ঢাকা ০৪:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা

  • আপডেট সময় : ০২:৪৭:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৩
  • ৬৫ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পুড়ে ছাই হয়েছে ৫ হাজারের বেশি দোকান। ছাইয়ে মিশে গেছে ঈদকে ঘিরে তোলা নতুন পোশাক। এতে ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার। একেবারে পথে বসে গেছেন অনেক ব্যবসায়ী। এ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবাজার মার্কেটজুড়ে এখন শুধুই পোড়া গন্ধ। পুড়ে যাওয়া মার্কেটে এখনও বিক্ষিপ্তভাবে ধোঁয়া উড়ছে। অগ্নিকা-ের পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পানি ছিটানো অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সামনে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। রাস্তার বিপরীত দিকে ঘটনাস্থলে পুড়ে যাওয়া দোকান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন দোকান মালিকরা। কেউ কেউ বলছেন, ‘এতদিনের লালিত স্বপ্ন, জীবনযাপনের সম্বল শেষ হয়ে গেল।’ যেসব স্থানে আগুন লাগলেও পুরোপুরি পুড়িয়ে ফেলেনি, সেখান থেকে মালামাল উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সিঁড়ি দিয়ে নামাতে ঝামেলার কারণে অনেকে ওপর তলা থেকে বস্তা ভরে নিচে ফেলছেন মালামাল। সেখান থেকে বাকিরা উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে রাখছেন।
কাঠের তৈরি যেসব মার্কেটে আগুন লেগে দোকান পুরোপুরি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, সেসব স্থানে থাকা বিভিন্ন টিন, লোহার অংশসহ আরও সরঞ্জামাদি লোকজন তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও তাদের বাধা দিচ্ছেন না। আশাহত ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুনে কোটি কোটি টাকা নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো দিয়ে আর কী করব? তবে এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আবার উঠে দাঁড়াতে চান ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা যদি পর্যাপ্ত সহযোগিতা করে, তবে তারা দ্রুতই উঠে দাঁড়াতে পারবেন। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে নিজেদের দোকান খুঁজছে দোকানের মালিকরা। ‘এইখানে আমার দোকান ছিল, ওইখানে আমার দোকান ছিল’ এমন আলাপ কতক্ষণ পর পরই ভেসে আসছিল। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বঙ্গবাজার মার্কেটের ইফতি ফ্যাশন দোকানের মালিক ইমাজউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দাবি হচ্ছে, আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমাদের কিচ্ছু নাই। আমাদের চলার মতো এবিলিটি নাই এখন আর। আমরা রাস্তার ফকির হয়া গেছি। আমাদের বউ-বাচ্চা সবাই এখন না খেয়ে মারা যাবে। এত পরিমাণ ঋণ, ধার, লোন নেওয়া সেগুলো পরিশোধ কীভাবে করব। কীভাবে উঠে দাঁড়াবো সে উপায় নেই আমাদের।’
নিজের দোকানের জায়গায় দাঁড়িয়ে সিয়াম গার্মেন্টসের মালিক সবুজ মিয়া কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা তো নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন কী করবো আমরা। আপনাকে কী বলবো, বলার মতো ভাষা নাই। যা ছিল সব শেষ, একটা কিছুও বের করতে পারিনি।’ শম্পা ফ্যাশনের দোকানি শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের বলা হচ্ছে নোটিশ দেওয়া হয়েছে আগে। আমরা কোনো নোটিশ পাইনি। সরকার যদি নোটিশ দেয় তাহলে পাবলিক থাকতে পারে মার্কেটে? এই ঈদ সিজনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করছি আমরা। দোকানে মাল তুলেছি অনেক ধার করে, অর্ধেক টাকা দিয়ে মাল নিয়ে আসছি গোডাউন থেকে। এখন এসব শোধ করবো কেমনে? উঠে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।’ বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং এনেক্সকো টাওয়ারের পরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থা যদি আমাদের দিকে একটু মনোযোগ দেয়, তাহলে আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে উঠতে পারব।’ আগুনে কত ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কিছু সিটি করপোরেশনের মার্কেট আছে। আবার ব্যক্তিমালিকানার মার্কেট আছে। তাই সব হিসাব করে মোট সংখ্যা বলতে আমাদের একটু সময় লাগবে।’ নাজমুল হুদা বলেন, ‘আমাদের এই মার্কেট ঘিরে তিনটা গোষ্ঠী। একটি পক্ষ হলো- যারা আমরা ব্যবসা করি, আরেকটা কর্মচারী। তৃতীয়টা হলো পাওনাদার, যারা আমাদের মালামাল দেন, তারাও কিন্তু আজকে ক্ষতির সম্মুখীন। তারা ভাবছেন যে কীভাবে আবার ব্যবসাটা দাঁড়াবে, তারা কীভাবে তাদের পাওনা পাবেন।’ এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ঈদ নিয়ে আমাদের যে আয়োজন সেখানেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সব বেসামাল হয়ে গেছে। আমরা সবার সহযোগিতা চাই। এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, মানবিক বিষয়। আমরা রাত-দিন পরিশ্রম করব। ভুল থাকলে সংশোধন করব।’ বঙ্গবাজার মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে বারবার সাবধান করা হয়েছে। সামনে সতর্ক হবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি, একটা ধারাবাহিক অবস্থা এসেছে। সেটা নির্ভরযোগ্য অবস্থা। পূর্বে আমরা মাঠে থেকেছি। এটা একটা ঐতিহ্যবাহী মার্কেট। এটা ভেঙে দিলে আমরা দুই তিন বছরের মধ্যে পুনর্বাসিত হয়ে যেতে চাই। বিলম্ব হলে তো আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। তবে বর্তমান মেয়র (শেখ ফজলে নূর তাপস) সিটি করপোরেশনের কাজগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করে দেখাচ্ছেন। তাকে নির্ভরযোগ্য অভিভাবক হিসেবে আমরা মনে করি। তিনি যদি পদক্ষেপ নেন আমরা তার সঙ্গে থাকব। আমরা বিরুদ্ধাচরণ করতে চাই না। তার নেতৃত্বে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব সেটি দেখতে চাই।’ বঙ্গবাজার মার্কেটের হকার আবু তাহের বলেন, ‘আমাদের দাবি, আমাদের দোকান করার সুযোগ দিক। এই স্থান পরিষ্কার করে যে যেভাবে পারে তাকে দোকান করতে দেয়া হোক। এরপর সরকার এটাকে বিল্ডিং বা মার্কেট করুক, এতে আমাদের আপত্তি নেই। সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যেন ছেলেমেয়ে নিয়ে একটু খেতে পারে, সরকার যেন তাদের একটু সহযোগিতা করে। সহযোগিতা করলে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। অন্যথায় তারা দুশ্চিন্তায় আরও নিঃস্ব হয়ে যাবে। অনেকে হার্ট অ্যাটাকও করতে পারে।’
এদিকে বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাহায্যে ব্যাংক এবং বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। গতকাল নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে ড. আতিউর এফবিসিসিআই, এমসিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ সকল বাণিজ্য সংগঠন এবং ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাহায্যের আহ্বান জানান। ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে গেছে হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার স্বপ্ন। তাদের দোকানের সেসব গরিব কর্মচারীদের কী দুরবস্থা তা ভাবতেও গা শিওরে ওঠে। ক্ষতিগ্রস্ত এই ব্যবসায়ীদের চরম বিপদে আমি দারুণ ব্যথিত। সামনে ঈদ। খুশির ঈদকে সামনে রেখে নিশ্চই তারা তাদের নিজেদের এবং ধার করে অর্থ যোগাড় করে দোকান সাজিয়েছিল। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল তাদের সব স্বপ্ন। এই অগ্নিকা- আবার প্রমাণ করল আমরা আগুনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং প্রতিষ্ঠানিকভাবে কতোই না দুর্বল। বারে বারে আগুন লাগছে ব্যবসা কেন্দ্রে। কিন্তু কিছুতেই ঠেকাতে পারছি না। এ যেন নিয়তি! সমাজকে এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল অংশিজনকে তাই আরও সচেতন ও পেশাদারি হতে হবে। তা না হলে এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা পাওয়া বেশ মুশকিল হবে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আজ আমাদের কী করা উচিত? সরকার নিশ্চই তার সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তাদের দরকার পুঁজি। আমাদের ব্যাংক ও অন্যান্য করপোরেটের এই মুহূর্তে সামাজিক দায়বদ্ধতার সর্বোচ্চ অঙ্গীকার দেখাতে হবে। তাদের সিএসআর তহবিল থেকে এদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এফবিসিসিআই, এমসিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ সকল বাণিজ্য সংগঠনগুলোর কাছে বিনীত আহ্বান জানাই তারা যেন উদার হস্তে এই অসাহায় উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য তাদের সকল সদস্যদের প্রতি উদাত্ত আবেদন জানান।’ ঢাকার দুই মেয়রের উদ্দেশে ড. আতিউর লেখেন, ‘ঢাকার মেয়রদের এই দুর্যোগের সময় মানবিক অনেক কিছুই করার আছে। আমাদের বড়ো এনজিওদেরও এই দুঃসময়ে অসহায় ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু একটা করার আহ্বান জানাই। তাদের পুনর্বাসনে সমাজের সকল অংশকেই এগিয়ে আসতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতিই এই আবেদন। আগুনে ভস্মিভূত হওয়া দোকানের বিপর্যস্ত মালিক ও কর্মীদের জন্য জানাই আমার অন্তরের গভীরতম সমবেদনা। আমরা রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর সামাজিক পুঁজির এক বিস্ফোরণ দেখেছিল। ব্যাংকগুলোর সিএসআর তহবিলের অর্থ দিয়ে আমরা আহত-নিহতকর্মীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বড়ো উদ্যোগ নিতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয় মানবিক সেই উদ্যোগের পুনরাবৃত্তি করতে সক্ষম।’ উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার অন্যতম বড় পোশাক মার্কেট বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একে একে অর্ধশত ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। তাদের সঙ্গে পুলিশ, র‌্যাব, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভয়াবহ এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা

আপডেট সময় : ০২:৪৭:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পুড়ে ছাই হয়েছে ৫ হাজারের বেশি দোকান। ছাইয়ে মিশে গেছে ঈদকে ঘিরে তোলা নতুন পোশাক। এতে ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার। একেবারে পথে বসে গেছেন অনেক ব্যবসায়ী। এ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবাজার মার্কেটজুড়ে এখন শুধুই পোড়া গন্ধ। পুড়ে যাওয়া মার্কেটে এখনও বিক্ষিপ্তভাবে ধোঁয়া উড়ছে। অগ্নিকা-ের পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পানি ছিটানো অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সামনে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। রাস্তার বিপরীত দিকে ঘটনাস্থলে পুড়ে যাওয়া দোকান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন দোকান মালিকরা। কেউ কেউ বলছেন, ‘এতদিনের লালিত স্বপ্ন, জীবনযাপনের সম্বল শেষ হয়ে গেল।’ যেসব স্থানে আগুন লাগলেও পুরোপুরি পুড়িয়ে ফেলেনি, সেখান থেকে মালামাল উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সিঁড়ি দিয়ে নামাতে ঝামেলার কারণে অনেকে ওপর তলা থেকে বস্তা ভরে নিচে ফেলছেন মালামাল। সেখান থেকে বাকিরা উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে রাখছেন।
কাঠের তৈরি যেসব মার্কেটে আগুন লেগে দোকান পুরোপুরি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, সেসব স্থানে থাকা বিভিন্ন টিন, লোহার অংশসহ আরও সরঞ্জামাদি লোকজন তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও তাদের বাধা দিচ্ছেন না। আশাহত ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুনে কোটি কোটি টাকা নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো দিয়ে আর কী করব? তবে এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আবার উঠে দাঁড়াতে চান ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা যদি পর্যাপ্ত সহযোগিতা করে, তবে তারা দ্রুতই উঠে দাঁড়াতে পারবেন। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে নিজেদের দোকান খুঁজছে দোকানের মালিকরা। ‘এইখানে আমার দোকান ছিল, ওইখানে আমার দোকান ছিল’ এমন আলাপ কতক্ষণ পর পরই ভেসে আসছিল। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বঙ্গবাজার মার্কেটের ইফতি ফ্যাশন দোকানের মালিক ইমাজউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দাবি হচ্ছে, আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমাদের কিচ্ছু নাই। আমাদের চলার মতো এবিলিটি নাই এখন আর। আমরা রাস্তার ফকির হয়া গেছি। আমাদের বউ-বাচ্চা সবাই এখন না খেয়ে মারা যাবে। এত পরিমাণ ঋণ, ধার, লোন নেওয়া সেগুলো পরিশোধ কীভাবে করব। কীভাবে উঠে দাঁড়াবো সে উপায় নেই আমাদের।’
নিজের দোকানের জায়গায় দাঁড়িয়ে সিয়াম গার্মেন্টসের মালিক সবুজ মিয়া কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা তো নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন কী করবো আমরা। আপনাকে কী বলবো, বলার মতো ভাষা নাই। যা ছিল সব শেষ, একটা কিছুও বের করতে পারিনি।’ শম্পা ফ্যাশনের দোকানি শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের বলা হচ্ছে নোটিশ দেওয়া হয়েছে আগে। আমরা কোনো নোটিশ পাইনি। সরকার যদি নোটিশ দেয় তাহলে পাবলিক থাকতে পারে মার্কেটে? এই ঈদ সিজনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করছি আমরা। দোকানে মাল তুলেছি অনেক ধার করে, অর্ধেক টাকা দিয়ে মাল নিয়ে আসছি গোডাউন থেকে। এখন এসব শোধ করবো কেমনে? উঠে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।’ বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং এনেক্সকো টাওয়ারের পরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থা যদি আমাদের দিকে একটু মনোযোগ দেয়, তাহলে আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে উঠতে পারব।’ আগুনে কত ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কিছু সিটি করপোরেশনের মার্কেট আছে। আবার ব্যক্তিমালিকানার মার্কেট আছে। তাই সব হিসাব করে মোট সংখ্যা বলতে আমাদের একটু সময় লাগবে।’ নাজমুল হুদা বলেন, ‘আমাদের এই মার্কেট ঘিরে তিনটা গোষ্ঠী। একটি পক্ষ হলো- যারা আমরা ব্যবসা করি, আরেকটা কর্মচারী। তৃতীয়টা হলো পাওনাদার, যারা আমাদের মালামাল দেন, তারাও কিন্তু আজকে ক্ষতির সম্মুখীন। তারা ভাবছেন যে কীভাবে আবার ব্যবসাটা দাঁড়াবে, তারা কীভাবে তাদের পাওনা পাবেন।’ এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ঈদ নিয়ে আমাদের যে আয়োজন সেখানেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সব বেসামাল হয়ে গেছে। আমরা সবার সহযোগিতা চাই। এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, মানবিক বিষয়। আমরা রাত-দিন পরিশ্রম করব। ভুল থাকলে সংশোধন করব।’ বঙ্গবাজার মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে বারবার সাবধান করা হয়েছে। সামনে সতর্ক হবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি, একটা ধারাবাহিক অবস্থা এসেছে। সেটা নির্ভরযোগ্য অবস্থা। পূর্বে আমরা মাঠে থেকেছি। এটা একটা ঐতিহ্যবাহী মার্কেট। এটা ভেঙে দিলে আমরা দুই তিন বছরের মধ্যে পুনর্বাসিত হয়ে যেতে চাই। বিলম্ব হলে তো আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। তবে বর্তমান মেয়র (শেখ ফজলে নূর তাপস) সিটি করপোরেশনের কাজগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করে দেখাচ্ছেন। তাকে নির্ভরযোগ্য অভিভাবক হিসেবে আমরা মনে করি। তিনি যদি পদক্ষেপ নেন আমরা তার সঙ্গে থাকব। আমরা বিরুদ্ধাচরণ করতে চাই না। তার নেতৃত্বে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব সেটি দেখতে চাই।’ বঙ্গবাজার মার্কেটের হকার আবু তাহের বলেন, ‘আমাদের দাবি, আমাদের দোকান করার সুযোগ দিক। এই স্থান পরিষ্কার করে যে যেভাবে পারে তাকে দোকান করতে দেয়া হোক। এরপর সরকার এটাকে বিল্ডিং বা মার্কেট করুক, এতে আমাদের আপত্তি নেই। সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যেন ছেলেমেয়ে নিয়ে একটু খেতে পারে, সরকার যেন তাদের একটু সহযোগিতা করে। সহযোগিতা করলে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। অন্যথায় তারা দুশ্চিন্তায় আরও নিঃস্ব হয়ে যাবে। অনেকে হার্ট অ্যাটাকও করতে পারে।’
এদিকে বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাহায্যে ব্যাংক এবং বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। গতকাল নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে ড. আতিউর এফবিসিসিআই, এমসিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ সকল বাণিজ্য সংগঠন এবং ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাহায্যের আহ্বান জানান। ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে গেছে হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার স্বপ্ন। তাদের দোকানের সেসব গরিব কর্মচারীদের কী দুরবস্থা তা ভাবতেও গা শিওরে ওঠে। ক্ষতিগ্রস্ত এই ব্যবসায়ীদের চরম বিপদে আমি দারুণ ব্যথিত। সামনে ঈদ। খুশির ঈদকে সামনে রেখে নিশ্চই তারা তাদের নিজেদের এবং ধার করে অর্থ যোগাড় করে দোকান সাজিয়েছিল। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল তাদের সব স্বপ্ন। এই অগ্নিকা- আবার প্রমাণ করল আমরা আগুনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং প্রতিষ্ঠানিকভাবে কতোই না দুর্বল। বারে বারে আগুন লাগছে ব্যবসা কেন্দ্রে। কিন্তু কিছুতেই ঠেকাতে পারছি না। এ যেন নিয়তি! সমাজকে এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল অংশিজনকে তাই আরও সচেতন ও পেশাদারি হতে হবে। তা না হলে এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা পাওয়া বেশ মুশকিল হবে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আজ আমাদের কী করা উচিত? সরকার নিশ্চই তার সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তাদের দরকার পুঁজি। আমাদের ব্যাংক ও অন্যান্য করপোরেটের এই মুহূর্তে সামাজিক দায়বদ্ধতার সর্বোচ্চ অঙ্গীকার দেখাতে হবে। তাদের সিএসআর তহবিল থেকে এদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এফবিসিসিআই, এমসিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ সকল বাণিজ্য সংগঠনগুলোর কাছে বিনীত আহ্বান জানাই তারা যেন উদার হস্তে এই অসাহায় উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য তাদের সকল সদস্যদের প্রতি উদাত্ত আবেদন জানান।’ ঢাকার দুই মেয়রের উদ্দেশে ড. আতিউর লেখেন, ‘ঢাকার মেয়রদের এই দুর্যোগের সময় মানবিক অনেক কিছুই করার আছে। আমাদের বড়ো এনজিওদেরও এই দুঃসময়ে অসহায় ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু একটা করার আহ্বান জানাই। তাদের পুনর্বাসনে সমাজের সকল অংশকেই এগিয়ে আসতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতিই এই আবেদন। আগুনে ভস্মিভূত হওয়া দোকানের বিপর্যস্ত মালিক ও কর্মীদের জন্য জানাই আমার অন্তরের গভীরতম সমবেদনা। আমরা রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর সামাজিক পুঁজির এক বিস্ফোরণ দেখেছিল। ব্যাংকগুলোর সিএসআর তহবিলের অর্থ দিয়ে আমরা আহত-নিহতকর্মীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বড়ো উদ্যোগ নিতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয় মানবিক সেই উদ্যোগের পুনরাবৃত্তি করতে সক্ষম।’ উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার অন্যতম বড় পোশাক মার্কেট বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একে একে অর্ধশত ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। তাদের সঙ্গে পুলিশ, র‌্যাব, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভয়াবহ এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।