ড. নিজামউদ্দিন জামি : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ (০৪ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম সফর করবেন। এটা চট্টগ্রামের মানুষের জন্য বাঁধভাঙ্গা আনন্দের সংবাদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, চট্টগ্রামের ৯২ লক্ষ মানুষের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিবাদন ও শুভেচ্ছা জানাই। বিজয়ের মাসে আপনার আগমন আমাদের প্রাণিত করেছে, ধন্য করেছে। আপনি আঠারো কোটি বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। আপনি বিশ^সভায় বাংলাদেশকে উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। জাতি হিসেবে যা আমাদের জন্য পরম পাওয়া। আপনার সততা, সাহস ও কর্ম আমাদের আশাবাদী করেছে। বাঁচার প্রেরণা দিচ্ছে। আপনার বীরোচিত, যুগোপযোগী ও দূরদর্শি নেতৃত্বে খরা, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ থেকে জাতি বারবার রক্ষা পেয়েছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আপনি তাঁরই সুযোগ্য পবিত্র রক্তধারা। আপনি দিয়েছেন মাথাউঁচু করে এগিয়ে যাবার শক্তি, সাহস ও সামর্থ্য। আনন্দের এ দিনে স্মরণ করছি, বঙ্গবন্ধুসহ বাংলাদেশের জন্য যাঁরা যখন যেখানে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের প্রত্যেককে। সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি। আপনার কর্মমুখর দীর্ঘ ও সুস্থজীবন কামনা করি। বাঙালি জাতির আরাধ্য উন্নয়নের ইতিহাস লেখা হোক আপনার হাতে।
চট্টগ্রামকে একদা ‘প্রাচ্যের রানী’ বলা হতো। কেউ কেউ বলতেন চাটগাঁ, কেউ কেউ বলতেন ইসলামাবাদ। আবার কেউ এসে নাম দিয়েছেন চিটাগং। যে যাই বলুন, চট্টগ্রাম হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সমুদ্র-পাহাড় উপত্যকা বিশাল বনাঞ্চল নিয়ে গঠিত এ মানবাবাস। এ দিক থেকে বলা যায় চট্টগ্রাম এক বিশ^পল্লী! এর রয়েছে সুদীর্ঘকালের ইতিহাস। এখানকার মানুষের ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস সবকিছুতেই বৈশি^ক ছোঁয়া স্পষ্ট। চট্টগ্রামের জনজীবনে বন্দরকেন্দ্রিক নানা প্রভাব স্বীকার্য। চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা প্রভৃতিতে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সারল্য। এখানকার মানুষের জীবনের বিত্তবৈভব চিত্তজয়ী। এর ইতিহাস সমৃদ্ধ ও সুদীর্ঘ।
চট্টগ্রাম থেকেই জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণা বারবার প্রচারিত হয়েছে। জাতির পিতা ‘৬-দফা’র প্রচার ও ব্যাখ্যা শুরু করেছিলেন এ চট্টগ্রাম থেকে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহচরদের রাজনৈতিক জীবনের অনেক স্মৃতির আর্কাইভ এ চট্টগ্রাম। মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছাড়াও অনেক বীরের জন্ম দিয়েছে বীরপ্রসবিনী চট্টলা। চট্টগ্রামকে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি বলা হয়। এখানে শুয়ে আছেন ‘বেলায়তে মোতলাকায়ে আহমদি’ যুগের প্রবর্তক গাউসুল আজম সৈয়দ আহমদউল্লাহ মাইজভা-ারি (ক), ইউসুফেসানি খ্যাত হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভা-ারি (ক)। অসংখ্য পির-ফকিরের আদর্শভূমি এ চট্টগ্রাম। এখানকার মানুষ নৃতাত্ত্বিকভাবেই সহজ-সরল, অকপট, সাহসী, বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের নিরাপদ আবাসভূমি এ চট্টগ্রাম। ইতিহাসজয়ী বিশ^পল্লী চট্টগ্রাম আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। আঠারো কোটি মানুষের বিশ^স্ত ও সংবেদনশীল অভিভাবক হিসেবে আপনার বরাবরে ১৫টি দাবি উত্থাপন করছি। যে দাবির সাথে চট্টগ্রামে ৯৮ শতাংশ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আপনার সুদৃষ্টি ও সুবিবেচনা প্রত্যাশা করি। দাবিসমূহ :
০১. বর্ষায় চট্টগ্রাম শহর জলজটের শহরে পরিণত হয়। প্রতিবছর শহরের অসংখ্য মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শহরকে জলজটমুক্ত করতে দ্রুত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
০২. শহরের ফুসফুসখ্যাত ‘সিআরবি’ নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করছে। সিআরবিকে সকলপ্রকার দখলমুক্ত করে ন্যাশনাল হেরিটেজ হিসেবে স্থায়ী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
০৩. স্পর্শকাতর ঐতিহাসিক ‘কালুরঘাট বহুমুখী সেতু’ ও ‘নাজিরহাট হালদা সেতু’ দ্রুত পুননির্মাণ করুন।
০৪. চট্টগ্রামের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই নাজুক, নাই বললেই চলে! এখানে মজুদদারি ও অতিরিক্ত মুনাফাখোর খুবই সরব। তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য আপনার হস্তক্ষেপ চায় চট্টগ্রামবাসী।
০৫. সিটি কর্পোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স শুধু সকল রেকর্ড ভঙ্গই করেনি; উপরন্তু বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ। হোল্ডিং ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে আনতে আপনার হস্তক্ষেপ চায় চট্টলবাসী।
০৬. বাড়ি ভাড়া নিয়ে মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যে বহুদিন ধরে নৈরাজ্য চলছে। এ বিষয়ে একটি মান্য নীতিমালা ও প্রণয়ন আবশ্যক।
০৭. নাজিরহাট-খাগড়াছড়ি সড়ক এখন মৃত্যুপুরী। দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
০৮. হালদা ও কর্ণফুলীকে দুষণ ও দখলমুক্ত রাখতে আপনার যুগোপযোগী হস্তক্ষেপ চায় চট্টলবাসী।
০৯. শিক্ষিত বেকারদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করুন।
১০. নগরীর সড়ক-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির ‘রোড-পারমিট’ বাতিল করুন।
১১. চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত আর্ট কলেজকে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় অধিভুক্ত করে চারুকলা ইন্সটিটিউট করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় সম্প্রতি চারুকলা ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম ক্যাম্পাসে নিয়ে গেছে। কিন্তু চারুকলা কলেজ কিংবা ইনস্টিটিউট বাতিল করে সেখানে এলিট শ্রেণির জন্য অভিজাত ক্লাব প্রতিষ্ঠার খবরে চট্টগ্রামের জনমনে বিস্তর অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। চারুকলা কলেজ আলাদাভাবে চালু রাখার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে চট্টগ্রামবাসী। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে প্রখ্যাত শিল্পী রশীদ চৌধুরী, মুর্তাজা বশীর, সবিহ উল আলম, হাসি চক্রবর্তীসহ অসংখ্য গুণীশিল্পীদের আবেগ-অনুভূতি, শ্রম ও মেধা। তাছাড়া চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চারুকলা কলেজের অবদান অনস্বীকার্য। পুরনো চারুকলা কলেজ চালু রাখার জন্য আপনার হস্তক্ষেপ কাম্য।
১২. চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ‘সি-বিচে’ টিকেট সিস্টেম চালুর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে! মানুষের বিনোদন কেন্দ্র দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। চট্টগ্রামে বিনোদন কেন্দ্র খুব একটা নেই। তাই সি-বিচকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রেখে তার শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করতে আপনার দৃষ্টিআকর্ষণ করছে চট্টলবাসী।
১৩. চট্টগ্রামের ভাষা-সংগ্রামী, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের নামে নগরের সড়কগুলো করার দাবি জানাচ্ছে।
১৪. চট্টগ্রামে একটি ‘সাংস্কৃতিক বিশ^বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করুন।
১৫. চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিকমানের একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করুন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার এ সফর চট্টগ্রামবাসীর জন্য বয়ে আনুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে আপনার অর্থনৈতিক সংগ্রাম সফল হোক, এটাই প্রত্যাশা করি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা। হরুধসঁফফরহ.লধসর৬৯@মসধরষ.পড়স
বিশ^পল্লী চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী : জনগণের ১৫ দাবি
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ


























