ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ : কেমন হবে যদি স্কুলেপড়া শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট ও টিকা গ্রহণের তথ্য একটি ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ করা হয়। যেখান থেকে শিক্ষার্থীর আইডি ব্যবহার করে যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সময় যে কারও তথ্য বের করা যাবে। এমনটি হলে সেটা কতটা সুবিধাজনক হবে?
এতে যে শুধু নির্দিষ্ট কারও উপকার হবে তা নয়, বিভিন্ন এলাকা ও ভিন্ন অর্থনীতি থেকে উঠে আসা শিশুদের এই তথ্য স্বাস্থ্য খাতে নির্দিষ্ট বিষয়ে উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে চিন্তার খোরাক জোগাবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা হলো সাশ্রয়ী মূল্যে সবার জন্য সেবা প্রদান করা, যা ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো। এমন সেবার আওতায় আসতে দেশকে একটি কৌশল নেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যবস্থাটি শুরুর করার জন্য স্কুল হতে পারে একটি দুর্দান্ত জায়গা। কারণ, শুরু থেকেই একটি দেশে সুস্থ জাতি তৈরি করতে সহায়তা করবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অর্থ হলো সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া। ২০৩২ সালে মধ্যে বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এমন লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশের প্রয়োজন এমন একটি কৌশল, যার আওতায় থাকবে সবাই। আর শিশুকাল থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনসংখ্যা গড়ে তোলা শুরুর জন্য স্কুল হতে পারে ভালো জায়গা।
২০২১ সালের নভেম্বরে সরকারের প্রকাশিত একটি সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩ কোটি শিক্ষার্থীকে স্টুডেন্ট আইডি প্রদান করা হবে। এর মাধ্যমে রোল নম্বর ব্যবস্থার মতো অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে নিরুৎসাহিত করা হবে। এই আইডিগুলো শেষ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) রূপান্তরিত হবে। এই খবরের আলোকে, আমি একটি স্কুল স্বাস্থ্য তথ্য কর্মসূচি তৈরি করেছি এবং তা যশোরের দুটি স্কুলে বাস্তবায়ন হয়েছে।
তিন মাস ধরে টানা প্রচারণা চালিয়ে এই কর্মসূচিতে স্কুলগামী ১ হাজার ৮০০ শিশুর তথ্য নথিভুক্ত করেছেন ছয় জন চিকিৎসক। এটি সম্ভব হয়েছে একজন পরোপকারী দাতার পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশাসনের সহায়তা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহযোগিতায়। যদিও এখনও তথ্য সংকলনের কাজ চলছে। কিন্তু এখানে কিছু প্রাথমিক অনুসন্ধান আমি তুলে ধরছি।
স্কুলগামী শিশুদের ভালোভাবে বেড়ে ওঠা পর্যবেক্ষণ করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশের বয়স শূন্য থেকে ২৪ বছর, ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে রয়েছে আরও ৪০ শতাংশ। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্যমতে, বাংলাদেশের ২৭.৬ গড় বয়সের তরুণ প্রজন্মকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফায় পরিণত করা সম্ভব- যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের গুরুত্বারোপ করে বিনিয়োগ করা যায়।
স্কুল শিশুদের স্বাস্থ্যে নজরদারির ফলে অল্প বয়সেই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত হবে। পাশাপাশি শিখনের সমস্যা, ঝরে পড়া ঠেকাতে স্কুলে উপস্থিতি বাড়াতে সহায়তা করা, স্বাস্থ্য বৈষম্য হ্রাস এবং শিশুদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে ভূমিকা রাখবে। এটিকে প্রাথমিক যতœ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যেখানে একটি সুপারিশ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাজের চাপ কমানোর জন্য ছাঁকুনি হিসেবে কাজ করবে। স্কুল শিশুদের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ মূলত একটি জাতি গঠনের প্রচেষ্টা। যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে।
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ডিজিটাইজেশন কীভাবে কাজ করবে? কীভাবে সহায়তা করবে?
৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী সব শিক্ষার্থীর শারীরিক পরীক্ষার সঙ্গে চিকিৎসা, টিকা এবং পরিবারের ইতিহাস নেওয়ার জন্য চিকিৎসক নিয়োগ করা হবে। স্বাস্থ্য তথ্যের আইন মেনে পরিকল্পিতভাবে সব তথ্য সংগ্রহ হবে ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ডে। এই তথ্য থেকে বিভিন্ন প্রবণতা নির্দিষ্ট করা হবে, যা একাধিক খাতের উন্নয়নের জন্য সুবিধাজনক হবে।
যশোরের ‘স্কুল প্রোগ্রাম’ স্কুলের শিশুদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাজির করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যেসব শিশুকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তাদের ৮৫ শতাংশ সাঁতার জানে না। বাংলাদেশে শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। শিশুদের সাঁতার শেখার দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য একটি কার্যক্রম শুরু করা যেতেই পারে; সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রায় ৬৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়, এজন্য স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে সক্ষমতা বাড়াতে পারে; গলা ব্যথা এবং কাশি শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ার চেয়ে বেশি। খাদ্য ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে যে আরও সচেতন হতে হবে, এটি তারই ইঙ্গিত। শিশুদের আরও ভিটামিন সি এবং ফ্লু টিকা প্রদানের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা যায়।
যদিও সব অভিভাবক দাবি করেছেন, তাদের সন্তানের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু খুব কম সংখ্যক টিকা কার্ড দেখাতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে টিকাদানের সময়সূচি ও সম্পন্ন করার জন্য একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবস্থা হতে পারে। এই কর্মসূচিতে আরও উঠে এসেছে, অভিভাবকদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ বেশি। এতে অসংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা উঠে আসছে।
অন্যান্য দেশে স্কুলস্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি সাধারণ চর্চা?
এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক। ১৯২১ সালে সিঙ্গাপুরে সুস্থ এবং উৎপাদনশীল জনসংখ্যা গড়ে তুলতে স্কুল স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের এমন উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত দেশটির কাজে লাগে। মালয়েশিয়া ১৯৭৫ সাল থেকে সব সরকারি এবং সরকারি সহায়তা পাওয়া স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের ‘স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম’-এ প্রতিটি স্কুলে দুজন শিক্ষককে ‘স্বাস্থ্য ও সুস্থতার দূত’ নিয়োগ করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় অঞ্চলের ৫৩টি সদস্য রাষ্ট্রকে তাদের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্কুল হেলথ সার্ভিসের বিকাশ ও টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
বাংলাদেশ কি পারবে স্কুলস্বাস্থ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে?
অনেকেরই হয়তো অজানা, ১৯৫১ সাল থেকেই বাংলাদেশে একটি স্কুল হেলথ কর্মসূচি রয়েছে। ২৩টি স্কুল হেলথ ক্লিনিকের মধ্যে ২১টি জেলা এবং দুটি উপজেলা পর্যায়ে। জেলা সিভিল সার্জনের অধীনে প্রতিটি ক্লিনিকের জন্য দুজন মেডিকেল কর্মকর্তা, একজন ফার্মাসিস্ট এবং একজন মেডিকেল সহকারী কাজ করছেন। তবে এই পুরো কর্মসূচিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যদি যশোরের ৬ জন চিকিৎসক ডাটা এন্ট্রি টিমের সঙ্গে একটি ওয়েব পোর্টালে ১ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থীর তথ্য সংকলন করতে পারেন, সেক্ষেত্রে সরকার অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবার চ্যানেল সম্প্রসারণে স্কুল হেলথ রেকর্ড কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য একটি জাতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপ নিতেই পারে।
এই যেমন ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের ভ্যাকসিনের তথ্যসহ (সুরক্ষা অ্যাপটি) ইতোমধ্যে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এটি থেকে পাওয়া ডাটা অবশ্যই স্বাস্থ্যের ফলাফল উন্নতি, প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ এবং পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সর্বজনীন বিষয়ে এতে যোগ করা যেতে পারে এবং আইসিটি মন্ত্রণালয় এটি সহজেই করতে পারবে।
আমরা যখন একটি স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তখন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। স্বাস্থ্য উন্নয়নের মূলে থাকা উচিত তথ্যের ভিত্তিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশের একজন তরুণের গড় হিসেবে জীবনের অনেকটাই বাকি। ফলে তরুণ ও তাদের সন্তানদের জন্য আরও আধুনিক ডিজিটাল স্বাস্থ্য খাতের মসৃণ রূপান্তর নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার ওপর।
লেখক : অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।
প্লিজ, নার্সের কাছে যাও
                                 ট্যাগস :  
                                প্লিজ                            
							
                            
                                      জনপ্রিয় সংবাদ                                
                                 
																			 
										

























