স্বর্গের সুসংবাদও।যখন কোন বান্দা পাপ করে আবার সত্য পথে ফিরে আসে তখন থাকে সব ভুল ক্ষমা করে দেন।টেনে নেন আপন বক্ষে। কবি কথা গুলো অনেক মায়া নিয়ে বলেছেন এভাবেৃ‘‘সৃজন-ভোরে প্রভু মরে স্রিজিলে গো প্রথম যবে/(তুমি) জানতে আমার ললাট-লেখা, জীবন আমার কেমন হবে/তোমারি সে নিদেশ প্রভু/যদিই গো পাপ করি কভু/নরক-ভীতি দেখাও তবু,এমন বিচার কেউ কি স’বে/করুনাময় তুমি যদি দয়া কর দয়ার লাগি/ভুলের তরে“আদমেরে’’করলে কেন স্বর্গ-ত্যাগী/ভক্তে বাঁচাও দয়া দানি/সে ত গো তার পাওনা জানি/পাপীরে লও বক্ষে টানি’করুনাময় কইব তবে’’।
আল্লাহ প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির শিক্ষক পেয়ারে নবীজী হযরত মোহাম্মদ (সা.) যার আগমনে ধরা পায় নতুন দিশা। যাঁর দেখানো পথে অনাচার,অত্যাচার ও অনিয়ম দূর হয়।সেই মহামানবের জীবনের শেষ দিনগুলো যেখানে কাটিয়েছ সেই স্থানকে স্মরণ করে নজরুল।নবীর শহর,প্রেমের শহর পবিত্র মদিনা মোনওয়ারা।সেই মদিনা নজরুলের কাছে কল্পনার প্রতীক নয়,আকাঙ্খা ও স্বপ্নের প্রতীক।তিনি মদিনায় যাবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন।হতে ছেয়েছেন মদিনার পথ।ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যেন মদিনার পথ হয়ে তাঁর উপর নবীজী হেঁটে চলে।যেখানে মা ফাতিমা এবং নবী দৌহিত্রী হাসান,হোসেন এসে নেচে নেচে খেলবে।তখন কবি তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে ফুলের রেনু হয়ে।বিশ্বের মুসলমান কা’বার জিয়ারতে এসে তাঁকে পায়ে দলত।কালির স্পর্শে লিখেছেনৃ“আমি যদি আরব হ’তাম,মদিনারই পথ/এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজর/পয়জার তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে/ঝণা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।সেই চিহ্ন বুকে পুরে/পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে/সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম্ জিয়ারত/মা ফাতেমা খেলত এসে’ আমার ধূলি লয়ে/আমি পড়তাম তারঁ পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে/হাসান হোসেন হেসে হেসে/নাচত আমার বখ্খে এসে/চখে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত/আমার বুকে পা ফেলে রে বীর আসহ্বা যত/রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর খত/কুল মুসলিম আসতে কাবায়/চলতে পায়ে দলত আমায়/আমি চাইতাম না খোদার দিদার শাফায়াত জিন্নত’’।পেয়ারে নবীজী করিম (সা)-কে ভালোবাসার এবং তাঁর প্রতি দরদভরা ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে যে শব্দমালা ব্যবহার করেছেন তা বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় কেউ করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়না।তাঁর গানের প্রতিটি শব্দের মাধ্যমে তিনি নবী সম্পর্কে যে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও নির্ভরতার নমুনা প্রদর্শন করেছেন তা খুব বড় মাপের সূফী না হলে সম্ভব হতো না।তিনি প্রাণের আকুতিতে যে সুর সৃষ্টি করেছে এবং যে অনবদ্য ভাবের সৃষ্টি করেছেন তা সচারাচর সাধারণ মানুষের বের হয় না।তিনি ভক্তি ভরা কালির স্পর্শে লিখেছেনৃ“বক্ষে আমার কাবার ছবি,চক্ষে মোহাম্মদ রসুল/শিরোপরি মোর খোদার আরশ্,গাই তারই গান পথ-বেভুল/লায়লির প্রেমে মজনুঁ পাগল,আমি পাগল ‘লা-ইলা’র,/বোঝে আমায় প্রেমিক দরবেশ,অ-রসিকে কয় বাতুল/হৃদয়ে মোর খুশির বাগান,
বুলবুলি তায় গায় সদাই/ওরা খোদার রহম মাগে,আমি খোদার ইশ্ক চাই/আমার মনের মসজিদে দেয় আজান প্রেমের ‘মুয়াজ্জিন’/প্রাণের পরে কোরান লেখা ‘রুহ’ পড়ে তা রাত্রিদিন/খাতুনে-জিন্নাত মা আমার/হাসান হোসেন চোখের জল/ভয় করি না‘রোজ- কিয়ামত’পুলসিরাতের কঠিন পুল”।
অন্য একটি গানে বলেছেন কবি বলেছেন।ৃ‘‘সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির/বিরাজে রওজা মোবারক যেথা মোর প্রিয় নবীজীর/বাতাসে যেখানে বাজে অবিরাম/তৌহিদ বাণী খোদার কালাম/জিয়ারতে যেথা আসে ফেরেশতা শত আউলিয়া পীর/মা ফাতেমা আর হাসান হোসেন খেলেছে পথে যার/কদমের ধূলি পড়েছে যেথায় হাজার আম্বিয়ার/সুরমা করিয়া কবে সে ধূলি”।কেবল আল্লাহ ও নবীজীর শানে সংগীত লিখে নজরুল ক্ষান্ত হননি।তিনি মুসলিম জাতির পরিচয়,তাদের অতীত, মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয় ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার সব লিখেছেন।মুসলমানদের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেনৃ“ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি/সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি/আমরা সেই সে জাতি/পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা/মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙ্গাড়ি শীতল শান্তিধারা/উচ্চ- নীচের ভেদ ভাঙ্গি দিল সবারে বক্ষ পাতি/আমরা সেই সে জাতি/কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি ক ইসলাম/সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম/আমির- ফকিরে ভেদ নাই সবে সব ভাই এক সাথী/আমরা সেই সে জাতি/নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার/মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার/আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি/আমরা সেই সে জাতি”।
শেষ বিদায়ের আগে পরকালীব চিন্তায় বিভোর ছিলেন কবি।মৃত্যুসত্য এবং কঠিন সেই সত্য।কবি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গেছেন যে,তাকে মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হলে তিনি মুয়াজ্জিনের আজান-নামাজিদের পায়ের আওয়াজও শুনতে পাবেন।পবিত্র কোরআন যারা অধ্যায়ন করেন অর্থাৎ পরহেজগার খোদার ভক্তরা যখন তা পড়বে তা শুনে যেন তাঁর পরান জুড়াতে পারেন।একজন মু’মিন সদা-সর্বদা তার পরকালীন মঙ্গল চিন্তায় মগ্ন থাকেন।কেননা সে জগতে নিজ আমল ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।মানুষ মরণশীল। আর মারা গেলেই তাকে করা হবে সমাহিত।মৃত্যুবরণের সাথে সাথেই মানুষের সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,হযযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিন টি আমল বন্ধ হয় না-(ক) সদকায়ে জারিয়া।(খ) এমন জ্ঞান(ইলম)- যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং(গ) এমন নেক সন্তান-যে তার জন্য দোয়া করে।–সহিহ মুসলিম(৪৩১০)অর্থাৎ নিজের কিছুই করার থাকে না।মুমিনগণ যদি মৃত মুমিনদের জন্য দুয়া করেন সেটাও হবে পরম পাওয়া।সেই দুয়ার বদৌলতে আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় মাফ পারেন।আর যদি চোখের সম্মুখে কোনো কবর থাকে তাহলে সেই কবরবাসীর জন্য মনের অজান্তেই দুয়া চলে আসে নামাজি ব্যক্তির।এরকমই আল্লাহর দরবারে নিজের আকাঙ্খা নিবেদন করে দুনিয়াবাসীর কাছে ওসিয়ত করে কবি নজরুল গেয়েছিলেনৃ“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই/আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে/পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে/গোর – আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই/কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত/ঐ মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত/সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই/কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে/আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে/আমি তাদের সাথে কেঁদে-কেঁদে(আল্লার নাম জপতে চাই)”।মরমি কবি কাজী নজরুল আল্লাহর বিশালত্ব,দয়া,করুণা এবং ক্ষমার ব্যাপ্তি সম্পর্কে এত উচু মার্গে চিন্তা করতেন যা সাধারণ মন-মস্তিষ্ক কল্পনাও করতে পারে না।মহা-জগতের অলৌকিক কানুন হলো-যে বান্দা তার মালিক সম্পর্কে যেরূপ দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করতে পারবে ঠিক তেমনি ভাবেই তার ভাগ্যে দুনিয়া ও আখিরাতে প্রাপ্তিগুলো হবে।পরকালের অপ্রত্যাশিত বিচারের ভয়ে কবি ফরিয়াদ জানান আল্লাহ্র কাছে।কবি নিজেকে গুনাহগার বান্দা হিসেবে জাহির করেন।আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন়-”লা-খওফুন আলাইমিন” অর্থাৎ তাদের(মুমিন মুসলমান)কোনো ভয় নেই।কবি আল্লাহর ঘোষণাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন।তাই তিনি হাশরের মাঠে ভয়ে ভীত না হয়ে বরং আল্লাহর সাক্ষাতে খুশি হয়ে উঠবেন।যে রোজহাশরে বিচার করতে একমাত্র কাজী হবে আল্লাহ নিজেই।সে দিন কবি আল্লার দিদারের আশা করেছেন।যে দিন আল্লার “কাহহার”রূপ দেখে,পীর-পয়গম্বর ভয়ে কাঁদবে “ইয়া-নফসি”ডেকে।সেই দিন কবি আল্লার রূপ দেখে হাজারবার দোজখ যেতে রাজি হয়েছেন?কবি তো জানতেন যে মানুষ আল্লার রূপ দেখবেন সে কখনো দোজখে যেতে পারে না।আল্লাহতায়ালা অসীম দয়ালু ও রহমান-রাহিম।কেয়ামত কঠিন বাস্তবতায় তাঁর নিজ রহমত-বরকত দ্বারা বান্দাকে ক্ষমা করবেন।এমনও অনেক বান্দা থাকবে যার কোন সাওয়াব নেই, কিন্তু থাকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন।সে কথাগুলো কবি কতোই মরমি গলায় গেয়েছেনৃ“সেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার /তুমি হবে কাজী/সেদিন তোমার দিদার আমি পাব কি আল্লাজী/সেদিন নাকি তোমার ভীষণ কাহহার রূপ দেখে/পীর-পয়গাম্বার কাঁদবে ভয়ে ইয়া নফসি ডেকে/সেই সুদিনের আশায় আমি নাচি এমন এখন থেকে/আমি তোমায় দেখে হাজারো বার দোজখ যেতে রাজি,/যেরূপ হোক-বারেক যদি দেখে তোমায় কেহ/দোজখ কি আর ছুঁতে পারে,পবিত্র তার দেহ/সে হোক না কেন হাজার পাপী হোক না বেনামাজী/ইয়া আল্লাহ তোমার দয়া কত!তাই দেখাবে বলে/রোজ হাশরে দেখা দেবে বিচার করার ছলে/প্রেমিক বিনে কি বুঝিবে তোমার এ কারসাজি”।