আশফাক সফল : ডিজিটালাইজেশনের সামগ্রিক প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কে বা কারা কীভাবে এগিয়ে থাকবে। শিল্পবিপ্লবের ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, পূর্ববর্তী পর্যায়ের প্রয়োগের ওপর নির্ভর করেই বর্তমানের শিল্পায়নের ধারণাকে দৃশ্যায়ন করা হয়। যেমন, প্রথম শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্য ছিল উৎপাদন ব্যবস্থার যান্ত্রিকীকরণ; আর সেই যান্ত্রিকীকরণের মুনাফাকে ভিত্তি করে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্য ছিল পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি আর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। পরবর্তীকালে তৃতীয় শিল্পবিপ্লব দাঁড়িয়েছিল বৈদ্যুতিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ (ঊষবপঃৎরপধষ ধহফ ঊষবপঃৎড়হরপং ঊয়ঁরঢ়সবহঃ’ং)-এর কার্যকরী প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে। একই সময়ে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে কম্পিউটারের ব্যবহার। এই শতাব্দীর শুরু থেকে কম্পিউটারের এই প্রকার প্রয়োগকে নাম দেওয়া হয় “ডিজিটালাইজেশন”।
অনেকেই ডিজিটালাইজেশনকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অংশ হিসেবে দেখলেও; তাত্ত্বিক বিবেচনায় বলা যেতেই পারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে ডিজিটালাইজেশন পরবর্তী একটি পর্যায়, যেখানে সবাই এবং সবকিছুই যুক্ত থাকবে নেটওয়ার্কের সঙ্গে। একই সঙ্গে বিশাল ও জটিল সেই নেটওয়ার্কসহ সামগ্রিক কাঠামোর সবকিছুই ঢাকা থাকবে দৃঢ় ও টেকসই নিরাপত্তার চাদরে। এক কথায়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে সাইবার স্পেসের সঙ্গে যাবতীয় ভৌত কাঠামোর (ঢ়যুংরপধষ ংঃৎঁপঃঁৎব) মেলবন্ধন। এক্ষেত্রে কমবেশি সবকিছুই হবে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রোগ্রাম করা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ।
যেমন ধরা যাক চালকবিহীন গাড়ির কথা। উড়োজাহাজ বা বিমানের অটো-পাইলট মোড (ধঁঃড়ঢ়রষড়ঃ সড়ফব) বহুল প্রচলিত প্রযুক্তিগুলোর একটি। দীর্ঘ যাত্রাকালের একটা পর্যায়ে যখন উড্ডয়ন বা অবতরণের মতো জটিল কোনও কাজে থাকে না, সেই সময়ে পাইলটরা অটো-পাইলট মোডে বিমান চালিয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারেন। শুরুর দিকে অটো-পাইলট মোড চালু করলেও এখনকার থেকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হতো পাইলদের; কিন্তু বর্তমানে বিমানের অটো-পাইলট মোড ও কম্পিউটার ব্যবস্থা নির্দিষ্ট মাত্রায় বিমান চালানোর পাশাপাশি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যমে বিমান চালনাতে পাইলটদের সাহায্য করছে। একই রকম প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যায় আন্তর্জাতিক নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রেও। একই সঙ্গে সামরিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন (ফৎড়হব)-এর ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। কিন্তু সড়কপথে এসে স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের ধারণাগুলো অনেক বেশি হোঁচট খায়। এর একটা বড় কারণ ছিল সড়কপথে মানুষের প্রথাগত অভ্যস্ততা এবং চারপাশের খুবই দ্রুত পরিবর্তনশীলতা। জাহাজ বা উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার সঙ্গে কাজ করার জন্য যে পরিমাণ সময় পাওয়া যায় সেই পরিমাণ সময় সড়কপথের যানবাহনের জন্য যথেষ্ট না। এই সমস্যা সমাধান করতে ব্যবহার করা হচ্ছে আরও কিছু জটিল প্রযুক্তি, যেমন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা ইত্যাদি। স্বয়ংক্রিয় গাড়িকে একই সঙ্গে বিভিন্ন সিস্টেমে যুক্ত করা হয়, যার মধ্যে আছে সিগন্যাল সিস্টেম, স্যাটেলাইট সিস্টেম ইত্যাদি। সম্পূর্ণ ব্যবস্থায় নিশ্চিত করতে হয় নিরবচ্ছিন্নতা সঙ্গে সঠিক তথ্যের নিরাপদ প্রবাহ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফলতা অনেকটাই নির্ভর করছে একই বিষয়ের ওপর- নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বা কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের ওপর। শুধু তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, আরও অনেক অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অনেক ক্ষেত্র বা ডোমেইন (ফড়সধরহ)-গুলো নিয়ে কাজ করে, যার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (ধৎঃরভরপরধষ রহঃবষষরমবহপব), বিগ ডাটা, ব্লক-চেইন, ইন্টারনেট অব থিংস (ওড়ঞ), রোবটিক্স, সাইবার সিকিউরিটি, ইত্যাদি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব ডোমেইনে প্রত্যেকটির নিশ্চিত প্রাপ্যতা ও স্থিতাবস্থার (ধাধরষধনরষরঃু ধহফ ংঃধনরষরঃু) সরাসরি নির্ভর করে বেশ কিছু অবকাঠামো ও পরোক্ষ উপাদানের (রহভৎধংঃৎঁপঃঁৎব ধহফ ঢ়ধংংরাব ভধপঃড়ৎং) ওপর, যার মধ্যে আছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ, উচ্চ গতির ও মানের নেটওয়ার্ক সংযোগ, কম্পিউটার যন্ত্রাংশের দাম ও মান ইত্যাদি। মোটা-দাগে বললে নির্দিষ্ট কিছু অবকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে সার্থকতা দূরের কথা; ঠিকভাবে সংযুক্ত হওয়াই সম্ভব না। আবার এই অবকাঠামোগুলোও অনেক ক্ষেত্রে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল।
নির্ভরশীলতার শিকলকে পর্যালোচনা করলে বোধকরি বিদ্যুৎ সংযোগ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে। কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে শিল্প কারখানা বা ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেওয়া পণ্যের ব্যবহার– সবকিছুই নির্ভর করে বিদ্যুতের প্রাপ্তির ওপর।
সাম্প্রতিক বিদ্যুতে উৎপাদনে বেশ কিছুটা ঘাটটি দেখা দিলেও বর্তমানে সংকট কম বেশি কেটে গেছে বলা যায়। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমে যাবার কারণে আপাতদৃষ্টিতে সংকট থেকে উত্তরণ হয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই। সামনের গ্রীষ্মে যখন চাহিদা থাকবে তুঙ্গে, তখন পরিস্থিতি থেকে বুঝতে হবে আমাদের দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার সক্ষমতা আসলে কতটুকু টেকসই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজারে যে অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল, সেটি এখনও পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলেই তারা মনে করেন। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতার পাশাপাশি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তিসমূহের মেয়াদ শেষ হওয়া এবং চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে শর্তাবলির পরিবর্তনসহ বিভিন্ন জটিলতা বাংলাদেশে ২০২২ সালে বিদ্যুৎ সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। ২০২২ সালে উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থাতেও সমস্যা দেখা যায়। যদিও বর্তমানে এই সংকটগুলো দৃশ্যমান নেই, কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে বিশেষ কোনও পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। গত কয়েক দশকের প্রয়াসে সারা দেশ বিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মানের দিক থেকে বিপণন ব্যবস্থা অনেক বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শহরাঞ্চলের বাইরে; বিশেষ করে যেসব পল্লি বিদ্যুতের সংযোগ যেখানে, সেসব জায়গায় ভোল্টেজ (াড়ষঃধমব) উঠানামাসহ বেশ কিছু সমস্যা আছে, যেগুলোর জন্য বৈদ্যুতিক ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশের ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি আউটসোর্সিংয়ের কাজ করার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যাচ্ছে। মূলত চাহিদার সঙ্গে জোগানের প্রতিযোগিতাকে সামাল দিতে উৎপাদনকে যেভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, সেভাবে বিপণন ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা হয়নি। যেমন, স্মার্ট গ্রিড (ংসধৎঃ মৎরফ) আমাদের দেশে এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি, যদিও এই প্রযুক্তির বয়স কয়েক দশক।
কম্পিউটার এবং ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে মূল কাঁচামাল সেমিকন্ডাক্টর (ংবসরপড়হফঁপঃড়ৎ) বা অর্ধপরিবাহী। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক বাজারে সেমিকন্ডাক্টরের অপ্রাপ্যতার কারণে ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশের চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী বেড়েছে সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক, কম্পিউটার যন্ত্রাংশের দাম। এমনকি শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রের দাম বেড়েছে অনেক। এক্ষেত্রে কিছুটা হলেই হ্রাস পেতে পারে শিল্পায়নের গতি। এর বাইরে দীর্ঘসময় কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের আমদানি শুল্কমুক্ত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে শুল্কারোপ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। অন্যদিকে দেশে অ্যাসেম্বলি শিল্পের (ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশ যুক্ত করে পণ্য তৈরি) বিকাশ কিছুটা হলেই ইলেক্ট্রনিক্স ও কম্পিউটার পণ্যের দাম কমাতে পারে। বর্তমানে বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত আছে এই শিল্পের সঙ্গে। এমনকি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য রফতানি করছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এই খাতে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। শুধু অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নয়; ইলেকট্রনিক্স শিল্পে বিনিয়োগের জন্য গবেষণা ও শিক্ষাক্ষেত্রেও আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন।
আপাতদৃষ্টিতে, সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে ডাটা ও কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে, শুধু দুটি সাবমেরিন ক্যাবল থেকেই বাংলাদেশ ৩৫০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ পাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশ যুক্ত হবে আরেকটি সাবমেরিন নেটওয়ার্কের সঙ্গে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে যুক্ত হবে আরও ৬০০০ থেকে ৬২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ। সার্বিক হিসাবে বাংলাদেশ বর্তমান সাবমেরিন সংযোগের ক্যাপাসিটি এবং সামনে এগোনোর পরিকল্পনা বেশ যুতসই।
অন্যদিকে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা আইএসপিদের(ওঝচ) নেটওয়ার্ক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন গ্রামাঞ্চলেও ইন্টারনেট সংযোগ কমবেশি সহজলভ্য। সেই সঙ্গে টেলিকম অপারেটররা ফোর-জি সেবা প্রদান করছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই শহরাঞ্চলের বাইরে মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইন্টারনেটের গতি বেশিরভাগ জায়গায় কম বা অনেক বেশি ওঠানামা করে। মুঠোফোন সেবা প্রদানকারীদের ক্ষেত্রে অনেক শহরাঞ্চলের বাইরে থ্রি-জি সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধও। টেলিকনফারেন্সিং, ইন্টারনেট অব থিংস এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভালো মানের ইন্টারনেট সংযোগ আবশ্যকও। সংকট উত্তরণে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন) ইতোমধ্যে ইন্টারনেট সংযোগের মান নিয়ন্ত্রণে একাধিক নির্দেশনা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যান্ডউইথ শেয়ারের ক্ষেত্রে সংযোগ সংখ্যা বেঁধে দেওয়া, প্রক্সি সার্ভারের নীতিমালা, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম, মুঠোফোন সেবা প্রদানকারীদের ক্ষেত্রে নতুন তরঙ্গ প্রদান ইত্যাদি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। উন্নত এবং উন্নয়নশীলসহ সব দেশই মনোযোগ দিচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দিকে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে সফলকাম হতে বিদ্যুতায়নসহ তথ্যপ্রযুক্তি সেবার মান উন্নয়নের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে উপযোগী অবকাঠামো। বিশাল জনশক্তির ধারক বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং টেকসই ও উপযোগী অবকাঠামোর যুগোপযোগী ব্যবহার।
লেখক: ব্লগার ও আইটি প্রফেশনাল