ঢাকা ০৮:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাড়ে ৫ বছরে ১৭৩ হত্যা বন্ধ হচ্ছে না খুনোখুনি, বাড়ছে উদ্বেগ

  • আপডেট সময় : ১২:২৮:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই ২০২৩
  • ৮০ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে ক্যাম্পে অপরাধ, অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। একে অপরের সঙ্গে তুচ্ছ মনোমালিন্যের মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যাকা- ঘটছে। অপহরণ, মাদক ব্যবসা, মানবপাচার, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। গত সাড়ে ৫ বছরে ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গাসহ ১৭৩টি হত্যাকা- ঘটেছে।
গত শুক্রবার (৭ জুলাই) ভোর ৬টার দিকে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ব্লক-বি-১৭-১৮ সংলগ্ন এলাকায় দুষ্কৃতকারীদের দুপক্ষের গোলাগুলির ঘটনায় ঘটনাস্থলে ৩ জন ও পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও ২জন নিহত হন। এছাড়া আরও ১জনের লাশ পাওয়া যায়। এর আগে বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) সকালে উখিয়ার কুতুপালংয়ের পশ্চিম-১ নম্বর ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে এবাদুল্লাহ নামে এক সাব মাঝিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ৫ বছরে ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গাসহ ১৭৩টি হত্যাকা- ঘটেছে। গত জুন মাসে ক্যাম্প থেকে ৫ রোহিঙ্গাকে অপহরণ, এক মাদ্রাসা ছাত্রসহ ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হাত-পায়ের রগ কেটে ১ জনকে হত্যা এবং এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা ও অপহরণ করে মুক্তিপণ না পেয়ে অধিকাংশ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে।
ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা: উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দাপিয়ে বেড়ায় বলে জানিয়েছেন একাধিক রোহিঙ্গা। এসব সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতায় আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুতুপালং ক্যাম্পের চৌরাস্তার মোড়ের একজন রোহিঙ্গা বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ থেকে ১২টি সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। তারা দিনরাত বিভিন্ন ছদ্মবেশে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে ব্লকে ঘুরে বেড়ায়। আর প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে হত্যাকা- চালায়। রোহিঙ্গা নেতা মুহিব্বুল্লাহকে তার সংগঠনের অফিসে ঢুকে ছদ্মবেশে মুখোশধারীরা হত্যা করেছিল। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে রোহিঙ্গা সমাজ অসহায়। কখন কাকে মেরে ফেলে তার কোনো হিসেব নেই। তাই আমরা রাত-দিন ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করি।’
উখিয়া তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশিক (ছদ্মনাম) বলেন, ‘দুপুরের পর থেকে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে অপরিচিত কিছু মানুষকে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায় সবসময়। ভয়ে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারি না তারা কেন ঘুরছে। আমাদের ধারণা সেসব লোক অপরাধ চক্রের সদস্য।’
টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হারেছ উল্লাহ বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অপরাধগুলো চোখে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। প্রতিবাদ করলে পরে কাল হয়। ’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয়। পাশাপাশি ‘আরসা’ পরিচয় দিয়ে আরও কয়েকটি গ্রুপ ক্যাম্পে সক্রিয় আছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজি ঘটনায় এসব গ্রুপের সদস্যরা জড়িত।
বাইর থেকে ক্যাম্পে অস্ত্র সরবরাহ: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ক্যাম্পের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা যোগসাজসে ক্যাম্পের বাইর থেকে অস্ত্র এনে নিজেদের গোষ্ঠী ভারী করে। বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) দুপুরে উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের ফলিয়াপাড়া রাস্তার মাথা থেকে ক্যাম্প-৩, ব্লক-এ/১৪ এর দুদু মিয়ার ছেলে ফরিদ আলমকে (১৮) অস্ত্রসহ আটক করে উখিয়া থানা পুলিশ।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, চট্টগ্রামের কেরানীহাট থেকে অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্প-৩-এ দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্রের ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, হত্যা ও অপহরণের ঘটনা বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গত বছরের জুন থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও শতাধিক গোলাবারুদসহ ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে ৪৮ জন খুন হন। বেশিরভাগ ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জড়িত। এসব ঘটনায় ১১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অপহরণের নেপথ্যে কারা: রোহিঙ্গা ক্যাম্প, টেকনাফের সদর, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলার বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ দাবির কৌশলে মেতেছে রোহিঙ্গা অপহরণকারীরা। টেকনাফের আলীখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গেল ৩ জুন ৫ রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে সন্ত্রাসীরা। পরদিন একজনের হাতের কবজি কেটে বাকিদের জন্য ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। দুদিন পর ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসে বাকি চার রোহিঙ্গা। এপিবিএনের তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত ১৩৬ রোহিঙ্গাকে অপহরণের ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাসান বারী নূর বলেন, সন্ত্রাসীরা লোকজন অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায়। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে চায়। সে কারণে পাহাড় ঘেঁষে আমাদের যেসব চেকপোস্ট আছে সেগুলোতে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের অবস্থান শনাক্ত ও গতিবিধি নজরদারির জন্য ড্রোনও ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরাধ দমনে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিশেষ করে মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।’
গত শুক্রবার (৭ জুলাই ২০২৩) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠী যারা রয়েছে, তারাই মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ঢুকছে এবং হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যাতে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য আমরা বর্ডার ফোর্সকে আরও শক্তিশালী করছি। জানা যায়, ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারির জন্য ৮৫ ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বেস্টনি ও টহলের জন্য রাস্তা তৈরির কাজ শেষ করেছে। একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করেছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (আরআরআরসি)। এছাড়াও ৩০টি চেকপোস্ট, নিরাপত্তা বেস্টনি, ওয়াকওয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। ৩৩২টি সিসি ক্যামেরা দিয়েছে।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাড়ে ৫ বছরে ১৭৩ হত্যা বন্ধ হচ্ছে না খুনোখুনি, বাড়ছে উদ্বেগ

আপডেট সময় : ১২:২৮:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই ২০২৩

প্রত্যাশা ডেস্ক : ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে ক্যাম্পে অপরাধ, অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। একে অপরের সঙ্গে তুচ্ছ মনোমালিন্যের মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যাকা- ঘটছে। অপহরণ, মাদক ব্যবসা, মানবপাচার, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। গত সাড়ে ৫ বছরে ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গাসহ ১৭৩টি হত্যাকা- ঘটেছে।
গত শুক্রবার (৭ জুলাই) ভোর ৬টার দিকে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ব্লক-বি-১৭-১৮ সংলগ্ন এলাকায় দুষ্কৃতকারীদের দুপক্ষের গোলাগুলির ঘটনায় ঘটনাস্থলে ৩ জন ও পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও ২জন নিহত হন। এছাড়া আরও ১জনের লাশ পাওয়া যায়। এর আগে বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) সকালে উখিয়ার কুতুপালংয়ের পশ্চিম-১ নম্বর ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে এবাদুল্লাহ নামে এক সাব মাঝিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ৫ বছরে ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গাসহ ১৭৩টি হত্যাকা- ঘটেছে। গত জুন মাসে ক্যাম্প থেকে ৫ রোহিঙ্গাকে অপহরণ, এক মাদ্রাসা ছাত্রসহ ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হাত-পায়ের রগ কেটে ১ জনকে হত্যা এবং এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা ও অপহরণ করে মুক্তিপণ না পেয়ে অধিকাংশ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে।
ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা: উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দাপিয়ে বেড়ায় বলে জানিয়েছেন একাধিক রোহিঙ্গা। এসব সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতায় আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুতুপালং ক্যাম্পের চৌরাস্তার মোড়ের একজন রোহিঙ্গা বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ থেকে ১২টি সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। তারা দিনরাত বিভিন্ন ছদ্মবেশে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে ব্লকে ঘুরে বেড়ায়। আর প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে হত্যাকা- চালায়। রোহিঙ্গা নেতা মুহিব্বুল্লাহকে তার সংগঠনের অফিসে ঢুকে ছদ্মবেশে মুখোশধারীরা হত্যা করেছিল। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে রোহিঙ্গা সমাজ অসহায়। কখন কাকে মেরে ফেলে তার কোনো হিসেব নেই। তাই আমরা রাত-দিন ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করি।’
উখিয়া তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশিক (ছদ্মনাম) বলেন, ‘দুপুরের পর থেকে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে অপরিচিত কিছু মানুষকে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায় সবসময়। ভয়ে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারি না তারা কেন ঘুরছে। আমাদের ধারণা সেসব লোক অপরাধ চক্রের সদস্য।’
টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হারেছ উল্লাহ বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অপরাধগুলো চোখে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। প্রতিবাদ করলে পরে কাল হয়। ’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয়। পাশাপাশি ‘আরসা’ পরিচয় দিয়ে আরও কয়েকটি গ্রুপ ক্যাম্পে সক্রিয় আছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজি ঘটনায় এসব গ্রুপের সদস্যরা জড়িত।
বাইর থেকে ক্যাম্পে অস্ত্র সরবরাহ: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ক্যাম্পের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা যোগসাজসে ক্যাম্পের বাইর থেকে অস্ত্র এনে নিজেদের গোষ্ঠী ভারী করে। বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) দুপুরে উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের ফলিয়াপাড়া রাস্তার মাথা থেকে ক্যাম্প-৩, ব্লক-এ/১৪ এর দুদু মিয়ার ছেলে ফরিদ আলমকে (১৮) অস্ত্রসহ আটক করে উখিয়া থানা পুলিশ।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, চট্টগ্রামের কেরানীহাট থেকে অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্প-৩-এ দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্রের ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, হত্যা ও অপহরণের ঘটনা বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গত বছরের জুন থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও শতাধিক গোলাবারুদসহ ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে ৪৮ জন খুন হন। বেশিরভাগ ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জড়িত। এসব ঘটনায় ১১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অপহরণের নেপথ্যে কারা: রোহিঙ্গা ক্যাম্প, টেকনাফের সদর, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলার বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ দাবির কৌশলে মেতেছে রোহিঙ্গা অপহরণকারীরা। টেকনাফের আলীখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গেল ৩ জুন ৫ রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে সন্ত্রাসীরা। পরদিন একজনের হাতের কবজি কেটে বাকিদের জন্য ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। দুদিন পর ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসে বাকি চার রোহিঙ্গা। এপিবিএনের তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত ১৩৬ রোহিঙ্গাকে অপহরণের ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাসান বারী নূর বলেন, সন্ত্রাসীরা লোকজন অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায়। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে চায়। সে কারণে পাহাড় ঘেঁষে আমাদের যেসব চেকপোস্ট আছে সেগুলোতে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের অবস্থান শনাক্ত ও গতিবিধি নজরদারির জন্য ড্রোনও ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরাধ দমনে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিশেষ করে মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।’
গত শুক্রবার (৭ জুলাই ২০২৩) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠী যারা রয়েছে, তারাই মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ঢুকছে এবং হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যাতে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য আমরা বর্ডার ফোর্সকে আরও শক্তিশালী করছি। জানা যায়, ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারির জন্য ৮৫ ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বেস্টনি ও টহলের জন্য রাস্তা তৈরির কাজ শেষ করেছে। একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করেছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (আরআরআরসি)। এছাড়াও ৩০টি চেকপোস্ট, নিরাপত্তা বেস্টনি, ওয়াকওয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। ৩৩২টি সিসি ক্যামেরা দিয়েছে।