মহানগর প্রতিবেদন : স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবেন। স্বপ্ন পূরণে করতে হবে আবেদন। আর প্রতিবার আবেদনে খরচ প্রায় ১৫০ টাকা। আয় নেই, তাই বিক্রি শুরু করেন ধান। আর ধান বেচেই ১৯৮টি আবেদন করেন মনিরুল। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) তৃতীয় নিয়োগ চক্রে সুপারিশ মেলেনি তার।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সামিয়া ভরসীরও স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অভাবের সংসারে টাকা খরচ করে ১৮বার আবেদন করেও সুপারিশ না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।
জয়পুরহাটের আজমান আদিল তাসহান একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘গণিতে ৬৪ নম্বর নিয়ে নারী কোটায় ৪০টি আবেদন করেও সুপারিশ পাননি। বিধবা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘সহকারী শিক্ষক পদেও ৯০টি আবেদন করে সুপারিশ মেলেনি।’
পাবনার ঈশ্বরদীর মোছা. কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘ইহিতাসে ৫৭ নম্বর নিয়ে প্রভাষক পদে ১৩টি এবং সহকারী শিক্ষক পদে ২৭টি আবেদন করেছিলাম নারী কোটায়। কিন্তু সুপারিশ পাইনি।’
শিক্ষক নিয়োগ আবেদনের এমন ঘটনা শুধু এ কয়জনের নয়। শত শত প্রার্থী অভিযোগ করেন, ‘ডজনখানেক আবেদন করেও শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ পাননি তারা। অথচ তাদের চেয়েও কম নম্বর পাওয়া অনেকে সুপারিশ পেয়েছেন।’
এনটিআরসিএ বলছে, ‘নারী কোটায় প্রার্থী না পাওয়ায় ৬ হাজার ৭৭৭ জন এবং আবেদন না পাওয়ায় ৮ হাজার ৪৪৮ জনকে সুপারিশ করা হয়নি। পরে এসকল পদে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে।’
সুপারিশ-বঞ্চিত মনিরুল ইসলাম জানান, ‘ঘরের সব ধান বিক্রি করে ১৯৮টি আবেদন করেছি। ঘরে আর ধান নেই। শুক্রবার (২৩ জুলাই) দিনটা পার হয়েছে। শনিবার (২৪ জুলাই) রান্না করার চাল নেই। চাল কেনার টাকাও নেই। ধানগুলো থাকলে সংসারটা চলতো। এখন কী করবো? চাকরি তো পেলাম না।’
মনিরুল জানান, সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৫২। অনেকে আরও কম নম্বরে চাকরি পেলেও তার সুযোগ হয়নি।
দেশের ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও নিয়োগের সুপারিশ পাননি সামিয়া ভরসী। কী কারণে পাননি তা বোধগম্য নয় বলে জানান তিনি। পঞ্চম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সামিয়া উত্তীর্ণ হয়েছেন ২০০৯ সালে। শিক্ষকতা করতে অপেক্ষা করেছেন ১২ বছর। আর অপেক্ষার ধৈর্য নেই তার।
সামিয়া বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রথম বুঝতে না পেরে শুধু একটি কলেজে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ওই কলেজের বিপরীতে অনেক প্রার্থীর আবেদন থাকায় সুপারিশ পাইনি।’ কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) যথাসময়ে নিয়োগের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি না করায় তার বয়স ৩৫ পেরিয়ে যায়। ফলে বিগত সময় আর নিয়োগের আবেদন করতে পারেননি। প্রথম থেকে ১২তম নিবন্ধনধারীরা আদালতে মামলা করায় তৃতীয় নিয়োগ চক্রে আবেদনের সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু এবারও সুপারিশ পেলাম না।’ গণিতে ৬২ নম্বর পেয়ে ২২টি আবেদন করেও রংপুরের সোলাইমান আলী প্রভাষক পদে নিয়োগের সুপারিশ পাননি। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কমলেশ ম-ল সামাজিক বিজ্ঞানে ৭২ নম্বর নিয়ে ২০টি আবেদন করেছিলেন। তিনিও সুপারিশ পাননি বলে জানান। চট্টগ্রামের আলাউদ্দিন ফিন্যান্সে ৬০ নম্বর নিয়ে আবেদন করেছিলেন। মেধা তালিকায় তার সিরিয়াল ছিল ৮৯১। কিন্তু শিক্ষক হওয়া হলো না তারও।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার জয়নুল আবেদীন ব্যবস্থাপনায় ৬১ নম্বর নিয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোনও কলেজে তাকে সুপারিশ করা হয়নি। সেলিনা বেগম বলেন, ‘সামাজিক বিজ্ঞানে ৫২ নম্বর নিয়ে ৯৫টি আবেদন করেছিলাম। নারী কোটায় ৪৫টি আবেদন ছিল। কোনোটাতেই সুপারিশ মেলেনি।’
অনেকে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন শূন্য পদ নেই এমন প্রতিষ্ঠানে। ইশারত আলী ৬৮টি আবেদন করে পাবনার আটঘরি উপজেলার পারখিদিরপুর সেকেন্ডারি স্কুলে ভৌত বিজ্ঞানের নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন ঠিকই, তবে শূন্য পদ বিদ্যালয়টিতে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৫ জুলাই ৫১ হাজার ৭৬১ পদে নিয়োগের সুপারিশের জন্য তৃতীয় নিয়োগ চক্রের ফল প্রকাশ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। কিন্তু নিয়োগের সুপারিশ করেছে ৩৮ হাজার ২৮৬ জনকে। ১৫ হাজার ৩২৫ জনকে সুপারিশ করতে পারেনি এনটিআরসিএ। কারণ হিসেবে এনটিআরসিএ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানায়, নারী কোটায় প্রার্থী না পাওয়ায় ৬ হাজার ৭৭৭ জন এবং আবেদন না পাওয়ায় ৮ হাজার ৪৪৮ জনকে সুপারিশ করা হয়নি। পরে এসব পদে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সুপারিশ করা হবে।’
প্রায় সব আবেদনকারীদের বক্তব্য হলো, ‘প্রতিটি আবেদনের বিপরীতে লাগে ১০০ টাকা। আবেদন করতে খরচ ৫০ টাকা। আবারও প্রত্যেক প্রার্থীকে কয়েক ডজন করে আবেদন করতে হবে? একটি পদের জন্য কেন এতবার আবেদন করতে হবে? এনটিআরসিএ কি আবেদনের অর্থ দিয়ে ব্যবসা করবে?’ এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান মো. এনামুল কাদের খান বলেন, ‘তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল।’
ধান বেচে ১৯৮টি আবেদন করেছিলেন মনিরুল
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ