ঢাকা ০১:১৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কি একটি ইউটোপিয়ান ধারণা?

  • আপডেট সময় : ০৭:৪২:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
  • ১১ বার পড়া হয়েছে

জুবায়ের বাবু

অনেকেই মনে করেন বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনি ব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) মডেলটি একটি অন্যতম অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক মডেল। তারা মনে করেন এই ব্যবস্থার অধীনে, রাজনৈতিক দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার অনুপাতে সঠিক ও ন্যায্য আসন লাভ করবে, যা ভোটারদের পছন্দের প্রতিফলন ঘটাবে। কিছু দেশে, বিশেষ করে বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠী এবং বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধিকারী দেশগুলোতে, ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য পিআর ব্যবস্থার বিভিন্ন মডেল ব্যবহার করছে।

ওই দেশগুলোয় স্থানীয় সরকার কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে অথবা পূর্ব থেকেই স্থানীয় সরকার একটি শক্তিশালী কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জন জনগণ বাঙালি, প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ধর্মীয় দিক থেকে শতকরা ৯১ ভাগ মানুষ মুসলমান এবং পুরো দেশে গড়ে উঠেছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ভিত্তি। যুগ যুগ ধরে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, কাবিখাতেই আটকে আছে। ব্যবস্থা উন্নয়নে নেই কোনো কার্যকর রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

গণতন্ত্রের তীর্থভূমি যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৫ সালে, কিন্তু এর প্রকৃত সুফল পেতে শুরু করে ১৮৮৮ সালে স্থানীয় সরকার আইনে কাউন্টি কাউন্সিল শুরুর মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের হাতে আসে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো, ফলে ১৯৭২ সালে আইনটি নতুন করে তৈরি করা হয় এবং ১৯৯০ এর দশকে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হয়ে ওঠে অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের মতো একটি ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ১৫০ বছরের চেয়েও বেশি সময় লেগেছে যুক্তরাজ্যের মতো একটি দেশের।

বাংলাদেশের মতো দেশে এই ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় না আসা পর্যন্ত বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা অনেক কার্যকর। কেননা স্থানীয় রাজনীতিবিদ না থাকলে এই অঞ্চলের জনগণের হয়ে কথা বলার আর কেউ থাকবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে কী ধরনের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চাই? আমাদের জনগণ কি এই পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত? এই পদ্ধতির জটিল সমীকরণ কি আমাদের সাধারণ জনগণ বুঝবে? তার সুফল-কুফল সম্পর্কে তারা কতা জানে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই পদ্ধতি কি আদৌ আমাদের প্রয়োজন আছে?

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হলো একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা- যেখানে দলগুলো নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের ওপর ভিত্তি করে আসন পায়। যদি কোনো দল ২৫ শতাংশ ভোট পায়, তবে সেই দল সংসদে ২৫ শতাংশ আসন পাবে। এই পদ্ধতিটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রচলিত ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) মডেলের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে- যেখানে একটি নির্বাচনি এলাকায় সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত প্রার্থী জয়ী হন।

যেহেতু পিআরের অনেকগুলো মডেল রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশে, বাংলাদেশের জন্য কোন মডেল হবে সেই বিষয়ে প্রস্তাব করা কোনও স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারছেন না। ফলে তৈরি হচ্ছে ধূম্রজাল, জন্ম হচ্ছে অনেক প্রশ্নের।

প্রথমত কে কোন আসন নেবে, তা নির্ধারণের উপায় কী? ধরুন, ঢাকা-১ আসনে ‘ক পার্টি’ ও ‘খ পার্টি’র প্রার্থী দুজনেই ৩০ শতাংশ করে ভোট পেয়েছে। ‘ক পার্টি’ সারাদেশে ভোট পেয়েছে ৩৪ শতাংশ আর ‘খ পার্টি’ পেয়েছে ০.৩৪ শতাংশ, সেই হিসাবে ৩০০ আসনের বিপরীতে সংসদে ‘খ পার্টি’ ১ টি আসন পাবে।

যদি উভয় দলই ঢাকা-১ আসনটি দাবি করে বসে, তাহলে এর সমাধান কি? ধরে নিচ্ছি, ‘খ পার্টি’ কে দেওয়া হলো সেই আসন এবং সেখানে তেঁতুলিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ‘তেতুল মিয়া’কে সংসদ সদস্য করে সংসদে পাঠানো হলো যার ঢাকা-১ আসনের জনগণের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। জনগণ চেনে না তাদের সংসদ সদস্যকে, সংসদ সদস্যও চেনে না তার জনগণ কে।

এই যে সংসদ সদস্য নিয়োগের সর্বময় ক্ষমতা দলের প্রধানদের হাতে চলে যাবে এর উপায় কী? তখন কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য নয়, সরাসরি সংসদ সদস্য নিয়েগে শত কোটি টাকার বাণিজ্য হবে না তার গ্যারান্টি কী?

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেলে একটি দল সংসদে প্রতিনিধি দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে, তার কোনো প্রস্তাবনা নেই এই পিআর প্রস্তাবকদের কাছে। অনেক দেশে এই বিষয় একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড রয়েছে, যেমন ন্যূনতম ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ ভোট পাওয়ার বাধ্যবাধকতা। তাহলে বাংলাদেশের যে ছোট ছোট দল রয়েছে, যাদের ভোট সংখ্যা ১ শতাংশের কম, তাদের হিসাব কী হবে?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্থানীয় অনেক জনপ্রিয় এবং যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন, যারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে জয়ী হয়ে তার অঞ্চলের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা এক চরম বৈষম্য তৈরি করবে এবং এই সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে তার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই তাদের কাছে।

যেহেতু সারাদেশের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের ওপর আসন নির্ভর করবে, সেক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ধারণ সংসদ সদস্য। ফলে তৃণমূলের নেতৃত্ব তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে অচিরেই। দেশের রাজনীতি হয়ে পড়বে রাজধানী নির্ভর, দলের রাজনীতি হয়ে পড়বে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ভর।

এফপিটিপি বা বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের জনসংযোগ করা কিংবা এলাকার মানুষের পাশে থাকা তার আদর্শিক রাজনীতির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে জনগণও দলীয় পরিচয়ের বাইরে ব্যক্তির পরিচয়কেও প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তারা আশা করেন, সুখে-দুঃখে এলাকার সংসদ সদস্য তাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। যেহেতু দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুর্বল কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেহেতু আইন প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি তারাই ওই অভাবটা কিছতা পূরণ করবেন।

পিআর পদ্ধতির পক্ষের একটি যুক্তি এখানে বারবার তারা উল্লেখ করে। আর তা হলো ‘ভোটের অপচয়’। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের কিছু স্থানীয় নির্বাচনের মতোই একাধিক প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার মডেলটি দেখা যেতে পারে। সংযোজিত হতে পারে প্রথম পছন্দ, দ্বিতীয় পছন্দ এবং তৃতীয় পছন্দের মতো বিষয়। আমি একটি দলের পক্ষে ভোট দিয়েছি তার মানে এই নয় যে আমি অন্য প্রার্থীর বিজয়ের বিপক্ষে। এই ধরনের ভাবনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

‘পিআর’ কেন বাংলাদেশের জন্য একটি আদর্শিক ধারণা নয়? এ প্রশ্নটি আসতেই পারে।

প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি না করলে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। ফলে প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে ক্ষমতার বাইরে এবং সু-শাসনকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

দ্বিতীয়ত, অসংখ্য ছোট দল নিয়ে একটি খণ্ডিত সংসদ তৈরির ঝুঁকি বাড়বে ফলে জাতীয় সংসদ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং গঠিত হতে পারে একটি দুর্বল সরকার। যে কোনও সময় সংসদে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে এবং জনমুখী আইন প্রণয়নে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। টাকার বিনিময়ে ফ্লোর ক্রসিংয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

তৃতীয়ত, তৈরি হতে পারে রাষ্ট্রের দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বাংলাদেশে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই পক্ষপাতদুষ্টতা এবং অদক্ষতার অভিযোগে অভিযুক্ত। একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক মেরুদণ্ড ছাড়া দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

চতুর্থত, দলের দক্ষতা, সক্ষমতা, প্রজ্ঞা বা নীতিমালা না দেখেই শুধু দলীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ভোটদানকে উৎসাহিত করা বেড়ে যাবে। ফলে দেশের উন্নয়ন থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়ে পড়বে রাজনীতিতে।

পঞ্চমত, প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর প্রান্তিক নেতাকর্মীদের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, জনগণের সাথে রাজনৈতিক দলের দূরত্ব বাড়বে।

ষষ্টত, এই পদ্ধতিতে কালো টাকায় অসংখ্য ছোট দল তৈরি করে ভোট কেনার প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা বাড়তে পারে। কেদ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো সংসদ সদস্য কেনা-বেচায় তৎপর হয়ে উঠতে পারে।

সবদিক বিবেচনায় পিআর পদ্ধতি এই মুহূর্তে একটি ইউটোপিয়ান ধারণা মনে হলেও এই নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, পর্যালোচনা চলতেই পারে। পরবর্তী সংসদে এই বিষয়ে আলোচনাকে উৎসাহিত করে ভবিষ্যতের পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য সময় উপযোগী একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তৈরির ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি তৈরি করা এখন থেকেই ভাবতে হবে যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিনির্মানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, এমন কোনও মিশ্র নির্বাচনি ব্যবস্থা: ঋচঞচ এবং চজ (জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ডের মতো) মডেলে যেখানে দল, প্রার্থী এবং ভোটারের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআরের কিছু মডেল পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ইউটোপিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে মনে হতে পারে। যতক্ষণ না গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি শক্তিশালী না হয়, দেশে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন, ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান এবং জনসাধারণের আস্থায় না আসে, ততক্ষণ এই ধরনের নতুন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা কঠিন। কেন ইউটোপিয়ান বলছি, কিছু মানুষের বক্তব্যে মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশের সকল সমস্যার সমাধান এই পিআর পদ্ধতির জন্য আটকে আছে।

ঠিক ইউটোপিয়ান ধারণার মতো পিআর হলেই সমাজে আর কোনও সমস্যা থাকবে না, সর্বত্র সুখ আর শান্তি বিরাজ করবে। তারা ‘পিআর’ পদ্ধতিকে অনেকটা ঠিক সেভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে।

তবুও ইউটোপিয়ান ধারণা মাঝে মাঝে কিছু উদ্দেশ্য পূরণ করে। সমাজকে আরও ভালো ভবিষ্যতের কল্পনা করতে বাধ্য করে। ঠিক তেমনি যেন সঠিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ।

লেখক: নির্মাতা, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

যে ভাইকে জেল থেকে বের করেছি, সেই আমার স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করল…

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কি একটি ইউটোপিয়ান ধারণা?

আপডেট সময় : ০৭:৪২:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

জুবায়ের বাবু

অনেকেই মনে করেন বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনি ব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) মডেলটি একটি অন্যতম অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক মডেল। তারা মনে করেন এই ব্যবস্থার অধীনে, রাজনৈতিক দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার অনুপাতে সঠিক ও ন্যায্য আসন লাভ করবে, যা ভোটারদের পছন্দের প্রতিফলন ঘটাবে। কিছু দেশে, বিশেষ করে বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠী এবং বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধিকারী দেশগুলোতে, ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য পিআর ব্যবস্থার বিভিন্ন মডেল ব্যবহার করছে।

ওই দেশগুলোয় স্থানীয় সরকার কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে অথবা পূর্ব থেকেই স্থানীয় সরকার একটি শক্তিশালী কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জন জনগণ বাঙালি, প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ধর্মীয় দিক থেকে শতকরা ৯১ ভাগ মানুষ মুসলমান এবং পুরো দেশে গড়ে উঠেছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ভিত্তি। যুগ যুগ ধরে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, কাবিখাতেই আটকে আছে। ব্যবস্থা উন্নয়নে নেই কোনো কার্যকর রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

গণতন্ত্রের তীর্থভূমি যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৫ সালে, কিন্তু এর প্রকৃত সুফল পেতে শুরু করে ১৮৮৮ সালে স্থানীয় সরকার আইনে কাউন্টি কাউন্সিল শুরুর মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের হাতে আসে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো, ফলে ১৯৭২ সালে আইনটি নতুন করে তৈরি করা হয় এবং ১৯৯০ এর দশকে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হয়ে ওঠে অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের মতো একটি ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ১৫০ বছরের চেয়েও বেশি সময় লেগেছে যুক্তরাজ্যের মতো একটি দেশের।

বাংলাদেশের মতো দেশে এই ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় না আসা পর্যন্ত বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা অনেক কার্যকর। কেননা স্থানীয় রাজনীতিবিদ না থাকলে এই অঞ্চলের জনগণের হয়ে কথা বলার আর কেউ থাকবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে কী ধরনের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চাই? আমাদের জনগণ কি এই পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত? এই পদ্ধতির জটিল সমীকরণ কি আমাদের সাধারণ জনগণ বুঝবে? তার সুফল-কুফল সম্পর্কে তারা কতা জানে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই পদ্ধতি কি আদৌ আমাদের প্রয়োজন আছে?

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হলো একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা- যেখানে দলগুলো নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের ওপর ভিত্তি করে আসন পায়। যদি কোনো দল ২৫ শতাংশ ভোট পায়, তবে সেই দল সংসদে ২৫ শতাংশ আসন পাবে। এই পদ্ধতিটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রচলিত ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) মডেলের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে- যেখানে একটি নির্বাচনি এলাকায় সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত প্রার্থী জয়ী হন।

যেহেতু পিআরের অনেকগুলো মডেল রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশে, বাংলাদেশের জন্য কোন মডেল হবে সেই বিষয়ে প্রস্তাব করা কোনও স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারছেন না। ফলে তৈরি হচ্ছে ধূম্রজাল, জন্ম হচ্ছে অনেক প্রশ্নের।

প্রথমত কে কোন আসন নেবে, তা নির্ধারণের উপায় কী? ধরুন, ঢাকা-১ আসনে ‘ক পার্টি’ ও ‘খ পার্টি’র প্রার্থী দুজনেই ৩০ শতাংশ করে ভোট পেয়েছে। ‘ক পার্টি’ সারাদেশে ভোট পেয়েছে ৩৪ শতাংশ আর ‘খ পার্টি’ পেয়েছে ০.৩৪ শতাংশ, সেই হিসাবে ৩০০ আসনের বিপরীতে সংসদে ‘খ পার্টি’ ১ টি আসন পাবে।

যদি উভয় দলই ঢাকা-১ আসনটি দাবি করে বসে, তাহলে এর সমাধান কি? ধরে নিচ্ছি, ‘খ পার্টি’ কে দেওয়া হলো সেই আসন এবং সেখানে তেঁতুলিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ‘তেতুল মিয়া’কে সংসদ সদস্য করে সংসদে পাঠানো হলো যার ঢাকা-১ আসনের জনগণের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। জনগণ চেনে না তাদের সংসদ সদস্যকে, সংসদ সদস্যও চেনে না তার জনগণ কে।

এই যে সংসদ সদস্য নিয়োগের সর্বময় ক্ষমতা দলের প্রধানদের হাতে চলে যাবে এর উপায় কী? তখন কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য নয়, সরাসরি সংসদ সদস্য নিয়েগে শত কোটি টাকার বাণিজ্য হবে না তার গ্যারান্টি কী?

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেলে একটি দল সংসদে প্রতিনিধি দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে, তার কোনো প্রস্তাবনা নেই এই পিআর প্রস্তাবকদের কাছে। অনেক দেশে এই বিষয় একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড রয়েছে, যেমন ন্যূনতম ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ ভোট পাওয়ার বাধ্যবাধকতা। তাহলে বাংলাদেশের যে ছোট ছোট দল রয়েছে, যাদের ভোট সংখ্যা ১ শতাংশের কম, তাদের হিসাব কী হবে?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্থানীয় অনেক জনপ্রিয় এবং যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন, যারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে জয়ী হয়ে তার অঞ্চলের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা এক চরম বৈষম্য তৈরি করবে এবং এই সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে তার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই তাদের কাছে।

যেহেতু সারাদেশের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের ওপর আসন নির্ভর করবে, সেক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ধারণ সংসদ সদস্য। ফলে তৃণমূলের নেতৃত্ব তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে অচিরেই। দেশের রাজনীতি হয়ে পড়বে রাজধানী নির্ভর, দলের রাজনীতি হয়ে পড়বে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ভর।

এফপিটিপি বা বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের জনসংযোগ করা কিংবা এলাকার মানুষের পাশে থাকা তার আদর্শিক রাজনীতির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে জনগণও দলীয় পরিচয়ের বাইরে ব্যক্তির পরিচয়কেও প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তারা আশা করেন, সুখে-দুঃখে এলাকার সংসদ সদস্য তাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। যেহেতু দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুর্বল কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেহেতু আইন প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি তারাই ওই অভাবটা কিছতা পূরণ করবেন।

পিআর পদ্ধতির পক্ষের একটি যুক্তি এখানে বারবার তারা উল্লেখ করে। আর তা হলো ‘ভোটের অপচয়’। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের কিছু স্থানীয় নির্বাচনের মতোই একাধিক প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার মডেলটি দেখা যেতে পারে। সংযোজিত হতে পারে প্রথম পছন্দ, দ্বিতীয় পছন্দ এবং তৃতীয় পছন্দের মতো বিষয়। আমি একটি দলের পক্ষে ভোট দিয়েছি তার মানে এই নয় যে আমি অন্য প্রার্থীর বিজয়ের বিপক্ষে। এই ধরনের ভাবনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

‘পিআর’ কেন বাংলাদেশের জন্য একটি আদর্শিক ধারণা নয়? এ প্রশ্নটি আসতেই পারে।

প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি না করলে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। ফলে প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে ক্ষমতার বাইরে এবং সু-শাসনকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

দ্বিতীয়ত, অসংখ্য ছোট দল নিয়ে একটি খণ্ডিত সংসদ তৈরির ঝুঁকি বাড়বে ফলে জাতীয় সংসদ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং গঠিত হতে পারে একটি দুর্বল সরকার। যে কোনও সময় সংসদে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে এবং জনমুখী আইন প্রণয়নে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। টাকার বিনিময়ে ফ্লোর ক্রসিংয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

তৃতীয়ত, তৈরি হতে পারে রাষ্ট্রের দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বাংলাদেশে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই পক্ষপাতদুষ্টতা এবং অদক্ষতার অভিযোগে অভিযুক্ত। একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক মেরুদণ্ড ছাড়া দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

চতুর্থত, দলের দক্ষতা, সক্ষমতা, প্রজ্ঞা বা নীতিমালা না দেখেই শুধু দলীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ভোটদানকে উৎসাহিত করা বেড়ে যাবে। ফলে দেশের উন্নয়ন থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়ে পড়বে রাজনীতিতে।

পঞ্চমত, প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর প্রান্তিক নেতাকর্মীদের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, জনগণের সাথে রাজনৈতিক দলের দূরত্ব বাড়বে।

ষষ্টত, এই পদ্ধতিতে কালো টাকায় অসংখ্য ছোট দল তৈরি করে ভোট কেনার প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা বাড়তে পারে। কেদ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো সংসদ সদস্য কেনা-বেচায় তৎপর হয়ে উঠতে পারে।

সবদিক বিবেচনায় পিআর পদ্ধতি এই মুহূর্তে একটি ইউটোপিয়ান ধারণা মনে হলেও এই নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, পর্যালোচনা চলতেই পারে। পরবর্তী সংসদে এই বিষয়ে আলোচনাকে উৎসাহিত করে ভবিষ্যতের পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য সময় উপযোগী একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তৈরির ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি তৈরি করা এখন থেকেই ভাবতে হবে যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিনির্মানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, এমন কোনও মিশ্র নির্বাচনি ব্যবস্থা: ঋচঞচ এবং চজ (জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ডের মতো) মডেলে যেখানে দল, প্রার্থী এবং ভোটারের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআরের কিছু মডেল পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ইউটোপিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে মনে হতে পারে। যতক্ষণ না গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি শক্তিশালী না হয়, দেশে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন, ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান এবং জনসাধারণের আস্থায় না আসে, ততক্ষণ এই ধরনের নতুন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা কঠিন। কেন ইউটোপিয়ান বলছি, কিছু মানুষের বক্তব্যে মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশের সকল সমস্যার সমাধান এই পিআর পদ্ধতির জন্য আটকে আছে।

ঠিক ইউটোপিয়ান ধারণার মতো পিআর হলেই সমাজে আর কোনও সমস্যা থাকবে না, সর্বত্র সুখ আর শান্তি বিরাজ করবে। তারা ‘পিআর’ পদ্ধতিকে অনেকটা ঠিক সেভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে।

তবুও ইউটোপিয়ান ধারণা মাঝে মাঝে কিছু উদ্দেশ্য পূরণ করে। সমাজকে আরও ভালো ভবিষ্যতের কল্পনা করতে বাধ্য করে। ঠিক তেমনি যেন সঠিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ।

লেখক: নির্মাতা, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ