ঢাকা ০৯:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

২২ বিলিয়ন ডলারে নামছে রিজার্ভ!

  • আপডেট সময় : ০২:২৮:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩
  • ১০০ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ও ডলার সংকটের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এতে চাপে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী সোমবার (৮ মে) এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মাসের আমদানি বিল ১১৮ কোটি ডলার পরিশোধ করা হবে। ফলে রিজার্ভ আরও কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি থাকায় আমদানি ব্যয় কমেনি। এছাড়া করোনা পর বৈশ্বিক বাণিজ্য আগের অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে; যা এখনো অব্যাহত আছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এ সূচকটির ধারাবাহিকতা কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ৩ মে দিনশেষ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৮ কোটি ডলার (৩০ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন)। আগামী ৮ মে আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা-আকুর (মার্চ- এপ্রিল) আমদানি বিল বাবদ ১১৮ কোটি ডলার পরিশোধ করা হবে। এতে করে রিজার্ভ নেমে আসবে ২৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানদ-ে রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হয়, তাহলে এ অংক নেমে দাঁড়াবে ২২ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি মাসে ৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এ রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন ব্যবহারযোগ্য ২৪ বিলিয়ন নেট রিজার্ভ রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন তহবিল এবং ঋণ হিসাব যোগ করলে মোট ৩১ বিলিয়ন হবে
রিজার্ভ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন ব্যবহারযোগ্য ২৪ বিলিয়ন নেট রিজার্ভ রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন তহবিল এবং ঋণ হিসাব যোগ করলে মোট ৩১ বিলিয়ন হবে। গত মার্চ-এপ্রিলের আকুর বিল পরিশোধ করলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নেমে আসবে ২২ বিলিয়ন ডলারে। দেড় বছর আগেরও এ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। সেখান থেকে কমতে কমতে এখন গ্রস ধরলে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়। ডলার সংকটের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় রিজার্ভ কমছে। ধারাবাহিক রিজার্ভ কমাকে আশঙ্কার বিষয় মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম। সম্প্রতি সময়ে বিশ্ব ব্যাংকসহ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, যা বাজেটে সহায়তা করবে। এটা কিছুটা স্বস্তি দেবে এ বি মির্জা মো.আজিজুল ইসলাম
তিনি বলেন, রিজার্ভ এখনই আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব না। কারণ রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স গত কয়েক মাস যাবত নেতিবাচক দেখা যাচ্ছে। এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া সময়মত ব্যয় করতে না পারায় যেসমস্ত প্রতিশ্রুতির বৈদেশিক ঋণ বা সহায়তা আছে তা ছাড়াতে হবে। পাশাপাশি সম্প্রতি সময়ে বিশ্ব ব্যাংকসহ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, যা বাজেটে সহায়তা করবে। এটা কিছুটা স্বস্তি দেবে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি খুব ভালো বলা যাবে না। তবে আমাদের অবস্থা শ্রীলংকা হবে না এটা বলা যায়- জানান এ অর্থনীতিবিদ।
আকু হলো- একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করে। তবে এখন আকুর সদস্য পদ নেই শ্রীলঙ্কার। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে দীর্ঘদিন যাবত আমদানি ব্যয় পরিশোধের বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির আকু সদস্য পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশনের (এসক্যাপ) ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য আকুর সদস্য পদ উন্মুক্ত।
রিজার্ভ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দেশের রিজার্ভ বাড়া-কমার মধ্যে থাকবে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ পরিবর্তিত হয়। আকু পেমেন্টও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ। ডলার সংকট আছে, এটি মোকাবেলায় ধারাবাহিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। সংকট কাটাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আশা করছি শিগগিরই এর সুফল মিলবে।
প্রসঙ্গত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে রিজার্ভ কমে এ পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৮০৪ কোটি ডলাররে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে গত বছর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫-১৬ তে ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ২০২০-২১ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আমদানি বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমার কারণে দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে দাম। অপরদিকে ডলারের বিপরীতে পতন হচ্ছে টাকার মান। এ কারণে রেমিট্যান্স বাড়াতে ও আমদানি কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি
কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৩ মে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ৫ কোটি ৫ লাখ ডলার বা ৫৫ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৩ মে পর্যন্ত এক হাজার ২৩৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিনেছিল প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার। ডলার কেনার চেয়ে এখন বিক্রির চাপ বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব হয় আইএমএফের ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম ৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসাব করে বাংলাদেশ। নিট হিসাব থেকে ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ বাদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসেবটাই প্রকাশ করে আসছে। তবে সারা বিশ্বে প্রচলিত ও বহুলব্যবহৃত আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ গণনায় বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত বিভিন্ন তহবিলের পাশাপাশি বিমানের জন্য প্রদত্ত ঋণ গ্যারান্টি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া ঋণ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে আমানত এবং নির্দিষ্ট গ্রেডের নিচে থাকা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব খাতে বর্তমানে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার দেওয়া আছে।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

২২ বিলিয়ন ডলারে নামছে রিজার্ভ!

আপডেট সময় : ০২:২৮:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক : রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ও ডলার সংকটের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এতে চাপে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী সোমবার (৮ মে) এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মাসের আমদানি বিল ১১৮ কোটি ডলার পরিশোধ করা হবে। ফলে রিজার্ভ আরও কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি থাকায় আমদানি ব্যয় কমেনি। এছাড়া করোনা পর বৈশ্বিক বাণিজ্য আগের অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে; যা এখনো অব্যাহত আছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এ সূচকটির ধারাবাহিকতা কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ৩ মে দিনশেষ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৮ কোটি ডলার (৩০ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন)। আগামী ৮ মে আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা-আকুর (মার্চ- এপ্রিল) আমদানি বিল বাবদ ১১৮ কোটি ডলার পরিশোধ করা হবে। এতে করে রিজার্ভ নেমে আসবে ২৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানদ-ে রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হয়, তাহলে এ অংক নেমে দাঁড়াবে ২২ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি মাসে ৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এ রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন ব্যবহারযোগ্য ২৪ বিলিয়ন নেট রিজার্ভ রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন তহবিল এবং ঋণ হিসাব যোগ করলে মোট ৩১ বিলিয়ন হবে
রিজার্ভ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন ব্যবহারযোগ্য ২৪ বিলিয়ন নেট রিজার্ভ রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন তহবিল এবং ঋণ হিসাব যোগ করলে মোট ৩১ বিলিয়ন হবে। গত মার্চ-এপ্রিলের আকুর বিল পরিশোধ করলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নেমে আসবে ২২ বিলিয়ন ডলারে। দেড় বছর আগেরও এ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। সেখান থেকে কমতে কমতে এখন গ্রস ধরলে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়। ডলার সংকটের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় রিজার্ভ কমছে। ধারাবাহিক রিজার্ভ কমাকে আশঙ্কার বিষয় মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম। সম্প্রতি সময়ে বিশ্ব ব্যাংকসহ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, যা বাজেটে সহায়তা করবে। এটা কিছুটা স্বস্তি দেবে এ বি মির্জা মো.আজিজুল ইসলাম
তিনি বলেন, রিজার্ভ এখনই আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব না। কারণ রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স গত কয়েক মাস যাবত নেতিবাচক দেখা যাচ্ছে। এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া সময়মত ব্যয় করতে না পারায় যেসমস্ত প্রতিশ্রুতির বৈদেশিক ঋণ বা সহায়তা আছে তা ছাড়াতে হবে। পাশাপাশি সম্প্রতি সময়ে বিশ্ব ব্যাংকসহ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, যা বাজেটে সহায়তা করবে। এটা কিছুটা স্বস্তি দেবে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি খুব ভালো বলা যাবে না। তবে আমাদের অবস্থা শ্রীলংকা হবে না এটা বলা যায়- জানান এ অর্থনীতিবিদ।
আকু হলো- একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করে। তবে এখন আকুর সদস্য পদ নেই শ্রীলঙ্কার। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে দীর্ঘদিন যাবত আমদানি ব্যয় পরিশোধের বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির আকু সদস্য পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশনের (এসক্যাপ) ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য আকুর সদস্য পদ উন্মুক্ত।
রিজার্ভ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দেশের রিজার্ভ বাড়া-কমার মধ্যে থাকবে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ পরিবর্তিত হয়। আকু পেমেন্টও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ। ডলার সংকট আছে, এটি মোকাবেলায় ধারাবাহিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। সংকট কাটাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আশা করছি শিগগিরই এর সুফল মিলবে।
প্রসঙ্গত, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে রিজার্ভ কমে এ পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৮০৪ কোটি ডলাররে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে গত বছর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫-১৬ তে ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ২০২০-২১ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আমদানি বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমার কারণে দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে দাম। অপরদিকে ডলারের বিপরীতে পতন হচ্ছে টাকার মান। এ কারণে রেমিট্যান্স বাড়াতে ও আমদানি কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি
কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৩ মে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ৫ কোটি ৫ লাখ ডলার বা ৫৫ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৩ মে পর্যন্ত এক হাজার ২৩৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিনেছিল প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার। ডলার কেনার চেয়ে এখন বিক্রির চাপ বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব হয় আইএমএফের ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম ৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসাব করে বাংলাদেশ। নিট হিসাব থেকে ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া অর্থ বাদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসেবটাই প্রকাশ করে আসছে। তবে সারা বিশ্বে প্রচলিত ও বহুলব্যবহৃত আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ গণনায় বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত বিভিন্ন তহবিলের পাশাপাশি বিমানের জন্য প্রদত্ত ঋণ গ্যারান্টি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া ঋণ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে আমানত এবং নির্দিষ্ট গ্রেডের নিচে থাকা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব খাতে বর্তমানে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার দেওয়া আছে।