ঢাকা ০৫:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দারিদ্র্য ঠেকাতে বাড়তি আয়ের চেষ্টা

  • আপডেট সময় : ১১:৫৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ৮২ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের মানুষ। পরিস্থিতি এমন যে, বিভিন্ন জিনিসের দাম মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে দেশজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে দারিদ্র্যের হার। এই পরিস্থিতিতে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে নির্দিষ্ট কর্মের পাশাপাশি ছুটির দিনেও রাজধানীর সড়কে নামছেন নি¤œ-মধ্যবিত্ত নানা পেশার মানুষ। একবছর ধরে বাজারে কার্যত স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। সদ্য গত শীত মৌসুমে সবজির দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল। এর মধ্যে চাল ডাল, তেল, মাছ মাংসসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম এখন শুধু স্বল্প আয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তেরও সামর্থ্যের মধ্যে নেই। বাজারে গেলেই হতাশা বাড়ে মানুষের মধ্যে। এ অবস্থায় বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে পাকিস্তানি মুরগি প্রতি কেজি ৩২০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ৩৫০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৮০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা এবং খাসির মাংস সাত দিনের ব্যবধানে ৯৫০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১০০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাঁচা মরিচ ১২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকা, বেগুনের কেজি ৭০ টাকা ছিল, কিন্তু আজ ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে একটু বাড়তি রোজগারের আশায় রাইড শেয়ারিংয়ে সড়কে নেমেছেন মিরপুরের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম (ছদ্ম নাম)। স্বল্প বেতনে চাকরি করেন রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেতনের টাকায় পরিবার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়।
জাহিদুল ইসলাম জানান, চাকরি করে যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারে সব জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এই শহরে টিকে থাকা দায়। যতো দিন যাচ্ছে ততো দামও বাড়ছে সবকিছুর। কিন্তু রোজগার বাড়ছে না। প্রতি বছর বাসাভাড়া বাড়ছে, কিন্তু বেতন তো আর বাড়ে না। চাকরি থেকে পাওয়া বেতন বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস খরচেই শেষ হয়ে যায়। টেনেটুনে বাজার কোনোমতে চলে। কিন্তু এভাবে চললে কি হবে? নানা সময় পরিবারের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার খরচ থাকে। এছাড়াও তো গ্রামে বাবা-মা থাকেন, তাদেরও টাকা পাঠাতে হয়।’ জাহিদ বলেন, এভাবে আর কতদিন বেচে থাকা যায়? ভবিষ্যতের চিন্তাও তো করা লাগবে। আল্লাহ না করুক যদি কখনো কোনো সমস্যা হয় তখন টাকা পাবো কোথায়? সবকিছু চিন্তা করেই এই ছুটির দিন রাস্তায় নেমেছি। যদি দুই-পাঁচশো রোজগার হয় তাহলে সেটাই লাভ। ছুটির দিন ছাড়াতো আর কাজ করতে পারি না। তবে প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় বাইকের পেছনে একজনকে নিয়ে যায় এবং আশার সময় একজনকে নিয়ে আসি তাতে তেল খরচটা উঠে যায়। রাজধানীতে এমন পরিস্থিতির শিকার শুধু জাহিদুল একা নন। হাজার হাজার নি¤œ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস এই শহরে। একটু অতিরিক্ত আয় ও স্বচ্ছলভাবে জীবন কাটাতে অনেকেই ছুটির দিনে বিকল্প কাজের আশায় নামছেন রাস্তায়। তবে পরিবার ও কাছের মানুষের থেকে মুখ লুকাতে কথা বলতে নারাজ। বেসরকারি চাকরিজীবী মোস্তাফিজুর রহমান দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ ঢাকায় থাকেন। তার ভাষ্য, অফিসের বেতনের টাকার পুরোটাই বাসাভাড়া ও বাজার খরচে চলে যায়। পরিবারের কারো অসুখ-বিসুখ হলে আত্মীয়-স্বজন থেকে সহযোগিতা নিতে হয়। এজন্য অফিসের কাজের বাইরেও খ-কালীন কিছু করে আয়ের রাস্তা খুঁজেন তিনি। মাঝে-মধ্যে এমন কোনো সুযোগ পেলেও সেটি স্থায়ী নয়। তাই সবসময়ই তাকে পরিবারের খরচ নিয়ে টানাটানিতে থাকতে হয়। রাজধানীর শ্যামলীতে কথা হয় রাসেল হোসেনের সঙ্গে। তিনি চাকরি করেন একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বসেন একটি মুদিখানার দোকানে। তিনি বলেন, ‘আমার চাকরির টাকায় সংসার চলে না তাই বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাবাকে একটা দোকান করে দিয়েছি। বাবারও বয়স হয়েছে। একা দোকান চালাতে পারেন না। অধিকাংশ ছুটির দিনেই দোকান বন্ধ রাখতেন। কিন্তু দোকান বন্ধ রাখলেইতো হবে না। মাস শেষে দোকান ভাড়াসহ বিভিন্ন খরচ আছে। একটু বেশি আয়ের আশায় দোকান করা। কিন্তু যদি দোকান বন্ধ থাকে আর আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হয় তাহলে কীভাবে চলবে? তাই ছুটির দিনে আমি নিজেই দোকানে বসি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬-এর চূড়ান্ত রিপোর্টে ( মে ২০১৯) দাঁড়িয়েছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। এর আগে ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হায়েসের প্রাথমিক রিপোর্টে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয়েছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীতে ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের হার ও মাত্রা দুটোই বেড়েছে। এতে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। করোনা মহামারির প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সানেমের জরিপ প্রকাশিত হওয়ার আগে ২০২০ সালে একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে আসে দেশে উচ্চ দারিদ্র্য হারের তথ্য। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জুন মাসের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্য বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে।
২০২০ সালের জুনে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, করোনার কারণে বেড়েছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা, আয় কমেছে মানুষের। ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই বছরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ছুটিতে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক উপার্জন হ্রাস পায়; ৯১ শতাংশ নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল মনে করে এবং ৪৭ শতাংশ পরিবারের আয় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। পরিবারগুলোর ৭০ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ১৫ শতাংশ খাদ্য সংকটে ভোগে বা কোনো একবেলা না খেয়ে থাকে। আর বিবিএসের ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক জরিপ অনুযায়ী, করোনা মহামারির প্রভাবে মানুষের মাসিক আয় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মহামারিতে আয় কমে যাওয়ায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমেছে ৫২ শতাংশের মতো পরিবারের।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দারিদ্র্য ঠেকাতে বাড়তি আয়ের চেষ্টা

আপডেট সময় : ১১:৫৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

বিশেষ সংবাদদাতা : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের মানুষ। পরিস্থিতি এমন যে, বিভিন্ন জিনিসের দাম মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে দেশজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে দারিদ্র্যের হার। এই পরিস্থিতিতে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে নির্দিষ্ট কর্মের পাশাপাশি ছুটির দিনেও রাজধানীর সড়কে নামছেন নি¤œ-মধ্যবিত্ত নানা পেশার মানুষ। একবছর ধরে বাজারে কার্যত স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। সদ্য গত শীত মৌসুমে সবজির দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল। এর মধ্যে চাল ডাল, তেল, মাছ মাংসসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম এখন শুধু স্বল্প আয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তেরও সামর্থ্যের মধ্যে নেই। বাজারে গেলেই হতাশা বাড়ে মানুষের মধ্যে। এ অবস্থায় বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে পাকিস্তানি মুরগি প্রতি কেজি ৩২০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ৩৫০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৮০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা এবং খাসির মাংস সাত দিনের ব্যবধানে ৯৫০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১০০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাঁচা মরিচ ১২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকা, বেগুনের কেজি ৭০ টাকা ছিল, কিন্তু আজ ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে একটু বাড়তি রোজগারের আশায় রাইড শেয়ারিংয়ে সড়কে নেমেছেন মিরপুরের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম (ছদ্ম নাম)। স্বল্প বেতনে চাকরি করেন রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেতনের টাকায় পরিবার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়।
জাহিদুল ইসলাম জানান, চাকরি করে যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারে সব জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এই শহরে টিকে থাকা দায়। যতো দিন যাচ্ছে ততো দামও বাড়ছে সবকিছুর। কিন্তু রোজগার বাড়ছে না। প্রতি বছর বাসাভাড়া বাড়ছে, কিন্তু বেতন তো আর বাড়ে না। চাকরি থেকে পাওয়া বেতন বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস খরচেই শেষ হয়ে যায়। টেনেটুনে বাজার কোনোমতে চলে। কিন্তু এভাবে চললে কি হবে? নানা সময় পরিবারের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার খরচ থাকে। এছাড়াও তো গ্রামে বাবা-মা থাকেন, তাদেরও টাকা পাঠাতে হয়।’ জাহিদ বলেন, এভাবে আর কতদিন বেচে থাকা যায়? ভবিষ্যতের চিন্তাও তো করা লাগবে। আল্লাহ না করুক যদি কখনো কোনো সমস্যা হয় তখন টাকা পাবো কোথায়? সবকিছু চিন্তা করেই এই ছুটির দিন রাস্তায় নেমেছি। যদি দুই-পাঁচশো রোজগার হয় তাহলে সেটাই লাভ। ছুটির দিন ছাড়াতো আর কাজ করতে পারি না। তবে প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় বাইকের পেছনে একজনকে নিয়ে যায় এবং আশার সময় একজনকে নিয়ে আসি তাতে তেল খরচটা উঠে যায়। রাজধানীতে এমন পরিস্থিতির শিকার শুধু জাহিদুল একা নন। হাজার হাজার নি¤œ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস এই শহরে। একটু অতিরিক্ত আয় ও স্বচ্ছলভাবে জীবন কাটাতে অনেকেই ছুটির দিনে বিকল্প কাজের আশায় নামছেন রাস্তায়। তবে পরিবার ও কাছের মানুষের থেকে মুখ লুকাতে কথা বলতে নারাজ। বেসরকারি চাকরিজীবী মোস্তাফিজুর রহমান দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ ঢাকায় থাকেন। তার ভাষ্য, অফিসের বেতনের টাকার পুরোটাই বাসাভাড়া ও বাজার খরচে চলে যায়। পরিবারের কারো অসুখ-বিসুখ হলে আত্মীয়-স্বজন থেকে সহযোগিতা নিতে হয়। এজন্য অফিসের কাজের বাইরেও খ-কালীন কিছু করে আয়ের রাস্তা খুঁজেন তিনি। মাঝে-মধ্যে এমন কোনো সুযোগ পেলেও সেটি স্থায়ী নয়। তাই সবসময়ই তাকে পরিবারের খরচ নিয়ে টানাটানিতে থাকতে হয়। রাজধানীর শ্যামলীতে কথা হয় রাসেল হোসেনের সঙ্গে। তিনি চাকরি করেন একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বসেন একটি মুদিখানার দোকানে। তিনি বলেন, ‘আমার চাকরির টাকায় সংসার চলে না তাই বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাবাকে একটা দোকান করে দিয়েছি। বাবারও বয়স হয়েছে। একা দোকান চালাতে পারেন না। অধিকাংশ ছুটির দিনেই দোকান বন্ধ রাখতেন। কিন্তু দোকান বন্ধ রাখলেইতো হবে না। মাস শেষে দোকান ভাড়াসহ বিভিন্ন খরচ আছে। একটু বেশি আয়ের আশায় দোকান করা। কিন্তু যদি দোকান বন্ধ থাকে আর আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হয় তাহলে কীভাবে চলবে? তাই ছুটির দিনে আমি নিজেই দোকানে বসি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬-এর চূড়ান্ত রিপোর্টে ( মে ২০১৯) দাঁড়িয়েছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। এর আগে ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হায়েসের প্রাথমিক রিপোর্টে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয়েছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীতে ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের হার ও মাত্রা দুটোই বেড়েছে। এতে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। করোনা মহামারির প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সানেমের জরিপ প্রকাশিত হওয়ার আগে ২০২০ সালে একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে আসে দেশে উচ্চ দারিদ্র্য হারের তথ্য। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জুন মাসের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্য বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে।
২০২০ সালের জুনে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, করোনার কারণে বেড়েছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা, আয় কমেছে মানুষের। ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই বছরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ছুটিতে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক উপার্জন হ্রাস পায়; ৯১ শতাংশ নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল মনে করে এবং ৪৭ শতাংশ পরিবারের আয় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। পরিবারগুলোর ৭০ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ১৫ শতাংশ খাদ্য সংকটে ভোগে বা কোনো একবেলা না খেয়ে থাকে। আর বিবিএসের ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক জরিপ অনুযায়ী, করোনা মহামারির প্রভাবে মানুষের মাসিক আয় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মহামারিতে আয় কমে যাওয়ায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমেছে ৫২ শতাংশের মতো পরিবারের।