নিজস্ব প্রতিবেদক : আরব আমিরাত প্রবাসী রাশেদুল ইসলাম। প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন দুবাই ভিত্তিক একটি তেল কোম্পানিতে। তিনি নিয়মিত টাকা পাঠান তার পরিবারের কাছে দুটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে। সে টাকা উত্তোলন করেন তার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম। গেল মাসে প্রণোদনা বাড়ার ঘোষণায় এ মাসে কিছু টাকা বেশি পাঠান রাশেদ। কিন্তু সে রেমিট্যান্সের বিপরীতে ঘোষণার অতিরিক্ত প্রণোদনা দেয়নি ব্যাংক। ব্যাংকগুলো বলছে, তারা এমন কোনো নির্দেশনা পাননি। এদিকে ঘোষিত বাড়তি প্রণোদনা না দেওয়াকে প্রতারণা বলছেন রাশেদুল ইসলাম। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে এক জরুরি সভা করে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন বা বাফেদা। ২২ অক্টোবর নেওয়া এক সিদ্ধান্তে ব্যাংকগুলোকে সরকারের দেওয়া প্রণোদনার অতিরিক্ত আরও আড়াই শতাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাফেদা। ২৩ অক্টোবর থেকেই কার্যকর করার কথা জানানো হয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংককেও জানায় সংগঠনটি। তবে, গতকাল নভেম্বরের ১ তারিখেও ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত প্রণোদনা দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা। একে প্রতারণা বলছেন প্রবাসীরা।
প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে ধীরগতি চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সবাইকে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, অর্থনীতিবিদ এবং সরকার- সব পক্ষকেই রেমিট্যান্সের নি¤œমুখী প্রবণতা শঙ্কায় ফেলে দেয়। সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নানারকম উদ্যোগ নেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তাতেও কোনো উন্নতি হয়নি প্রবাসী আয়ে। এরপর গত মাসের শেষের দিকে বাফেদা ও ব্যাংক এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি ব্যাংকগুলো। গতকাল বুধবার কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বললে ব্যাংকগুলো জানায়, সে সিদ্ধান্তটি ছিল ঐচ্ছিক। বাধ্যতামূলক ছিল না। সূত্রমতে, রেমিট্যান্সে গতি বাড়াতে সরকার প্রথমে ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে। এরপর গেল ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি আরও দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। এর ফলে সেসময়ে রেমিট্যান্সে ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে রেমিট্যান্স নি¤œমুখী হতে থাকে। যার ধারাবাহিকতায় পরের দুই মাস আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা আরও কমে যায়। সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পায় ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় বাফেদা এবং এবিবি ২২ অক্টোবর একটি জরুরি সভা করে অনলাইনে। এতে সরকারের সঙ্গে আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও অবহিত এ বিষয়ে। মোট ৫ শতাংশ রেমিট্যান্সের ওপরে প্রণোদনা দেওয়ার খবরে রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হয়। তবে, ২৩ অক্টোবর থেকে কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়ার ১০ দিন পরও কোনো ব্যাংক এখনো একটি টাকাও অতিরিক্ত প্রণোদনা দেয়নি বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে গ্রাহকদের কথা কাটাকাটিও হয়েছে বলে জানা গেছে। আরব আমিরাত প্রবাসী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শ্রমের টাকা দেশে পাঠাই। ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এক বেলা কাজের ছুটি নিয়ে তারপর টাকা পাঠাতে যেতে হয়। অথচ হুন্ডিতে টাকা পাঠানো খুবই সহজ। তবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আমরা কিছুটা অবদান রাখতে চাই বলে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাই আমাদের উপার্জন। এ সময় যখন আরও পাঁচ শতাংশ প্রণোদনার ঘোষণা পেলাম তখন খুশিই হয়েছি। কিন্তু এ কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালেও আড়াই শতাংশই প্রণোদনা পাচ্ছে পরিবার। এটাতো রীতিমতো প্রতারণা। এমন কাজ আমাদের ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক লাখ টাকা পাঠালে ২ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত পাওয়া যেত। কিন্তু টাকা পাঠানো, তুলতে ব্যাংকে যাওয়া-আসা এসব করে ১ হাজার টাকা চলে যায়। হুন্ডিতে টাকা পাঠালে কিন্তু কোনো ঝামেলা হয় না। বরং ব্যাংকের চেয়েও টাকা আরও বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা তো দেশের কাছে কৃতজ্ঞ। অল্প কয়েকটা টাকা বেশি পাওয়ার জন্য অবৈধ পথে টাকা পাঠাতে চাই না।’ একই কথা বলেন আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি ডাক্তার শামসুল আলম খান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণায় আমরা মনে করেছিলাম এখন ৫ শতাংশ প্রণোদনা পাবো। কিন্তু আমার ফ্যামিলির কাছে টাকা পাঠালাম এ ঘোষণার পর ২ বার। একবারও অতিরিক্ত কোনো টাকা দেয়নি। অথচ এখানে একটি ফোন দিলে ডলারপ্রতি ১১৫ টাকা পায় বাংলাদেশে। কিন্তু আমরা তো চাইলেই হুন্ডিতে পাঠাতে পারি না। দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের বোঝাপড়ার জায়গা আছে। তবে ঘোষণা দেওয়ার পরও যা করা হলো তা তো কাম্য না। কর্তৃপক্ষ যদি কথা না রাখতে পারেন তবে এমন কথা দেন কেন তারা?’
জানতে ফোন করা হয় বাফেদার সভাপতি ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিমকে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসাইনকে ফোন ও মেসেজ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘এটাতো অনেক টাকার বিষয়। এ টাকার ব্যাপারে এমডি অনুমতি দিতে পারেন না। এর জন্য বোর্ডের অনুমতির প্রয়োজন। অন্যদের ব্যাপারে জানি না, আমার ব্যাংকের ৭ তারিখে বোর্ড মিটিংয়ে উঠছে বিষয়টি। সেখানে অনুমোদন পেলে আমরা দেওয়া শুরু করবো।’ একই বিষয়ে একটি প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাফেদা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সিদ্ধান্ত আরও যাচাই-বাছাই মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তারা ভার্চুয়াল মিটিং করে এ সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও নীতিগত অনুমোদন দেয়। কিন্তু কতগুলো ব্যাংক এমন প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সেটা বিবেচনায় নেওয়ার দরকার ছিল। এ সিদ্ধান্তের আগেই অনেকগুলো ব্যাংক অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছিল রেমিট্যান্সে যার কারণে হেড অব ট্রেজারিদের জরিমানাও করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর তারা বিষয়টিকে আইনগত করার তাগিদে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এখন অনেক ব্যাংক, স্পেসিফিকলি যদি বলি ১০-১২টা ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংক এ অতিরিক্ত টাকা দিতে পারছে না।’
অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদানের বিষয়টি জানেন না বলে জানান বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শাখা প্রধানরা। ইসলামী ব্যাংকের ফেনী জেলার একটি শাখা ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কয়েকদিন হলো গ্রাহকরা এসে অতিরিক্ত প্রণোদনার টাকা চাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের কাছে এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। অনুমতি ছাড়া আমরা এক টাকাও দিতে পারি না। এ কথা শুনে গ্রাহকরা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। আমাদের কিছুই করার নেই।’ গাজীপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখা প্রধান বলেন, ‘আমরা এমন কোনো নির্দেশনা পাইনি। না পেলে টাকা কেন দিবো? আমাদের নিজেদের পকেট থেকে তো আর টাকা দিতে পারবো না।’ রাজধানীর সোনালী ব্যাংকের একটি শাখার রেমিট্যান্স কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে গ্রাহকরা চিল্লাপাল্লা করেন। কিন্তু আমরা তো নিজেদের ইচ্ছায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। প্রণোদনা বেড়েছে এ কথাটা আমরা নিউজ দেখেই জেনেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রধান কার্যালয় থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি।’ জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। সেটা দিতেই হবে। এর বাইরে কোনো সুযোগ নেই। যেসব ব্যাংক দেয়নি তারাও দিবে আশা করি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ ব্যাংক দেয়নি। তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত। ব্যাংকগুলো বাস্তবায়ন করেছে কি না কিংবা দিচ্ছে না এমন কোনো অভিযোগ বা তথ্য আমাদের কাছে নেই।’