ঢাকা ১১:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

স্কুলের অভিভাবক সভায় আপনি কী বলেছেন?

  • আপডেট সময় : ১০:৪৬:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ মার্চ ২০২৩
  • ১৫৭ বার পড়া হয়েছে

আমীন আল রশীদ : আমার মেয়ে রাজধানীর একটি মোটামুটি নামকরা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। করোনার দুই বছর অনলাইন ক্লাস এবং শেষদিকে অল্প কিছু দিন শারীরিক উপস্থিতির কারণে অভিভাবকদের সঙ্গে শ্রেণি শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের কোনও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। ফলে করোনার পরে এই প্রথম অভিভাবক সভা। সেখানে অভিভাবক ও শিক্ষকরা কী বললেন এবং কী বললেন না; কী বলা উচিত ছিল এবং এই বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতি ও পরিকল্পনাগুলো কী—সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার জন্য এই লেখা।
যে স্কুলটির কথা বলছি সেখানে রাজধানীর আর দশটি বেসরকারি স্কুলের তুলনায় পড়ালেখার চাপ কম। পরিবেশ ভালো। শিক্ষকদের আচরণ নিয়ে বড় কোনও অভিযোগ নেই। বেতন ও অন্যান্য খরচও খুব বেশি নয়। কিন্তু তারপরও অভিভাবকদের সভায় মোটা দাগে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো এরকম:
১. যেহেতু করোনার দুই বছরে শিশুদের পড়াশোনায় একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে এবং সেই শূন্যতা কাঁধে নিয়েই তারা পরের ক্লাসে উঠে গেছে, ফলে এখন সিলেবাসের অনেক কিছুই তাদের কাছে বাড়তি বোঝা। অনেক বিষয় তারা বুঝতে পারে না। আত্মস্থ করতে পারে না।
২. স্কুলব্যাগে কতগুলো বই ও খাতা দিয়ে দিতে হবে, সে বিষয়ে অনেকে পরিষ্কার নন। ফলে বাধ্য হয়ে সব বই ও খাতা ব্যাগে দিয়ে দেন, যাতে ব্যাগটা অনেক ভারী হয়ে যায়, যে ভারী ব্যাগ নিয়ে শিশুদের পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলা চারতলায় ওঠানামা অনেক কঠিন। ছুটির সময় একসঙ্গে সব শিশু হৈ হুল্লোড় করতে করতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে যায়, তখন পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওই ভারী ব্যাগ নিয়ে কেউ কেউ পড়ে আহতও হয়।
৩. শ্রেণি শিক্ষক প্রতিদিনই বোর্ডে অনেক লেখা তুলে দেন, যেগুলো দেখে শিশুদের খাতায় তুলতে হয়। কিন্তু লেখার পরিমাণ এত বেশি থাকে যে শিশুরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওগুলো তুলতে পারে না। বিশেষ করে কোনও ক্লাসে যখন ৫০-৬০ জন শিশু থাকে এবং তাদের মধ্যে যারা পেছনের দিকে বসে, তারা ঠিকমতো বোর্ডে লেখা দেখতে না পেয়ে সময় মতো লিখতে পারে না। ফলে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে। আবার পিছিয়ে থাকা শিশুদের প্রত্যেককে ধরে ধরে যে শ্রেণি শিক্ষক পড়া বুঝিয়ে দেবেন, সেটিও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, শিক্ষককেও নির্ধারিত সময়ে ক্লাস ছেড়ে দিতে হয় পরবর্তী ক্লাসের জন্য।

৪. স্কুলের বেতন হঠাৎ করেই বাড়ানো হয়েছে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই। নানা কারণে স্কুলের খরচ বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু যাদের সন্তানরা স্কুলে পড়েন, সেই অভিভাবক সবার আয় কি বেড়েছে? বরং করোনার দুই বছরে অনেকের আয় কমেছে, এমনকি অনেকে বেকারও হয়েছেন। আবার সবার পক্ষে সরকারি স্কুলে সন্তানকে পড়ানো সম্ভব হয় না সামাজিক নানা কারণেই।
৫. অনেক অভিভাবক শ্রেণি শিক্ষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রেণির অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। এজন্য অভিভাবকদের সঙ্গে শ্রেণি শিক্ষকের কথা বলার জন্য সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখা যায়, যেখানে আগ্রহী অভিভাবকরা উপস্থিত থাকবেন।
এ রকম আরও নানা বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু একজন দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য কতগুলো বই প্রয়োজন; এই বয়সে পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপে তার কাছে পড়ালেখা আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে কিনা; স্কুলটি তার কাছে আনন্দের বদলে ভীতিকর স্থানে পরিণত হচ্ছে কিনা—সেই বিষয়ে যতটা খোলামেলা আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। তবে একটা বিষয় ভালো যে পাঠদান ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন আনছে। বিশেষ করে শিশুদের কাজের মধ্য দিয়ে শেখানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। সেইসাথে স্কুলে শাসন করা যাবে না বলেও সরকারের নীতি রয়েছে। কিন্তু এর অন্য বাস্তবতাও আছে। যেমন, ঢাকা শহরের ‘কংক্রিটের বস্তিতে’ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের যেরকম ‘ব্রয়লার মুরগির’ মতো গড়ে তোলেন, তাতে শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষক যদি একটু ধমক দেন কিংবা প্রয়োজনে একটা চড় দেন অথবা টেবিলে লাঠি অথবা স্কেল দিয়ে শব্দ করেন, সেটিও অনেক সময় ওই আদুরে সন্তানদের জন্য নির্যাতন হিসেবে দেখা হয়।
অনেক সময় অভিভাবকরা এটার প্রতিবাদ করেন। অথচ শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, তাকে শেখানোর প্রয়োজনে শাস্তির অনুমোদন যুগে যুগে ছিল। শাস্তির ধরন কী হবে, একুশ শতকের চিন্তাভাবনার সঙ্গে সেটি মিলছে কিনা—এসবও দেখার বিষয়। কিন্তু অভিভাবকদেরও এটা মনে রাখতে হবে যে যখন তার সন্তান স্কুলের গেটের ভেতরে প্রবেশ করলো, তখন তার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষকই তার সন্তানের প্রকৃত জন্মদাতা। অতএব, তাকে শাসন করার অধিকার শিক্ষকের থাকতে হবে। এখানে অমুকের ছেলেকে শিক্ষক বকা দিয়েছে, তমুকের মেয়ের দিকে শিক্ষক চোখ রাঙিয়েছে—এসব বাহাদুরি না দেখানোই ভালো। শিক্ষকের কাছে তার সব শিক্ষার্থীই সমান।
অনেক অভিভাবকের মধ্যে এরকম একটি ধারণা আছে যে বেশি পড়াশোনার চাপ আর বেশি বেশি পরীক্ষা মানেই ভালো স্কুল। অথচ শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে বলাই হয় যে সে আনন্দের মধ্য দিয়ে শিখবে। পড়ালেখা ও পরীক্ষা যখন তার কাছে আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হবে, তখন সে অনেক কিছু মুখস্থ করবে ঠিকই, কিন্তু কিছুই শিখবে না। সে অনেক কিছু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতা ভরে ফেলবে, কিন্তু জীবনে ওই শিক্ষা তার ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়ার ডিম’ই হবে। সে নিজের দেশকে চিনবে না। সে জানবে না নদীর প্রতি তার কী দায়। তার দেশের প্রতি কী কর্তব্য। সে শুধু পরীক্ষাই দেবে।

‘আমার ছেলেটা তো নিজের প্লেটটাও ধোয় না’—অনেক অভিভাবক এই ধরনের কথাবার্তা বলে একধরনের আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করেন। অথচ তারা খেয়াল করেন না যে এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের সন্তানদের স্বার্থপর ও অলস করে গড়ে তুলছেন। এই সন্তান বড় হয়ে নিজের কাজটা নিজে না করে অন্যকে দিয়ে করাতে চাইবে। নিজের নিত্যদিনকার কাজের জন্য সে তিন জন কাজের লোক রাখবে। সে তার বিলাসী জীবনযাপন নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ ও অনৈতিক নানা পথে পা বাড়াবে—অভিভাবক সভায় এই কথাগুলো অনেক বেশি আলোচিত হওয়া দরকার।
এই ধরনের সভায় শিক্ষকদেরও বলা উচিত যে তারা তাদের সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার্থী নয়, বরং শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করেন। শিক্ষকদের বলা উচিত, শিশু বয়সে সিলেবাস মুখস্থ করা আর বোর্ডে তুলে দেওয়া লেখাগুলো নির্ধারিত সময়ে লিখতে পারা এবং বছর শেষে পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়; বরং একজন মানবিক, সংবেদনশীল, দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠাই একজন শিশুর প্রধান দায়িত্ব; আর সেই দায়িত্ব পালনে সবচেয় বড় ভূমিকা যে শিক্ষকদেরই—সেই উপলব্ধিটা শিক্ষকদের মধ্যে আসা দরকার। শিশু বয়স থেকেই নিজের টয়লেট নিজের পরিষ্কার করা, এমনকি স্কুলের টয়লেটও যে পালাক্রমে নিজেদের পরিষ্কার করা দরকার; নিজের ময়লা- জামাকাপড় ধোয়ার হাতেখড়ি যে শৈশবেই দেওয়া দরকার; অন্যের কাঁধে পাড়া দিয়ে উপরে ওঠার নামই যে সাফল্য নয়; অবৈধ উপায়ে টাকা কামাই করে বহুতল বাড়ি নির্মাণই যে উন্নয়ন নয়—সেই বোধটুকু শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার মূল দায়িত্বটি শিক্ষকের।
মনে রাখা দরকার, শিশুরা বাবা মায়ের চেয়ে শিক্ষকের কথাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। শিক্ষকের কথাকে তারা অবশ্য পালনীয় মনে করে। শিক্ষক ভুল পড়ালেও সে ওটাকেই সঠিক মনে করে। সুতরাং মানস গঠনে বাবা মায়ের চেয়ে শিক্ষকের দায়িত্ব বেশি। যে কারণে বলা হয়, বাবা-মা হচ্ছেন জনক, মানে জন্মদাতা। আর শিক্ষক হচ্ছেন পিতা। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা নিজেদের সেরকম ‘পিতা’ বা প্রকৃত জন্মদাতা মনে করেন কিনা; তাদের নিজেদের মধ্যে এই উপলব্ধিটা আছে কিনা; তারা ছাত্রছাত্রীদের নিতান্তই পরীক্ষার্থী মনে করেন নাকি শিক্ষার্থী; তাদের দিয়ে ভারী বই পড়িয়ে মুখস্থ করিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়া নিশ্চিত করাটাই শিক্ষকদের জীবনের মূল লক্ষ্য কিনা; তাদের ছাত্রজীবনে জিপিএযোদ্ধা এবং তারপরে বিসিএসযোদ্ধা বানানোই শিক্ষকদের প্রধান কাজ কিনা—সেটি বিরাট প্রশ্ন।
এই প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কতটা সৎ, মানবিক ও দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখতে চায়, এর ওপর নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপদ্ধতি। রাষ্ট্র যদি মনে করে শিক্ষা মানেই টাকা কামানোর তরিকা; নাগরিক মানেই সে শুধু উৎপাদন করবে এবং সেই উৎপাদন করতে গিয়ে সে নিজের দেশের মানুষকে ঠকাচ্ছে কিনা; সে নিজের দেশের নদী-খাল-বিল-জলাশয়-বন-পাহাড় ধ্বংস করে ফেলছে কিনা—সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। রাষ্ট্র যদি মনে করে একজন নাগরিক রাষ্ট্রের সবকিছু বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়ে শুধু ভালো জিনিসের প্রশংসাই করতে থাকবে এবং সে খারাপ কোনও কাজের সমালোচনা করতে পারবে না, তাহলে শিক্ষকরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের মনে দেশপ্রেম ও মানবিকতার বোধ যতই জাগ্রত করার চেষ্টা করুন না কেন, আখেরে সবাই ওই জিপিএ এবং বিসিএসযোদ্ধাতেই পরিণত হবে।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

আনিস আলমগীরকে গ্রেফতার স্বৈরাচারী আমলে সাংবাদিক দমন-পীড়নের স্মৃতি উসকে দেয়

স্কুলের অভিভাবক সভায় আপনি কী বলেছেন?

আপডেট সময় : ১০:৪৬:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ মার্চ ২০২৩

আমীন আল রশীদ : আমার মেয়ে রাজধানীর একটি মোটামুটি নামকরা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। করোনার দুই বছর অনলাইন ক্লাস এবং শেষদিকে অল্প কিছু দিন শারীরিক উপস্থিতির কারণে অভিভাবকদের সঙ্গে শ্রেণি শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের কোনও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। ফলে করোনার পরে এই প্রথম অভিভাবক সভা। সেখানে অভিভাবক ও শিক্ষকরা কী বললেন এবং কী বললেন না; কী বলা উচিত ছিল এবং এই বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতি ও পরিকল্পনাগুলো কী—সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার জন্য এই লেখা।
যে স্কুলটির কথা বলছি সেখানে রাজধানীর আর দশটি বেসরকারি স্কুলের তুলনায় পড়ালেখার চাপ কম। পরিবেশ ভালো। শিক্ষকদের আচরণ নিয়ে বড় কোনও অভিযোগ নেই। বেতন ও অন্যান্য খরচও খুব বেশি নয়। কিন্তু তারপরও অভিভাবকদের সভায় মোটা দাগে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো এরকম:
১. যেহেতু করোনার দুই বছরে শিশুদের পড়াশোনায় একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে এবং সেই শূন্যতা কাঁধে নিয়েই তারা পরের ক্লাসে উঠে গেছে, ফলে এখন সিলেবাসের অনেক কিছুই তাদের কাছে বাড়তি বোঝা। অনেক বিষয় তারা বুঝতে পারে না। আত্মস্থ করতে পারে না।
২. স্কুলব্যাগে কতগুলো বই ও খাতা দিয়ে দিতে হবে, সে বিষয়ে অনেকে পরিষ্কার নন। ফলে বাধ্য হয়ে সব বই ও খাতা ব্যাগে দিয়ে দেন, যাতে ব্যাগটা অনেক ভারী হয়ে যায়, যে ভারী ব্যাগ নিয়ে শিশুদের পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলা চারতলায় ওঠানামা অনেক কঠিন। ছুটির সময় একসঙ্গে সব শিশু হৈ হুল্লোড় করতে করতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে যায়, তখন পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওই ভারী ব্যাগ নিয়ে কেউ কেউ পড়ে আহতও হয়।
৩. শ্রেণি শিক্ষক প্রতিদিনই বোর্ডে অনেক লেখা তুলে দেন, যেগুলো দেখে শিশুদের খাতায় তুলতে হয়। কিন্তু লেখার পরিমাণ এত বেশি থাকে যে শিশুরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওগুলো তুলতে পারে না। বিশেষ করে কোনও ক্লাসে যখন ৫০-৬০ জন শিশু থাকে এবং তাদের মধ্যে যারা পেছনের দিকে বসে, তারা ঠিকমতো বোর্ডে লেখা দেখতে না পেয়ে সময় মতো লিখতে পারে না। ফলে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে। আবার পিছিয়ে থাকা শিশুদের প্রত্যেককে ধরে ধরে যে শ্রেণি শিক্ষক পড়া বুঝিয়ে দেবেন, সেটিও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, শিক্ষককেও নির্ধারিত সময়ে ক্লাস ছেড়ে দিতে হয় পরবর্তী ক্লাসের জন্য।

৪. স্কুলের বেতন হঠাৎ করেই বাড়ানো হয়েছে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই। নানা কারণে স্কুলের খরচ বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু যাদের সন্তানরা স্কুলে পড়েন, সেই অভিভাবক সবার আয় কি বেড়েছে? বরং করোনার দুই বছরে অনেকের আয় কমেছে, এমনকি অনেকে বেকারও হয়েছেন। আবার সবার পক্ষে সরকারি স্কুলে সন্তানকে পড়ানো সম্ভব হয় না সামাজিক নানা কারণেই।
৫. অনেক অভিভাবক শ্রেণি শিক্ষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রেণির অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। এজন্য অভিভাবকদের সঙ্গে শ্রেণি শিক্ষকের কথা বলার জন্য সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখা যায়, যেখানে আগ্রহী অভিভাবকরা উপস্থিত থাকবেন।
এ রকম আরও নানা বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু একজন দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য কতগুলো বই প্রয়োজন; এই বয়সে পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপে তার কাছে পড়ালেখা আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে কিনা; স্কুলটি তার কাছে আনন্দের বদলে ভীতিকর স্থানে পরিণত হচ্ছে কিনা—সেই বিষয়ে যতটা খোলামেলা আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। তবে একটা বিষয় ভালো যে পাঠদান ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন আনছে। বিশেষ করে শিশুদের কাজের মধ্য দিয়ে শেখানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। সেইসাথে স্কুলে শাসন করা যাবে না বলেও সরকারের নীতি রয়েছে। কিন্তু এর অন্য বাস্তবতাও আছে। যেমন, ঢাকা শহরের ‘কংক্রিটের বস্তিতে’ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের যেরকম ‘ব্রয়লার মুরগির’ মতো গড়ে তোলেন, তাতে শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষক যদি একটু ধমক দেন কিংবা প্রয়োজনে একটা চড় দেন অথবা টেবিলে লাঠি অথবা স্কেল দিয়ে শব্দ করেন, সেটিও অনেক সময় ওই আদুরে সন্তানদের জন্য নির্যাতন হিসেবে দেখা হয়।
অনেক সময় অভিভাবকরা এটার প্রতিবাদ করেন। অথচ শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, তাকে শেখানোর প্রয়োজনে শাস্তির অনুমোদন যুগে যুগে ছিল। শাস্তির ধরন কী হবে, একুশ শতকের চিন্তাভাবনার সঙ্গে সেটি মিলছে কিনা—এসবও দেখার বিষয়। কিন্তু অভিভাবকদেরও এটা মনে রাখতে হবে যে যখন তার সন্তান স্কুলের গেটের ভেতরে প্রবেশ করলো, তখন তার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষকই তার সন্তানের প্রকৃত জন্মদাতা। অতএব, তাকে শাসন করার অধিকার শিক্ষকের থাকতে হবে। এখানে অমুকের ছেলেকে শিক্ষক বকা দিয়েছে, তমুকের মেয়ের দিকে শিক্ষক চোখ রাঙিয়েছে—এসব বাহাদুরি না দেখানোই ভালো। শিক্ষকের কাছে তার সব শিক্ষার্থীই সমান।
অনেক অভিভাবকের মধ্যে এরকম একটি ধারণা আছে যে বেশি পড়াশোনার চাপ আর বেশি বেশি পরীক্ষা মানেই ভালো স্কুল। অথচ শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে বলাই হয় যে সে আনন্দের মধ্য দিয়ে শিখবে। পড়ালেখা ও পরীক্ষা যখন তার কাছে আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হবে, তখন সে অনেক কিছু মুখস্থ করবে ঠিকই, কিন্তু কিছুই শিখবে না। সে অনেক কিছু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতা ভরে ফেলবে, কিন্তু জীবনে ওই শিক্ষা তার ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়ার ডিম’ই হবে। সে নিজের দেশকে চিনবে না। সে জানবে না নদীর প্রতি তার কী দায়। তার দেশের প্রতি কী কর্তব্য। সে শুধু পরীক্ষাই দেবে।

‘আমার ছেলেটা তো নিজের প্লেটটাও ধোয় না’—অনেক অভিভাবক এই ধরনের কথাবার্তা বলে একধরনের আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করেন। অথচ তারা খেয়াল করেন না যে এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের সন্তানদের স্বার্থপর ও অলস করে গড়ে তুলছেন। এই সন্তান বড় হয়ে নিজের কাজটা নিজে না করে অন্যকে দিয়ে করাতে চাইবে। নিজের নিত্যদিনকার কাজের জন্য সে তিন জন কাজের লোক রাখবে। সে তার বিলাসী জীবনযাপন নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ ও অনৈতিক নানা পথে পা বাড়াবে—অভিভাবক সভায় এই কথাগুলো অনেক বেশি আলোচিত হওয়া দরকার।
এই ধরনের সভায় শিক্ষকদেরও বলা উচিত যে তারা তাদের সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার্থী নয়, বরং শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করেন। শিক্ষকদের বলা উচিত, শিশু বয়সে সিলেবাস মুখস্থ করা আর বোর্ডে তুলে দেওয়া লেখাগুলো নির্ধারিত সময়ে লিখতে পারা এবং বছর শেষে পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়; বরং একজন মানবিক, সংবেদনশীল, দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠাই একজন শিশুর প্রধান দায়িত্ব; আর সেই দায়িত্ব পালনে সবচেয় বড় ভূমিকা যে শিক্ষকদেরই—সেই উপলব্ধিটা শিক্ষকদের মধ্যে আসা দরকার। শিশু বয়স থেকেই নিজের টয়লেট নিজের পরিষ্কার করা, এমনকি স্কুলের টয়লেটও যে পালাক্রমে নিজেদের পরিষ্কার করা দরকার; নিজের ময়লা- জামাকাপড় ধোয়ার হাতেখড়ি যে শৈশবেই দেওয়া দরকার; অন্যের কাঁধে পাড়া দিয়ে উপরে ওঠার নামই যে সাফল্য নয়; অবৈধ উপায়ে টাকা কামাই করে বহুতল বাড়ি নির্মাণই যে উন্নয়ন নয়—সেই বোধটুকু শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার মূল দায়িত্বটি শিক্ষকের।
মনে রাখা দরকার, শিশুরা বাবা মায়ের চেয়ে শিক্ষকের কথাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। শিক্ষকের কথাকে তারা অবশ্য পালনীয় মনে করে। শিক্ষক ভুল পড়ালেও সে ওটাকেই সঠিক মনে করে। সুতরাং মানস গঠনে বাবা মায়ের চেয়ে শিক্ষকের দায়িত্ব বেশি। যে কারণে বলা হয়, বাবা-মা হচ্ছেন জনক, মানে জন্মদাতা। আর শিক্ষক হচ্ছেন পিতা। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা নিজেদের সেরকম ‘পিতা’ বা প্রকৃত জন্মদাতা মনে করেন কিনা; তাদের নিজেদের মধ্যে এই উপলব্ধিটা আছে কিনা; তারা ছাত্রছাত্রীদের নিতান্তই পরীক্ষার্থী মনে করেন নাকি শিক্ষার্থী; তাদের দিয়ে ভারী বই পড়িয়ে মুখস্থ করিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়া নিশ্চিত করাটাই শিক্ষকদের জীবনের মূল লক্ষ্য কিনা; তাদের ছাত্রজীবনে জিপিএযোদ্ধা এবং তারপরে বিসিএসযোদ্ধা বানানোই শিক্ষকদের প্রধান কাজ কিনা—সেটি বিরাট প্রশ্ন।
এই প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কতটা সৎ, মানবিক ও দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখতে চায়, এর ওপর নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপদ্ধতি। রাষ্ট্র যদি মনে করে শিক্ষা মানেই টাকা কামানোর তরিকা; নাগরিক মানেই সে শুধু উৎপাদন করবে এবং সেই উৎপাদন করতে গিয়ে সে নিজের দেশের মানুষকে ঠকাচ্ছে কিনা; সে নিজের দেশের নদী-খাল-বিল-জলাশয়-বন-পাহাড় ধ্বংস করে ফেলছে কিনা—সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। রাষ্ট্র যদি মনে করে একজন নাগরিক রাষ্ট্রের সবকিছু বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়ে শুধু ভালো জিনিসের প্রশংসাই করতে থাকবে এবং সে খারাপ কোনও কাজের সমালোচনা করতে পারবে না, তাহলে শিক্ষকরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের মনে দেশপ্রেম ও মানবিকতার বোধ যতই জাগ্রত করার চেষ্টা করুন না কেন, আখেরে সবাই ওই জিপিএ এবং বিসিএসযোদ্ধাতেই পরিণত হবে।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।