ইয়াহিয়া নয়ন : বিশ্বের কোটি কেটি ফুটবল ভক্তদের কাঁদিয়ে ৮২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন পেলে। কালো মানিক খ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। অনেকে আবার ভাবতে পারেন পেলে যদি সম্রাট হন তাহলে ম্যারাডোনা কি? ম্যারাডোনাকে বলা হয় ফুটবলের রাজপুত্র। ১৯৭৭ সালে অবসর নেওয়ার পরেও পেলে সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন ছিলেন।
তিন তিনবার বিশ্বকাপ জয় করার জন্য পেলে বিখ্যাত হয়েছেন। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়- নারী কিম্বা পুরুষ- যিনি এতবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন। এছাড়াও তিনি তার ক্লাব ও দেশের হয়ে ১,৩৬৩টি ম্যাচ খেলে মোট ১,২৮১টি গোল করেছেন যা বিশ্ব রেকর্ড। ফুটবল খেলায় পেলে যে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন সেটা মানুষের কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল খেলাধুলার বাইরের জগতেও। পেলের জন্মটা সাধারণ এক বস্তিতে।
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মেছিলেন পেলে। আজ আমরা যাকে পেলে নামে চিনি জন্মের পর তার বাবা-মা তার নাম রাখেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিল রেখে। পেলের পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট’।
পর্তুগিজ উচ্চারণে এডিসনকে তাঁরা বলতেন এডসন। পেলে বলেছেন, যখন খেলা শুরু করলাম তখন আমাকে সবাই পেস বলে ডাকত। পেস মানে পা। পর্তুগিজে বলে শট মারাকেও বলা হয় পেস। এই পেস থেকেই এক সময় আমাকে পেলে ডাকা শুরু হলো।
১৯৫০ বিশ্বকাপের সময় পেলের বয়স তখন ১০ বছর। তখন ফুটবল বিশ্বকাপ হতো লীগের মতো করে ব্রাজিল নিজেদের শেষ ম্যাচটা উরুগুয়ের সাথে ড্র করলেই হয়ে যেতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু গিগিয়া যখন শেষ গেলটা করে উরুগুয়ে কে জিতিয়ে দেন সেদিন আবেগপ্রবণ ব্রাজিল সমর্থকদের বহু দর্শক মারাকানার স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তার মধ্যে ১৬ জন মারা যায়।
পুরো ব্রাজিল তখন শোকে আচ্ছন্ন। সেদিন নিজের বাসায় বসেই কাঁদছিলেন পেলের বাবা দোনদিনহো। তখন তার ১০ বছর বয়সের ছেলে পেলে বলেছিলেন, কেঁদো না বাবা, আমি দেশের জন্য বিশ্বকাপ নিয়ে আসব।
দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের প্রথম সন্তান পেলে পরিবারের অভাব অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলায় চায়ের দোকানে কাজ করেছেন। এছাড়া রেলস্টেশন ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিষ্কারের কাজও করেছিলেন। তবে, ছোটবেলা থেকেই পেলে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। পেলে তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার বাবা খুব ভালো সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন। উনিই আমাকে খেলতে শিখিয়েছেন। বাবা আমাকে বলতেন, তার চেয়ে ৩ গুণ বেশি গোল আমাকে করতে হবে। বাবাই আমার অনুপ্রেরণা ছিলেন। তার জন্যই আমি ফুটবলে এসেছি।
ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের বস্তির এক গরিব মা-বাবার পরিবারে জন্ম নেওয়া কালো ছেলেটির জীবনের গল্প অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। ফুটবলে সহজাত প্রতিভা তো ছিলই, ব্রাজিলের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই গলির ফুটবল ছিল তারও অবসরের সঙ্গী। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বলে মোজার ভেতরে খবরের কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চলত তার অনুশীলন।
পেলে যখন স্যান্টোসের মূল দলে যোগ দেন তখন তার বয়স ১৬ বছর। সেবার ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে স্যান্টোসের হয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন। এরপরই তাকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন ক্লাবের কাড়াকাড়ি।
বস্তির সেই ছেলেটিকে নিয়ে এবার ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। এদের মধ্যে বর্তমান সময়ের জায়ান্ত রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মতো দলগুলোও ছিল। সবাই-ই যে কোনো মূল্যে পেলেকে তাদের দলে ভেড়াতে দৌড়ঝাপ শুরু করে। কিন্তু সেবার পেলের ইউরোপে খেলা হয়ে ওঠেনি। পেলেকে ব্রাজিলে রেখে দেওয়ার জন্য চাপ ছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। ১৯৬১ সালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রস পেলেকে “জাতীয় সম্পদ” হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাকে “রপ্তানি করা যাবে না” বলে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন।
ব্রাজিলের হয়ে পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সময়টা ছিল ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে গেলেও প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব রেকর্ডটি করতে ভুল করেনটি পেলে। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড।
১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পেলের অভিষেক ঘটে। ম্যাচটি ছিল ১৯৫৮ বিশ্বকাপের তৃতীয় খেলা। ১ম রাউন্ডের খেলায় পেলে গোল করতে না পারলেও অন্তিম মুহূর্তে এসে পেলে ঠিকই জ্বলে উঠেন।
কোয়ার্টার ফাইনালের ওই ম্যাচে ওয়েলসের বিপক্ষে পেলের করা গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে এবং পরবর্তীতে ব্রাজিল স্বাদ পায় প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের। এই গোলটিও ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের গোল। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জোড়া গোল করে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক বনে যান ১৭ বছর বয়সী পেলে।
এভাবে একে একে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ এর বিশ্বকাপে খেলেন পেলে। এর মধ্যে তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) সালে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তবে পেলে তিনবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন নাকি দুইবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন তা নিয়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কিছুটা বিতর্ক ছিল। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে ২য় ম্যাচেই গুরুতর আঘাত পান। এই আঘাতই তাকে বিশ্বকাপ দল থেকে ছিটকে দেয়। সেবারও ব্রাজিল বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে। তবে পেলে সেই দলের সদস্য কিনা তা নিয়েই চলছিল বিতর্ক। অবশেষে ১৯৯৭ সালে ফুটবলের বিশ্ব সংস্থা ফিফা বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁকে ১৯৬২’র বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ঘোষণা করে।
১৯৬৬ সালের যে বিশ্বকাপটা ব্রাজিল জিততে পারেননি সেই বিশ্বকাপেও ১ম খেলায় বুলগেরিয়ার বিপক্ষে খেলা ম্যাচে পেলে গুরুতর আহত হন। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দলটির সদস্য হিসেবে পেলে জিতেন তাঁর তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। জুলে রিমে ট্রফিকে নিজের করে নেওয়ার পথে ব্রাজিলের সব সাফল্যের সঙ্গী পেলে ছাড়া বিশ্বের আর কোনো ফুটবলারেরই নেই তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের সাফল্য।
পেলে তার ক্যারিয়ারের ১৩৬৩ ম্যাচে গোল করেছেন ১২৮৩টি। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে ভাস্কো-দা-গামা ক্লাবের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান লিগের এক ম্যাচে যেদিন করলেন তাঁর হাজারতম গোল, সেদিন পুরো ব্রাজিল মেতে উঠেছিল উৎসবে। কোনো একক খেলোয়াড়ের গোল করার ব্যাপারে এটিই ছিল বিশ্বরেকর্ড। ১৯৬৬ সালে রোজমেরিকে বিয়ের ১৬ বছর পর তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় পেলের। সেই ঘরে এক ছেলে এডসন এবং দুই মেয়ে ক্রিস্টিনা এবং জেনিফারের জন্ম হয়। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলিয়ান মডেল জুজার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেও দৈনিকের শিরোনাম হয়েছেন পেলে। তাকে বিয়ে না করে ১৯৯৪ সালে পেলে নিজের দ্বিতীয় ঘর বাঁধেন সাইকোলজিন্ট অ্যাসারিয়া লেমসের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত সে ঘরও টিকিয়ে রাখতে পারেননি ব্রাজিলের ফুটবল কিংবদন্তি। সব মিলিয়ে পেলের সন্তানের সংখ্যা ৭ জন! পেলের অন্যতম সন্তান এডসন চলবি দো নাসিমেন্টো ‘এডিনহো’ একজন ফুটবলার ছিলেন। তিনি মূলত গোলরক্ষকের ভূমিকায় খেলতেন।
অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন ধরেই। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা তো ছিলই, কয়েক বছর ধরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল কোলন ক্যানসার। এই মরণব্যাধির সঙ্গে লড়েও কেউ কেউ জিতে যান। পেলেও লড়েছেন কয়েক বছর। কিন্তু বয়সটা যে তাঁর পক্ষে ছিল না।
লেখক : সাংবাদিক।