ঢাকা ০২:৪৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মেয়াদি আমানতের সুদহারে গ্রাহকদের সাথে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রবঞ্চনা

  • আপডেট সময় : ০২:৩৯:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১
  • ৬৫ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : এদেশে কর্মরত বেসরকারি ব্যাংকগুলো বর্তমানে মেয়াদি আমানতের সুদহার সর্বনি¤েœ নামিয়ে এসেছে। যা গ্রাহকদের সাথে প্রবঞ্চনা। মহামারীর আগে যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ৬-৯ শতাংশ সুদ দিতো, তারাই এখন সুদহার দেড় শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অথচ করোনা মহামারী শুরু আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কিন্তু মহামারীতে সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ দেশের ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। বিনিয়োগ খরার কারণে দেশের মুদ্রাবাজারে অলস তারল্যের পাহাড় তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছে। বিগত ২০১৯ সালের জুনে ব্র্যাক ব্যাংক ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতো। ওই ব্র্যাক ব্যাংক এখন গ্রাহকদের একই মেয়াদের আমানতের জন্য মাত্র ১ দশমিক ৫০ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। ৬ মাস মেয়াদি আমানতের েেত্র এখন ব্র্যাক ব্যাংকের সুদহারই সবচেয়ে কম। তবে এ মুহূর্তে গ্রাহকদের ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ সুদ দিচ্ছে প্রাইম ব্যাংক। অথচ ২০১৯ সালের জুনেও ব্যাংকটি ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে মেয়াদি আমানতের সুদহার যে পর্যায়ে নেমেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনই দেখা যায়নি। মূলত বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ-খরা ও মহামারী সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অলস তারল্য। চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহার ৫০ পয়সার নিচে নেমেছে। বিনিয়োগের কোনো জায়গা না থাকার সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের বিকল্প কোনো উৎস না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংক টাকা রাখছে। ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সবচেয়ে কম সুদ দেয়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ইস্টার্ন, ডাচ্-বাংলা, যমুনা, শাহজালাল ইসলামী, দ্য সিটি, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ওই ব্যাংকগুলো আমানতের জন্য গ্রাহকদের সুদ দিচ্ছে দেড় থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ শতাংশ। নতুন ও দুর্বল ব্যাংকগুলো ছাড়া দেশের বেসরকারি অন্যান্য ব্যাংকও আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। অথচ করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদও ছিল ৬ শতাংশের বেশি।
সূত্র জানায়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ৭৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে মোট আমানত আছে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা। ৫ কোটি ৬২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে ওই আমানত জমা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতের ৪৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ হলো মেয়াদি আমানত। মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সময় ৩ মাস। অন্য সব শ্রেণীর আমানতের তুলনায় মেয়াদি আমানতের সুদহার সব সময়ই বেশি থাকে। সরকার ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য ২০১৮ সাল থেকে তৎপর হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় সুদহার বেঁধে দিয়ে ঋণ ও আমানতের সুদ কমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মুদ্রাবাজারে তারল্য সংকট থাকায় সুদহার নিয়ন্ত্রণের ওই তৎপরতা সফল হয়নি। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ কার্যকর হয়। আর ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়া হয় ৬ শতাংশ।
সূত্র আরো জানায়, সরকার ব্যাংকগুলোকে আমানত ও ঋণের জন্য যথাক্রমে ৬ ও ৯ শতাংশ হারে সুদহার বেঁধে দিয়েছে। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমাতে থাকে। পরবর্তী সময়ে করোনা সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ইতিহাসে সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকার স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ওসব প্যাকেজের প্রথম দফা ঋণ বিতরণও প্রায় শেষ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হিসেবে এটিই সর্বনিম্ন। অন্যদিকে ঋণ প্রবৃদ্ধির ভাটার বিপরীতে অলস তারল্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। ওই তারল্যের ৪৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ বা ৮৯ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা ছিল দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়। বিগত ২০১৯ সালের জুনে ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদে ৬ মাস মেয়াদি আমানত নিয়েছে দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। কিন্তু ওই ব্যাংকটি চলতি বছরের জুনে ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সিটি ব্যাংকে জমা আছে গ্রাহকদের প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার আমানত। বর্তমানে ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭৭ শতাংশে। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার সবচেয়ে কম। বর্তমানে ওই ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার আড়াই থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। রিটেইল ব্যাংকিংয়ে দাপট থাকায় আগে থেকেই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম ছিল। তারপরও ২০১৯ সালের জুনে ৬ মাস মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ব্যাংকটি গ্রাহকদের সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতো। বর্তমানে কোনো শ্রেণীর আমানতের জন্যই সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে না ডাচ্-বাংলা।
এদিকে ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, মেয়াদি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনাকে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা। দেশে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬ শতাংশ। ঢাকা শহরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশেরও বেশি। এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের যে সুদ দিচ্ছে তা প্রবঞ্চনার মধ্যে পড়ে। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রবঞ্চনার পরিণতি ভালো হবে না। দেশে বিনিয়োগের পরিস্থিতি উন্নত হলে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের এই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তখন ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীদের কাছেই যেতে হবে। পাশাপাশি ঋণের সুদহার বেশি হলে উদ্যোক্তারাও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। কারণ বিশ্বের কোথাও আমানত ও ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশের মতো সুদ পরিশোধ করা হয় না। বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংকগুলোয় বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোও আমানতের সুদহার কমিয়ে এনেছে। ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করলে বর্তমান পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ ও আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল প্রবীণ নাগরিকদের কথা চিন্তা করলে তা খুব খারাপ। এক সময় ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রেখে মাসে ১ হাজার টাকা পাওয়া যেতো। বর্তমানে দেশের ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে মেয়াদি আমানতে সবচেয়ে কম সুদ দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটি ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য সুদ দিচ্ছে দেড় থেকে আড়াই শতাংশ। যদিও ২০১৯ সালের জুনে ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক গ্রাহকদের ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করেছিল। বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরদের মতে, মেয়াদি আমানতের বর্তমান সুদহার মোটেই কাম্য হতে পারে না। বর্তমানে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশেরও বেশি। ব্যাংকগুলোর উচিত হবে মেয়াদি আমানতের সুদহার অন্তত মূল্যস্ফীতির বেশি দেয়া। সীমাতিরিক্ত তারল্যের কারণে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তপে জরুরি। তাছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মুদ্রাবাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বেসরকারি খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রণোদনার টাকা ছাড়া কোনো ব্যাংকই নতুন কোনো প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি ভালো লণ নয়। মুদ্রাবাজারের অতিরিক্ত তারল্য মূল্যস্ফীতিকেও উসকে দিচ্ছে। ঋণের চাহিদা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক হবে না। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে অতিরিক্ত তারল্যের এ চিত্র থাকবে না। বিনিয়োগ চাহিদা তৈরি হলে ব্যাংক খাতে আবারো তারল্য সংকট দেখা দেবে। তখন ব্যাংকগুলো আবারো বেশি সুদে আমানত নিতে বাধ্য হবে।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মাসরুর আরেফিন জানান, সঞ্চয়ের দিক থেকে এদেশের মানুষ এমনিতেই বেশ পিছিয়ে। তার ওপর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার যে পর্যায়ে নামিয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ আরো বেশি সঞ্চয়বিমুখ হবে। কস্ট অব ফান্ড কমে যাওয়ায় সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়বে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর প্রতিক্রিয়া হবে খুব খারাপ। ব্যাংকের ওপর আস্থা হারানো মানুষ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজবে। ফলে মানুষ আরো বেশি প্রতারণার শিকার হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মেয়াদি আমানতের সুদহারে গ্রাহকদের সাথে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রবঞ্চনা

আপডেট সময় : ০২:৩৯:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

প্রত্যাশা ডেস্ক : এদেশে কর্মরত বেসরকারি ব্যাংকগুলো বর্তমানে মেয়াদি আমানতের সুদহার সর্বনি¤েœ নামিয়ে এসেছে। যা গ্রাহকদের সাথে প্রবঞ্চনা। মহামারীর আগে যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ৬-৯ শতাংশ সুদ দিতো, তারাই এখন সুদহার দেড় শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অথচ করোনা মহামারী শুরু আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কিন্তু মহামারীতে সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ দেশের ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। বিনিয়োগ খরার কারণে দেশের মুদ্রাবাজারে অলস তারল্যের পাহাড় তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছে। বিগত ২০১৯ সালের জুনে ব্র্যাক ব্যাংক ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতো। ওই ব্র্যাক ব্যাংক এখন গ্রাহকদের একই মেয়াদের আমানতের জন্য মাত্র ১ দশমিক ৫০ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। ৬ মাস মেয়াদি আমানতের েেত্র এখন ব্র্যাক ব্যাংকের সুদহারই সবচেয়ে কম। তবে এ মুহূর্তে গ্রাহকদের ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ সুদ দিচ্ছে প্রাইম ব্যাংক। অথচ ২০১৯ সালের জুনেও ব্যাংকটি ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে মেয়াদি আমানতের সুদহার যে পর্যায়ে নেমেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনই দেখা যায়নি। মূলত বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ-খরা ও মহামারী সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অলস তারল্য। চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহার ৫০ পয়সার নিচে নেমেছে। বিনিয়োগের কোনো জায়গা না থাকার সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের বিকল্প কোনো উৎস না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংক টাকা রাখছে। ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সবচেয়ে কম সুদ দেয়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ইস্টার্ন, ডাচ্-বাংলা, যমুনা, শাহজালাল ইসলামী, দ্য সিটি, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ওই ব্যাংকগুলো আমানতের জন্য গ্রাহকদের সুদ দিচ্ছে দেড় থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ শতাংশ। নতুন ও দুর্বল ব্যাংকগুলো ছাড়া দেশের বেসরকারি অন্যান্য ব্যাংকও আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। অথচ করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদও ছিল ৬ শতাংশের বেশি।
সূত্র জানায়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ৭৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে মোট আমানত আছে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা। ৫ কোটি ৬২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে ওই আমানত জমা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতের ৪৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ হলো মেয়াদি আমানত। মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সময় ৩ মাস। অন্য সব শ্রেণীর আমানতের তুলনায় মেয়াদি আমানতের সুদহার সব সময়ই বেশি থাকে। সরকার ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য ২০১৮ সাল থেকে তৎপর হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় সুদহার বেঁধে দিয়ে ঋণ ও আমানতের সুদ কমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মুদ্রাবাজারে তারল্য সংকট থাকায় সুদহার নিয়ন্ত্রণের ওই তৎপরতা সফল হয়নি। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ কার্যকর হয়। আর ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়া হয় ৬ শতাংশ।
সূত্র আরো জানায়, সরকার ব্যাংকগুলোকে আমানত ও ঋণের জন্য যথাক্রমে ৬ ও ৯ শতাংশ হারে সুদহার বেঁধে দিয়েছে। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমাতে থাকে। পরবর্তী সময়ে করোনা সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ইতিহাসে সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকার স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ওসব প্যাকেজের প্রথম দফা ঋণ বিতরণও প্রায় শেষ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হিসেবে এটিই সর্বনিম্ন। অন্যদিকে ঋণ প্রবৃদ্ধির ভাটার বিপরীতে অলস তারল্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। ওই তারল্যের ৪৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ বা ৮৯ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা ছিল দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়। বিগত ২০১৯ সালের জুনে ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদে ৬ মাস মেয়াদি আমানত নিয়েছে দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। কিন্তু ওই ব্যাংকটি চলতি বছরের জুনে ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সিটি ব্যাংকে জমা আছে গ্রাহকদের প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার আমানত। বর্তমানে ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭৭ শতাংশে। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার সবচেয়ে কম। বর্তমানে ওই ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার আড়াই থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। রিটেইল ব্যাংকিংয়ে দাপট থাকায় আগে থেকেই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম ছিল। তারপরও ২০১৯ সালের জুনে ৬ মাস মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ব্যাংকটি গ্রাহকদের সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতো। বর্তমানে কোনো শ্রেণীর আমানতের জন্যই সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে না ডাচ্-বাংলা।
এদিকে ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, মেয়াদি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনাকে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা। দেশে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬ শতাংশ। ঢাকা শহরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশেরও বেশি। এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের যে সুদ দিচ্ছে তা প্রবঞ্চনার মধ্যে পড়ে। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রবঞ্চনার পরিণতি ভালো হবে না। দেশে বিনিয়োগের পরিস্থিতি উন্নত হলে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের এই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তখন ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীদের কাছেই যেতে হবে। পাশাপাশি ঋণের সুদহার বেশি হলে উদ্যোক্তারাও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। কারণ বিশ্বের কোথাও আমানত ও ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশের মতো সুদ পরিশোধ করা হয় না। বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংকগুলোয় বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোও আমানতের সুদহার কমিয়ে এনেছে। ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করলে বর্তমান পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ ও আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল প্রবীণ নাগরিকদের কথা চিন্তা করলে তা খুব খারাপ। এক সময় ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রেখে মাসে ১ হাজার টাকা পাওয়া যেতো। বর্তমানে দেশের ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে মেয়াদি আমানতে সবচেয়ে কম সুদ দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটি ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য সুদ দিচ্ছে দেড় থেকে আড়াই শতাংশ। যদিও ২০১৯ সালের জুনে ৬ মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক গ্রাহকদের ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করেছিল। বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরদের মতে, মেয়াদি আমানতের বর্তমান সুদহার মোটেই কাম্য হতে পারে না। বর্তমানে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশেরও বেশি। ব্যাংকগুলোর উচিত হবে মেয়াদি আমানতের সুদহার অন্তত মূল্যস্ফীতির বেশি দেয়া। সীমাতিরিক্ত তারল্যের কারণে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তপে জরুরি। তাছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মুদ্রাবাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বেসরকারি খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রণোদনার টাকা ছাড়া কোনো ব্যাংকই নতুন কোনো প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি ভালো লণ নয়। মুদ্রাবাজারের অতিরিক্ত তারল্য মূল্যস্ফীতিকেও উসকে দিচ্ছে। ঋণের চাহিদা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক হবে না। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে অতিরিক্ত তারল্যের এ চিত্র থাকবে না। বিনিয়োগ চাহিদা তৈরি হলে ব্যাংক খাতে আবারো তারল্য সংকট দেখা দেবে। তখন ব্যাংকগুলো আবারো বেশি সুদে আমানত নিতে বাধ্য হবে।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মাসরুর আরেফিন জানান, সঞ্চয়ের দিক থেকে এদেশের মানুষ এমনিতেই বেশ পিছিয়ে। তার ওপর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার যে পর্যায়ে নামিয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ আরো বেশি সঞ্চয়বিমুখ হবে। কস্ট অব ফান্ড কমে যাওয়ায় সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়বে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর প্রতিক্রিয়া হবে খুব খারাপ। ব্যাংকের ওপর আস্থা হারানো মানুষ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজবে। ফলে মানুষ আরো বেশি প্রতারণার শিকার হবে।