ঢাকা ০৫:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

গৃহপরিচারিকাকে পেটানোর ঘটনা সত্য, ভিডিও ভাইরালের নেপথ্যে…

  • আপডেট সময় : ১১:৪৪:০৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ মে ২০২৩
  • ১৪৮ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু প্রতিবেদন ; স্যুট পরা যুবক। হাতে প্লাস্টিকের মোটা পাইপ। ‘আর করবি, আর করবি’ বলে সেই পাইপ দিয়ে তিনি পেটাচ্ছেন ১৫ বছর বয়সের গৃহপরিচারিকাকে। মার খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওই গৃহপরিচারিকা। কয়েকদিন ধরে এমন ভিডিও ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। শিশুকে নির্মমভাবে পেটানোর ওই ভিডিও শেয়ার করে অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি দাবি করেন অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মারধরকারী ব্যক্তির নাম মো. আরাফাত হোসেন। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চকবাজার থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কর্মরত। ঘটনা অবশ্য গত বছরের। কিন্তু যৌক্তিক কারণে এটি ভাইরাল হয়েছে সম্প্রতি। ভাইরাল হওয়ার পরপর গত ২০ এপ্রিল তাকে ক্লোজড করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনাটি অনুসন্ধান করেন নগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (চকবাজার জোন) মো. শহীদুল ইসলাম। তার তদন্তে উঠে আসে নির্দয়ভাবে মেয়ে শিশুকে পেটানোর ঘটনা ‘সত্য’। শুধু মারধর নয়, ওই শিশুকে দিয়ে নানা সময়ে হাত-পা মালিশ ও টেপানোসহ নানা কাজ করিয়ে নিতেন আরাফাত।
এছাড়া নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে এসআই আরাফাত তার বন্ধু রাশেদের স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরী রুমুর ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। দুজনের মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে অশোভন আলাপের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে তদন্তে।
গত সোমবার (৮ মে) তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাফিজুর রহমানের নিকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর অভিযুক্ত এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এখন তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা রুজু হয়েছে বলে জানান নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার মোমিন রোড এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল আলম মানিক। তিনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর্থিকভাবেও বেশ সচ্ছল। ২০২২ সালে পাসপোর্ট আবেদন ভেরিফিকেশন করার সূত্র ধরে রাশেদের সঙ্গে তৎকালীন কোতোয়ালি থানায় দায়িত্বরত এসআই আরাফাতের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। একপর্যায়ে তা গভীর হয়। আরাফাত যখনই সময় পেতেন রাশেদের বাসায় যাওয়া-আসা, খাওয়া-দাওয়া করতেন। তাদের বাড়ির যাবতীয় বিষয় দেখভাল করতেন। মোটামুটি রাশেদের বাসায় আরাফাত ‘মাতবর’ টাইপের লোক হয়ে ওঠেন। রাশেদও তার পুলিশবন্ধু আরাফাতের সব কর্মকা- সমর্থন করতেন। রাশেদের বাসায় তিনজন কাজের লোক ছিল। তাদের মধ্যে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা একজনের সাক্ষ্য নিয়েছেন। সবমিলিয়ে তদন্তে উঠে আসে শুধু ভিডিওর সময় নয়, অন্যান্য সময় আরাফাত রাশেদের বাসায় কাজের মেয়েকে মারধর, তাকে দিয়ে হাত-পা টেপানো ও মালিশের কাজ করতেন। গোপনে এসব কর্মকা-ের কিছু অংশ ভিডিও করে রাখেন রাশেদের স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরী রুমু। আরাফাত এসব বিষয় জানতেন না।
ভিডিও ভাইরাল হওয়ার নেপথ্যে: গত ৪ ফেব্রুয়ারি নগরের দামপাড়া এলাকার ‘হোয়াইট পার্ক’ নামের একটি হোটেলে ইভান আবির নামের এক বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যান রাশেদের স্ত্রী ফারজানা। খবর পেয়ে রাশেদ ও এসআই আরাফাত হোটেলটির ২০১ নম্বর কক্ষ থেকে ফারজানা ও তার বয়ফ্রেন্ডকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। ৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন রাশেদ। একই সঙ্গে তাকে বাড়ি থেকেও বের করে দেন। ডিভোর্সের পর ফারজানা তার মায়ের সঙ্গে থাকছেন।
এদিকে, পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে আসে, রাশেদের টাকায় তার স্ত্রী ফারজানা বিলাসী জীবন-যাপন করতেন। প্রচুর টাকা-পয়সাও খরচ করতেন। কিন্তু ফারজানার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। এ কারণে ডিভোর্সের পর ফারজানা আগের মতো জীবন-যাপন করতে পারছিলেন না। তার (ফারজানা) ধারণা, তাকে ডিভোর্স দেওয়ার নেপথ্যে এসআই আরাফাত জড়িত। তার পরামর্শে রাশেদ তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজ মোবাইলে থাকা এসআই আরাফাতের ভিডিও ভাইরাল করে দেন ফারজানা। যদিও এ বিষয়ে তিনি কোথাও কোনো অভিযোগ দেননি।
রাশেদের স্ত্রীর প্রতি দুর্বল ছিলেন এসআই আরাফাত: রাশেদের স্ত্রী ফারজানার সঙ্গে এসআই আরাফাতের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। তাদের দুজনের আলাপের কিছু স্ক্রিনশট অনুসন্ধানী কর্মকর্তার হাতে আসে। দুজনের চ্যাটিংয়ে অশোভন আলাপের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একপর্যায়ে ফারজানাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয় এসআই আরাফাত। তবে ফারজানার সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক থাকায় আরাফাতের সঙ্গে আর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। যদিও বিষয়টি রাশেদ ও এসআই আরাফাত দুজনই অস্বীকার করেন। অনুসন্ধানী কর্মকর্তা সার্বিক দিক মিলিয়ে ফারজানার প্রতি এসআই আরাফাত দুর্বল ছিলেন বলে মত দিয়েছেন।
এসআই আরাফাতের কর্মকা-ে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে: ঘটনার বিষয়ে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা ও নগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, এসআই আরাফাত একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। তিনি অন্যের বাসায় গিয়ে কাউকে তো পেটাতে পারেন না। এখন এসআই বলছে রাশেদের স্ত্রীর হাত থেকে গৃহপরিচারিকাকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি মেরেছেন। প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্য হয়ে আরেকজনের বাসায় গিয়ে কাউকে পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার কারণে সমগ্র পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি তদন্ত করতে একজন অনুসন্ধানী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। সোমবার তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় অভিযুক্ত এসআই আরাফাতকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অভিযুক্ত এসআই আরাফাত যা বললেন: ঘটনাটি গত বছরের নভেম্বর মাসের। আমি ওই দিন তাদের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলাম। আসলে ওই দিন স্বর্ণ চুরি করেছে বলে অভিযোগ তুলে গৃহপরিচারিকা রিফাকে মারধর করতে থাকেন রাশেদের স্ত্রী ফারজানা। তখন রাশেদ আমাকে বলে ফারজানাকে একটু থামা, না হয় ও মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। তখন আমি একটা হালকা করে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। এটিই হচ্ছে মূল বিষয়। ওই দিন গোপনে ভিডিওটি ধারণ করেন ফারজানা। পরবর্তীতে ফারজানা তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হাতেনাতে ধরা খায়। এরপর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। ফারজানা মনে করেছে তার ডিভোর্সের নেপথ্যে আমি। এজন্য তিনি তার মোবাইলে থাকা ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন।
এসআই আরাফাতের বন্ধু মো. রাশেদ যা বলেন: আসলে এখানে আরাফাতের কোনো দোষ নেই। আমি গৃহপরিচারিকাকে অতিরিক্ত মারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে একটু শাসন করেছিলাম। মজার ছলে আমার স্ত্রী তখন সেটি ভিডিও করে রেখেছিলেন। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে আমার স্ত্রী একটি ছেলের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করতে গিয়ে আমার হাতে ধরা পড়ে। তারপর আমি তাকে ডিভোর্স দিই। এখন আমার স্ত্রী মনে করেছে হাতেনাতে ধরা এবং ডিভোর্সের বিষয়ে আরাফাত (এসআই) সহযোগিতা করেছেন। তাই তিনি আগের সেই মজা করার ভিডিওটি ফেসবুক-ইউটিউবে ভাইরাল করে দেন। এমনকি আমাকেও হুমকি দিয়ে আমার স্ত্রী বলেন, ‘আরাফাতের ভিডিও ভাইরাল করে ওকে নাজেহাল করছি, এবার তোমাকে করব’।
অভিযুক্ত এসআই আরাফাত: মারধরের শিকার রিফা আক্তারের মা সুমি আক্তার বলেন, ওই দিন ম্যাডাম (ফারজানা) আমার মেয়ে স্বর্ণ চুরি করেছে— এমন অভিযোগ তুলে মারধর করেন। পুলিশ (আরাফাত) গিয়ে একটা বাড়ি দিয়ে আমার মেয়েকে বাঁচাইছে। ম্যাডামের বাসায় আমার মেয়ে ছয় মাসের মতো কাজ করেছে। এ সময় মেয়েকে আমার সঙ্গে ভালো করে দেখা পর্যন্ত করতে দিতেন না। সার্বিক বিষয়ে জানতে রাশেদের স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরী রুমুর নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
আইনজীবীর পরামর্শ: মারধরের শিকার গৃহপরিচারিকা রিফা আক্তারের বয়স ১৫ বছর। তাকে পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেসবুক-ইউটিউবে। আইনজীবীরা জানান, এ ধরনের ঘটনায় প্রচলিত আইনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যেতে পারে। তারপর পুলিশ তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেবে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তা। তাই তার বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে বিভাগীয় ব্যবস্থা। দায়ের করা হয়নি কোনো মামলা। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন বলেন, আইন সবার জন্য সমান। পুলিশ বলে কেউ অতিরিক্ত সুবিধা পাবেন, এটি হওয়া উচিত নয়। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা দায়ের জরুরি। তাছাড়া এখন ভিডিওর আগে ফারজানা নামের এক নারীও ওই গৃহপরিচারিকাকে মেরেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়েও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

গৃহপরিচারিকাকে পেটানোর ঘটনা সত্য, ভিডিও ভাইরালের নেপথ্যে…

আপডেট সময় : ১১:৪৪:০৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ মে ২০২৩

নারী ও শিশু প্রতিবেদন ; স্যুট পরা যুবক। হাতে প্লাস্টিকের মোটা পাইপ। ‘আর করবি, আর করবি’ বলে সেই পাইপ দিয়ে তিনি পেটাচ্ছেন ১৫ বছর বয়সের গৃহপরিচারিকাকে। মার খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওই গৃহপরিচারিকা। কয়েকদিন ধরে এমন ভিডিও ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। শিশুকে নির্মমভাবে পেটানোর ওই ভিডিও শেয়ার করে অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি দাবি করেন অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মারধরকারী ব্যক্তির নাম মো. আরাফাত হোসেন। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চকবাজার থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কর্মরত। ঘটনা অবশ্য গত বছরের। কিন্তু যৌক্তিক কারণে এটি ভাইরাল হয়েছে সম্প্রতি। ভাইরাল হওয়ার পরপর গত ২০ এপ্রিল তাকে ক্লোজড করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনাটি অনুসন্ধান করেন নগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (চকবাজার জোন) মো. শহীদুল ইসলাম। তার তদন্তে উঠে আসে নির্দয়ভাবে মেয়ে শিশুকে পেটানোর ঘটনা ‘সত্য’। শুধু মারধর নয়, ওই শিশুকে দিয়ে নানা সময়ে হাত-পা মালিশ ও টেপানোসহ নানা কাজ করিয়ে নিতেন আরাফাত।
এছাড়া নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে এসআই আরাফাত তার বন্ধু রাশেদের স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরী রুমুর ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। দুজনের মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে অশোভন আলাপের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে তদন্তে।
গত সোমবার (৮ মে) তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাফিজুর রহমানের নিকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর অভিযুক্ত এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এখন তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা রুজু হয়েছে বলে জানান নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার মোমিন রোড এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল আলম মানিক। তিনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর্থিকভাবেও বেশ সচ্ছল। ২০২২ সালে পাসপোর্ট আবেদন ভেরিফিকেশন করার সূত্র ধরে রাশেদের সঙ্গে তৎকালীন কোতোয়ালি থানায় দায়িত্বরত এসআই আরাফাতের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। একপর্যায়ে তা গভীর হয়। আরাফাত যখনই সময় পেতেন রাশেদের বাসায় যাওয়া-আসা, খাওয়া-দাওয়া করতেন। তাদের বাড়ির যাবতীয় বিষয় দেখভাল করতেন। মোটামুটি রাশেদের বাসায় আরাফাত ‘মাতবর’ টাইপের লোক হয়ে ওঠেন। রাশেদও তার পুলিশবন্ধু আরাফাতের সব কর্মকা- সমর্থন করতেন। রাশেদের বাসায় তিনজন কাজের লোক ছিল। তাদের মধ্যে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা একজনের সাক্ষ্য নিয়েছেন। সবমিলিয়ে তদন্তে উঠে আসে শুধু ভিডিওর সময় নয়, অন্যান্য সময় আরাফাত রাশেদের বাসায় কাজের মেয়েকে মারধর, তাকে দিয়ে হাত-পা টেপানো ও মালিশের কাজ করতেন। গোপনে এসব কর্মকা-ের কিছু অংশ ভিডিও করে রাখেন রাশেদের স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরী রুমু। আরাফাত এসব বিষয় জানতেন না।
ভিডিও ভাইরাল হওয়ার নেপথ্যে: গত ৪ ফেব্রুয়ারি নগরের দামপাড়া এলাকার ‘হোয়াইট পার্ক’ নামের একটি হোটেলে ইভান আবির নামের এক বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যান রাশেদের স্ত্রী ফারজানা। খবর পেয়ে রাশেদ ও এসআই আরাফাত হোটেলটির ২০১ নম্বর কক্ষ থেকে ফারজানা ও তার বয়ফ্রেন্ডকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। ৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন রাশেদ। একই সঙ্গে তাকে বাড়ি থেকেও বের করে দেন। ডিভোর্সের পর ফারজানা তার মায়ের সঙ্গে থাকছেন।
এদিকে, পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে আসে, রাশেদের টাকায় তার স্ত্রী ফারজানা বিলাসী জীবন-যাপন করতেন। প্রচুর টাকা-পয়সাও খরচ করতেন। কিন্তু ফারজানার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। এ কারণে ডিভোর্সের পর ফারজানা আগের মতো জীবন-যাপন করতে পারছিলেন না। তার (ফারজানা) ধারণা, তাকে ডিভোর্স দেওয়ার নেপথ্যে এসআই আরাফাত জড়িত। তার পরামর্শে রাশেদ তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজ মোবাইলে থাকা এসআই আরাফাতের ভিডিও ভাইরাল করে দেন ফারজানা। যদিও এ বিষয়ে তিনি কোথাও কোনো অভিযোগ দেননি।
রাশেদের স্ত্রীর প্রতি দুর্বল ছিলেন এসআই আরাফাত: রাশেদের স্ত্রী ফারজানার সঙ্গে এসআই আরাফাতের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। তাদের দুজনের আলাপের কিছু স্ক্রিনশট অনুসন্ধানী কর্মকর্তার হাতে আসে। দুজনের চ্যাটিংয়ে অশোভন আলাপের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একপর্যায়ে ফারজানাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয় এসআই আরাফাত। তবে ফারজানার সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক থাকায় আরাফাতের সঙ্গে আর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। যদিও বিষয়টি রাশেদ ও এসআই আরাফাত দুজনই অস্বীকার করেন। অনুসন্ধানী কর্মকর্তা সার্বিক দিক মিলিয়ে ফারজানার প্রতি এসআই আরাফাত দুর্বল ছিলেন বলে মত দিয়েছেন।
এসআই আরাফাতের কর্মকা-ে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে: ঘটনার বিষয়ে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা ও নগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, এসআই আরাফাত একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। তিনি অন্যের বাসায় গিয়ে কাউকে তো পেটাতে পারেন না। এখন এসআই বলছে রাশেদের স্ত্রীর হাত থেকে গৃহপরিচারিকাকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি মেরেছেন। প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্য হয়ে আরেকজনের বাসায় গিয়ে কাউকে পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার কারণে সমগ্র পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি তদন্ত করতে একজন অনুসন্ধানী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। সোমবার তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় অভিযুক্ত এসআই আরাফাতকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অভিযুক্ত এসআই আরাফাত যা বললেন: ঘটনাটি গত বছরের নভেম্বর মাসের। আমি ওই দিন তাদের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলাম। আসলে ওই দিন স্বর্ণ চুরি করেছে বলে অভিযোগ তুলে গৃহপরিচারিকা রিফাকে মারধর করতে থাকেন রাশেদের স্ত্রী ফারজানা। তখন রাশেদ আমাকে বলে ফারজানাকে একটু থামা, না হয় ও মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। তখন আমি একটা হালকা করে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। এটিই হচ্ছে মূল বিষয়। ওই দিন গোপনে ভিডিওটি ধারণ করেন ফারজানা। পরবর্তীতে ফারজানা তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হাতেনাতে ধরা খায়। এরপর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। ফারজানা মনে করেছে তার ডিভোর্সের নেপথ্যে আমি। এজন্য তিনি তার মোবাইলে থাকা ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন।
এসআই আরাফাতের বন্ধু মো. রাশেদ যা বলেন: আসলে এখানে আরাফাতের কোনো দোষ নেই। আমি গৃহপরিচারিকাকে অতিরিক্ত মারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে একটু শাসন করেছিলাম। মজার ছলে আমার স্ত্রী তখন সেটি ভিডিও করে রেখেছিলেন। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে আমার স্ত্রী একটি ছেলের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করতে গিয়ে আমার হাতে ধরা পড়ে। তারপর আমি তাকে ডিভোর্স দিই। এখন আমার স্ত্রী মনে করেছে হাতেনাতে ধরা এবং ডিভোর্সের বিষয়ে আরাফাত (এসআই) সহযোগিতা করেছেন। তাই তিনি আগের সেই মজা করার ভিডিওটি ফেসবুক-ইউটিউবে ভাইরাল করে দেন। এমনকি আমাকেও হুমকি দিয়ে আমার স্ত্রী বলেন, ‘আরাফাতের ভিডিও ভাইরাল করে ওকে নাজেহাল করছি, এবার তোমাকে করব’।
অভিযুক্ত এসআই আরাফাত: মারধরের শিকার রিফা আক্তারের মা সুমি আক্তার বলেন, ওই দিন ম্যাডাম (ফারজানা) আমার মেয়ে স্বর্ণ চুরি করেছে— এমন অভিযোগ তুলে মারধর করেন। পুলিশ (আরাফাত) গিয়ে একটা বাড়ি দিয়ে আমার মেয়েকে বাঁচাইছে। ম্যাডামের বাসায় আমার মেয়ে ছয় মাসের মতো কাজ করেছে। এ সময় মেয়েকে আমার সঙ্গে ভালো করে দেখা পর্যন্ত করতে দিতেন না। সার্বিক বিষয়ে জানতে রাশেদের স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরী রুমুর নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
আইনজীবীর পরামর্শ: মারধরের শিকার গৃহপরিচারিকা রিফা আক্তারের বয়স ১৫ বছর। তাকে পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেসবুক-ইউটিউবে। আইনজীবীরা জানান, এ ধরনের ঘটনায় প্রচলিত আইনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যেতে পারে। তারপর পুলিশ তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেবে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তা। তাই তার বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে বিভাগীয় ব্যবস্থা। দায়ের করা হয়নি কোনো মামলা। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন বলেন, আইন সবার জন্য সমান। পুলিশ বলে কেউ অতিরিক্ত সুবিধা পাবেন, এটি হওয়া উচিত নয়। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা দায়ের জরুরি। তাছাড়া এখন ভিডিওর আগে ফারজানা নামের এক নারীও ওই গৃহপরিচারিকাকে মেরেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়েও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।