ঢাকা ০৫:৫৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫

শুধু পরিশ্রম নয়, প্রয়োজন পেশাদারিত্ব

  • আপডেট সময় : ০৭:৫৩:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ জুলাই ২০২১
  • ২৭৪ বার পড়া হয়েছে

এম এ আরেফিন আশরাফ : বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ অর্থাৎ একজন মা যেমন তার সন্তানের জন্ম দেন ঠিক তেমনি পরিশ্রমও উন্নতির জন্মদাতা। পরিশ্রম ছাড়া এই পৃথিবীতে ভালো বা সুফল কোনও কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। এমন অনেক নীতি বাক্যের সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। তবে আমি এই নীতি বাক্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একমত নই এবং আমার কাছে মনে হয় পূর্বসূরিরা আমাদেরকে আংশিক ‘ভুল’ শিক্ষা দিয়েছেন। আমি অনেক দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, ‘পেশাদারিত্ব’ হলো উন্নতির মূল সোপান আর ‘পরিশ্রম’ হলো পেশাদারিত্বের কয়েকটি উপাদানের মধ্যে একটি মাত্র।

‘পেশাদারিত্ব’ শব্দটির সাথে মোটামুটি আমরা সবাই পরিচিত। যদিও পেশাদারিত্বের সঠিক প্রভাব আমাদের কর্মজীবনে অনুপস্থিত। পেশাদারিত্ব বলতে বোঝায় কর্মজীবনে একজন ব্যক্তি যে কোনও পেশার সঙ্গেই যুক্ত থাকুক না কেন সেই পেশা সম্পর্কে তার তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক স্বীকৃত জ্ঞান থাকা, দায়িত্ব সম্পর্কে যতœশীল হওয়া, সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট আচরণ বিধি মেনে চলা, সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা এবং কঠোর পরিশ্রম করা। মনে রাখতে হবে পরিশ্রম সফলতার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বটে কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়।

বলা বাহুল্য যে, পশ্চিমা বিশ্ব এবং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো শুধু পরিশ্রমের কারণে উন্নত নয়, তাদের পেশাদারিত্বের কারণেই অধিক সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। পরিশ্রম তো আমারও করি কিন্তু এখনও উন্নত দেশের তালিকাতে আমরা নেই। সুতরাং, পরিশ্রম একক মানদ-ে সৌভাগ্যের প্রসূতি নয়।

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পেশাদারিত্বের খুবই অভাব। এটা কোনও নির্দিষ্ট পেশার লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যতিক্রম কিছু মানুষ ছাড়া এই ব্যাধি সবার মধ্যেই আছে। যেমন, ৮ ঘণ্টার দায়িত্ব পালনের মধ্যে দুই তিন ঘণ্টা কিংবা পুরো কর্মঘণ্টার অর্ধেক সময় বিড়ি-সিগারেট পান করে, ফেসবুক ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে, মোবাইল ফোনে কথা বলে, অন্য সহকর্মীদের পেছনে সমালোচনা করে, নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ঘাটাঘাটি করে এবং খাওয়ার অজুহাতে পার হয়ে যায়। আরেকটা মহা ব্যাধি আছে আমাদের মধ্যে, সেটা হলো বিনা পরিশ্রমে বা অল্প পরিশ্রমে অথবা ফাঁকফোকর বের করে সেই পথ দিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা। কীভাবে আরেকজনকে ঠকিয়ে বা ‘ধান্ধাবাজি’ করে পরিশ্রম ছাড়াই উপরে ওঠা যায় সেই চেষ্টায় অধিকাংশ মানুষই ব্যস্ত।

আর এসব কারণেই আমাদের দেশে ভারত, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া এবং চীনের কর্মীদের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। আপনি-আমি স্বীকার করি বা না করি তাদের মধ্যে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পেশাদারিত্ব বিদ্যমান। তাদের অধিকাংশ মানুষই কর্মঘণ্টার সময় হেলায়-ফেলায় নষ্ট করে না। একইসঙ্গে বেশিরভাগ মানুষই মালিকের প্রাপ্যের ব্যাপারে সচেতন। এখন একজন মালিক বা চাকরিদাতা তাকেই নিয়োগ দেবে যাকে দিয়ে তার স্বার্থরক্ষা বা লাভ বেশি হবে। এটাই স্বাভাবিক। এটা মনে হয় না শুধুমাত্র আমার একার মতামত। ডজন খানেক গার্মেন্টস মালিক বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মালিকের অভিযোগ যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ (ব্যতিক্রম রয়েছে) চাকরিজীবীরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন কিনা তা পাহারা দেওয়ার জন্য আলাদাভাবে লোক নিয়োগ দেওয়া লাগে। যেটা ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, কোরিয়ান বা চীনাদের ক্ষেত্রে লাগে না।

পশ্চিমারা এবং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো করপোরেট কালচারের কারণে এত উন্নত। কারণ পেশাদারিত্বই করপোরেট কালচার তৈরির পূর্বশর্ত। আমাদের দেশে গুটি কয়েক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া অধিকাংশ জায়গায় করপোরেট কালচার নেই বললেই চলে। উন্নয়নশীল এবং অন্নুনত দেশগুলোর মানুষদের মধ্যে এই পেশাদারিত্ব বোধটি সাধারণত কম থাকে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে তারা এই পেশাদারিত্ব শব্দটি শোনেনি কখনও, আর যদিও শুনেও থাকে তবে তার সঠিক অর্থ তাদের জানা নেই।

পেশাদারিত্ব মানুষ মায়ের পেট থেকে শিখে আসে না। যে সমাজে সে জন্মগ্রহণ করে সেখান থেকেই দেখে অথবা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শেখে। আমাদের সমাজ দেখে পেশাদারিত্বের ছবক নেওয়া ‘গোবর গণেশ’ চিন্তা বৈকি। আর শিক্ষা ব্যবস্থায় ওয়ার্ক প্লেসমেন্টের (শ্রেণিকক্ষে তাত্ত্বিক পাঠদানের সাথে সাথে উক্ত শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত কাজ) ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও খুবই নগন্য এবং তা ফলপ্রসূ নয়। পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ছোট বড় সব ধরনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় থাকে এবং তাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এতে করে একজন শিক্ষার্থী অপর একজন পেশাদার লোকের সংস্পর্শে আসে এবং তরুণ বয়স থেকেই তার মধ্যে পেশাদারিত্বের আবহ তৈরি হয়।

দেশের বাইরে ভ্রমণে বের হলে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গেলে আমার বুকে প্রচ- ব্যথা অনুভূত হয়। বিমান বন্দর, হোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠা বা অন্য যে কোনও জায়গাতেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালের মানুষজন থাকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। আর আমাদের লোকেরা সাধারণ শ্রমিক বা নি¤œশ্রেণির কর্মস্থানে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজার একটা বিশাল কর্ম বাজার। আমার কাছে মনে হয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের বিমান বন্দরগুলো ভারতীয়রা নিয়ন্ত্রণ করে। আমি ভারতীয়দের বিপক্ষে বলছি না, বরং এটা তাদের কৃতিত্ব। আমরাও কিন্তু এই বাজারগুলো দখল করতে পারি, যার জন্য দরকার কিছু সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের।

আমাদের দেশ যতটুকু এগিয়েছে তার সিংহভাগই বেসরকারি উদ্যোগের ফলে। সুতরাং, পেশাদারিত্ব তৈরিতে বেসরকারি পদক্ষেপের কোনও বিকল্প নেই। বেসরকারি খাতগুলো শুধুমাত্র দেশের উন্নয়নের জন্য নয় বরং নিজেদের প্রয়োজনে করা উচিত। কারণ পেশাদারিত্ব মুনাফা বৃদ্ধি করে। পেশাদারিত্ব তৈরি এবং বৃদ্ধি হতে পারে যথাযথ এবং ক্রমাগত প্রশিক্ষণ, আচরণ নীতিমালা প্রণয়ন, পরিশ্রমী ও নিয়ম নীতি মেনে চলা কর্মীদের মূল্যায়ন এবং তাদের পুরস্কৃত করার মাধ্যমে। আর এই সব বাস্তবায়নের জন্য দরকার কঠোর তদারকি এবং ব্যবস্থাপনা, কর্মীদের জন্য নিরাপদ এবং উপযোগী কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা, সৎ, পরিশ্রমী ও যোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং একই সঙ্গে কর্মীদের ন্যায্য ও আইনত সকল অধিকার নিশ্চিত করা।

সরকারি উদ্যোগ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিক ফলপ্রসূ। সরকারের ইচ্ছা থাকলে দেশের বিশাল জনগণ, বিশেষ করে শিক্ষিত ও বেকার যুবকরা জনসম্পদে রূপান্তরিত হতে পারে। সরকারি পদক্ষেপ বেশ কয়েক রকম হতে পারে, তার মধ্যে সর্বপ্রথম এবং জরুরি ভিত্তেতে শিক্ষা ব্যবস্থায়, বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে শ্রেণিকক্ষের তাত্ত্বিক পাঠদানদের সাথে সাথে ওই বিষয়ে বাস্তবিক দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করা। এ জন্য আইন প্রণয়ন করে বেসরকারি খাতগুলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে বাধ্য করা। প্রয়োজনে ক্ষেত্র বিশেষে এই খাতে ভর্তুকি প্রদান করা যেতে পারে। এ ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে করপোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি বাধ্যতামূলক করা এবং সমানুপাতিক হারে ট্যাক্স মওকুফের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

যদিও আজকের মূল বিষয়ের সাথে অপ্রাসঙ্গিক- আমাদের দেশে-বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ এখন লাগামহীন হয়ে গেছে। নানান ধরনের নিয়ম থাকলেও অনিয়মই বেশি হয় বলে আমার মনে হয়। কতজন বিদেশি কর্মী বাংলাদেশে কাজ করছেন তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্যই শুধু সর্বনাশা নয় বরং আমাদের দেশের লাখ লাখ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান ‘ডাকাতি’ করার শামিল। যেই দেশে এখনও বেকারত্বে হতাশ হয়ে অনেক যুবক আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সেই দেশে শ্রমিক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রাধান্য দেওয়া শুধু বিলাসিতা নয় বরং চরম হঠকারিতার কাজও বটে। এই অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে দেশে নতুন মহামারি তৈরি হবে। আর এজন্যই বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের নীতিমালাগুলো সংশোধন এবং নতুন নীতিমালা সংযোজন এখন সময়ের দাবি। এই আসন্ন মহামারি থেকে দেশ এবং দেশের শ্রমবাজারকে রক্ষা করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

যেমন, প্রথমত, সরকারি অনুমতি ছাড়া বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা। এমন একটি বিধান বিদ্যমান আছে বলে বোধ করি, কিন্তু এর বাস্তবিক ফলপ্রসূ কোনও প্রয়োগ আছে বলে মনে হয় না। বিনা অনুমতিতে কেউ বিদেশি নিয়োগ দিলে জেল সহ কঠোর জরিমানার বিধান আরোপ করা।

দ্বিতীয়ত, বিদেশি শ্রমিক বা কর্মী নিয়োগের পূর্বে লেবার মার্কেট টেস্ট প্রথা চালু করা। লেবার মার্কেট টেস্ট হলো কোনও কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশি শ্রমিক বা কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে দেশীয় বাজার যাচাই করা। অর্থাৎ কোনও কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কেবলমাত্র তখনই বিদেশি লোক নিয়োগ দিতে পারবে যখন যথাযথ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরেও দেশে ওই পদের জন্য যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তৃতীয়ত, বিদেশি শ্রমিক বা কর্মী নিয়োগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিয়ম ভঙ্গ হলে কঠোর জরিমানার বিধান প্রণয়ন করা।
চতুর্থত, বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে হলে কোম্পানিগুলো থেকে আলাদা ফী আদায়ের বিধান প্রবর্তন করা এবং পরবর্তী নবায়নের জন্য পরিমাণ মতো ফী আদায়ের ব্যবস্থা করা। আমাদের পেশাদারিত্বের অভাবের কারণে শ্রম বাজার যেন বিদেশিদের হাতে চলে না যায় সেই দায়িত্ব সবার। কারণ কর্মজীবনে পেশাদারিত্বের কোনও বিকল্প নেই।
লেখক: ব্যারিস্টার; পিএইচডি গবেষক, কিংস্টন ইউনিভার্সটি, যুক্তরাজ্য

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ছোটমাছ যেন সোনার হরিণ, তেলাপিয়া-পাঙ্গাসও যাচ্ছে সাধ্যের বাইরে

শুধু পরিশ্রম নয়, প্রয়োজন পেশাদারিত্ব

আপডেট সময় : ০৭:৫৩:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ জুলাই ২০২১

এম এ আরেফিন আশরাফ : বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ অর্থাৎ একজন মা যেমন তার সন্তানের জন্ম দেন ঠিক তেমনি পরিশ্রমও উন্নতির জন্মদাতা। পরিশ্রম ছাড়া এই পৃথিবীতে ভালো বা সুফল কোনও কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। এমন অনেক নীতি বাক্যের সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। তবে আমি এই নীতি বাক্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একমত নই এবং আমার কাছে মনে হয় পূর্বসূরিরা আমাদেরকে আংশিক ‘ভুল’ শিক্ষা দিয়েছেন। আমি অনেক দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, ‘পেশাদারিত্ব’ হলো উন্নতির মূল সোপান আর ‘পরিশ্রম’ হলো পেশাদারিত্বের কয়েকটি উপাদানের মধ্যে একটি মাত্র।

‘পেশাদারিত্ব’ শব্দটির সাথে মোটামুটি আমরা সবাই পরিচিত। যদিও পেশাদারিত্বের সঠিক প্রভাব আমাদের কর্মজীবনে অনুপস্থিত। পেশাদারিত্ব বলতে বোঝায় কর্মজীবনে একজন ব্যক্তি যে কোনও পেশার সঙ্গেই যুক্ত থাকুক না কেন সেই পেশা সম্পর্কে তার তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক স্বীকৃত জ্ঞান থাকা, দায়িত্ব সম্পর্কে যতœশীল হওয়া, সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট আচরণ বিধি মেনে চলা, সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা এবং কঠোর পরিশ্রম করা। মনে রাখতে হবে পরিশ্রম সফলতার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বটে কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়।

বলা বাহুল্য যে, পশ্চিমা বিশ্ব এবং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো শুধু পরিশ্রমের কারণে উন্নত নয়, তাদের পেশাদারিত্বের কারণেই অধিক সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। পরিশ্রম তো আমারও করি কিন্তু এখনও উন্নত দেশের তালিকাতে আমরা নেই। সুতরাং, পরিশ্রম একক মানদ-ে সৌভাগ্যের প্রসূতি নয়।

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পেশাদারিত্বের খুবই অভাব। এটা কোনও নির্দিষ্ট পেশার লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যতিক্রম কিছু মানুষ ছাড়া এই ব্যাধি সবার মধ্যেই আছে। যেমন, ৮ ঘণ্টার দায়িত্ব পালনের মধ্যে দুই তিন ঘণ্টা কিংবা পুরো কর্মঘণ্টার অর্ধেক সময় বিড়ি-সিগারেট পান করে, ফেসবুক ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে, মোবাইল ফোনে কথা বলে, অন্য সহকর্মীদের পেছনে সমালোচনা করে, নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ঘাটাঘাটি করে এবং খাওয়ার অজুহাতে পার হয়ে যায়। আরেকটা মহা ব্যাধি আছে আমাদের মধ্যে, সেটা হলো বিনা পরিশ্রমে বা অল্প পরিশ্রমে অথবা ফাঁকফোকর বের করে সেই পথ দিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা। কীভাবে আরেকজনকে ঠকিয়ে বা ‘ধান্ধাবাজি’ করে পরিশ্রম ছাড়াই উপরে ওঠা যায় সেই চেষ্টায় অধিকাংশ মানুষই ব্যস্ত।

আর এসব কারণেই আমাদের দেশে ভারত, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া এবং চীনের কর্মীদের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। আপনি-আমি স্বীকার করি বা না করি তাদের মধ্যে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পেশাদারিত্ব বিদ্যমান। তাদের অধিকাংশ মানুষই কর্মঘণ্টার সময় হেলায়-ফেলায় নষ্ট করে না। একইসঙ্গে বেশিরভাগ মানুষই মালিকের প্রাপ্যের ব্যাপারে সচেতন। এখন একজন মালিক বা চাকরিদাতা তাকেই নিয়োগ দেবে যাকে দিয়ে তার স্বার্থরক্ষা বা লাভ বেশি হবে। এটাই স্বাভাবিক। এটা মনে হয় না শুধুমাত্র আমার একার মতামত। ডজন খানেক গার্মেন্টস মালিক বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মালিকের অভিযোগ যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ (ব্যতিক্রম রয়েছে) চাকরিজীবীরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন কিনা তা পাহারা দেওয়ার জন্য আলাদাভাবে লোক নিয়োগ দেওয়া লাগে। যেটা ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, কোরিয়ান বা চীনাদের ক্ষেত্রে লাগে না।

পশ্চিমারা এবং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো করপোরেট কালচারের কারণে এত উন্নত। কারণ পেশাদারিত্বই করপোরেট কালচার তৈরির পূর্বশর্ত। আমাদের দেশে গুটি কয়েক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া অধিকাংশ জায়গায় করপোরেট কালচার নেই বললেই চলে। উন্নয়নশীল এবং অন্নুনত দেশগুলোর মানুষদের মধ্যে এই পেশাদারিত্ব বোধটি সাধারণত কম থাকে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে তারা এই পেশাদারিত্ব শব্দটি শোনেনি কখনও, আর যদিও শুনেও থাকে তবে তার সঠিক অর্থ তাদের জানা নেই।

পেশাদারিত্ব মানুষ মায়ের পেট থেকে শিখে আসে না। যে সমাজে সে জন্মগ্রহণ করে সেখান থেকেই দেখে অথবা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শেখে। আমাদের সমাজ দেখে পেশাদারিত্বের ছবক নেওয়া ‘গোবর গণেশ’ চিন্তা বৈকি। আর শিক্ষা ব্যবস্থায় ওয়ার্ক প্লেসমেন্টের (শ্রেণিকক্ষে তাত্ত্বিক পাঠদানের সাথে সাথে উক্ত শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত কাজ) ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও খুবই নগন্য এবং তা ফলপ্রসূ নয়। পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ছোট বড় সব ধরনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় থাকে এবং তাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এতে করে একজন শিক্ষার্থী অপর একজন পেশাদার লোকের সংস্পর্শে আসে এবং তরুণ বয়স থেকেই তার মধ্যে পেশাদারিত্বের আবহ তৈরি হয়।

দেশের বাইরে ভ্রমণে বের হলে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গেলে আমার বুকে প্রচ- ব্যথা অনুভূত হয়। বিমান বন্দর, হোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠা বা অন্য যে কোনও জায়গাতেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালের মানুষজন থাকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। আর আমাদের লোকেরা সাধারণ শ্রমিক বা নি¤œশ্রেণির কর্মস্থানে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজার একটা বিশাল কর্ম বাজার। আমার কাছে মনে হয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের বিমান বন্দরগুলো ভারতীয়রা নিয়ন্ত্রণ করে। আমি ভারতীয়দের বিপক্ষে বলছি না, বরং এটা তাদের কৃতিত্ব। আমরাও কিন্তু এই বাজারগুলো দখল করতে পারি, যার জন্য দরকার কিছু সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের।

আমাদের দেশ যতটুকু এগিয়েছে তার সিংহভাগই বেসরকারি উদ্যোগের ফলে। সুতরাং, পেশাদারিত্ব তৈরিতে বেসরকারি পদক্ষেপের কোনও বিকল্প নেই। বেসরকারি খাতগুলো শুধুমাত্র দেশের উন্নয়নের জন্য নয় বরং নিজেদের প্রয়োজনে করা উচিত। কারণ পেশাদারিত্ব মুনাফা বৃদ্ধি করে। পেশাদারিত্ব তৈরি এবং বৃদ্ধি হতে পারে যথাযথ এবং ক্রমাগত প্রশিক্ষণ, আচরণ নীতিমালা প্রণয়ন, পরিশ্রমী ও নিয়ম নীতি মেনে চলা কর্মীদের মূল্যায়ন এবং তাদের পুরস্কৃত করার মাধ্যমে। আর এই সব বাস্তবায়নের জন্য দরকার কঠোর তদারকি এবং ব্যবস্থাপনা, কর্মীদের জন্য নিরাপদ এবং উপযোগী কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা, সৎ, পরিশ্রমী ও যোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং একই সঙ্গে কর্মীদের ন্যায্য ও আইনত সকল অধিকার নিশ্চিত করা।

সরকারি উদ্যোগ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিক ফলপ্রসূ। সরকারের ইচ্ছা থাকলে দেশের বিশাল জনগণ, বিশেষ করে শিক্ষিত ও বেকার যুবকরা জনসম্পদে রূপান্তরিত হতে পারে। সরকারি পদক্ষেপ বেশ কয়েক রকম হতে পারে, তার মধ্যে সর্বপ্রথম এবং জরুরি ভিত্তেতে শিক্ষা ব্যবস্থায়, বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে শ্রেণিকক্ষের তাত্ত্বিক পাঠদানদের সাথে সাথে ওই বিষয়ে বাস্তবিক দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করা। এ জন্য আইন প্রণয়ন করে বেসরকারি খাতগুলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে বাধ্য করা। প্রয়োজনে ক্ষেত্র বিশেষে এই খাতে ভর্তুকি প্রদান করা যেতে পারে। এ ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে করপোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি বাধ্যতামূলক করা এবং সমানুপাতিক হারে ট্যাক্স মওকুফের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

যদিও আজকের মূল বিষয়ের সাথে অপ্রাসঙ্গিক- আমাদের দেশে-বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ এখন লাগামহীন হয়ে গেছে। নানান ধরনের নিয়ম থাকলেও অনিয়মই বেশি হয় বলে আমার মনে হয়। কতজন বিদেশি কর্মী বাংলাদেশে কাজ করছেন তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্যই শুধু সর্বনাশা নয় বরং আমাদের দেশের লাখ লাখ বেকার যুবকের কর্মসংস্থান ‘ডাকাতি’ করার শামিল। যেই দেশে এখনও বেকারত্বে হতাশ হয়ে অনেক যুবক আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সেই দেশে শ্রমিক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রাধান্য দেওয়া শুধু বিলাসিতা নয় বরং চরম হঠকারিতার কাজও বটে। এই অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে দেশে নতুন মহামারি তৈরি হবে। আর এজন্যই বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের নীতিমালাগুলো সংশোধন এবং নতুন নীতিমালা সংযোজন এখন সময়ের দাবি। এই আসন্ন মহামারি থেকে দেশ এবং দেশের শ্রমবাজারকে রক্ষা করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

যেমন, প্রথমত, সরকারি অনুমতি ছাড়া বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা। এমন একটি বিধান বিদ্যমান আছে বলে বোধ করি, কিন্তু এর বাস্তবিক ফলপ্রসূ কোনও প্রয়োগ আছে বলে মনে হয় না। বিনা অনুমতিতে কেউ বিদেশি নিয়োগ দিলে জেল সহ কঠোর জরিমানার বিধান আরোপ করা।

দ্বিতীয়ত, বিদেশি শ্রমিক বা কর্মী নিয়োগের পূর্বে লেবার মার্কেট টেস্ট প্রথা চালু করা। লেবার মার্কেট টেস্ট হলো কোনও কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশি শ্রমিক বা কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে দেশীয় বাজার যাচাই করা। অর্থাৎ কোনও কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কেবলমাত্র তখনই বিদেশি লোক নিয়োগ দিতে পারবে যখন যথাযথ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরেও দেশে ওই পদের জন্য যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তৃতীয়ত, বিদেশি শ্রমিক বা কর্মী নিয়োগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিয়ম ভঙ্গ হলে কঠোর জরিমানার বিধান প্রণয়ন করা।
চতুর্থত, বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে হলে কোম্পানিগুলো থেকে আলাদা ফী আদায়ের বিধান প্রবর্তন করা এবং পরবর্তী নবায়নের জন্য পরিমাণ মতো ফী আদায়ের ব্যবস্থা করা। আমাদের পেশাদারিত্বের অভাবের কারণে শ্রম বাজার যেন বিদেশিদের হাতে চলে না যায় সেই দায়িত্ব সবার। কারণ কর্মজীবনে পেশাদারিত্বের কোনও বিকল্প নেই।
লেখক: ব্যারিস্টার; পিএইচডি গবেষক, কিংস্টন ইউনিভার্সটি, যুক্তরাজ্য