মনজুরুল আলম মুকুল
ব্রিটিশরা বাণিজ্যের ছদ্মবেশে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বিশ্বাসঘাতক চক্রান্তকারীদের কারণে পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩ হাজার ২০০ সৈন্যের কাছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজার সৈন্যের অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। এরপর ধীরে ধীরে ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করে। ১৯ শতক থেকে ২০ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ভারত উপমহাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, কানাডা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলসহ পৃথিবীর অনেক এলাকা।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশালতা এমন পর্যায় দাঁড়ায় যে তখন এই বাক্যটি প্রচলিত হয়ে ওঠে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না।’ ব্রিটিশদের ক্ষমতা, বিশ্বব্যাপী উপস্থিতি, যুদ্ধ কৌশল, কূটবুদ্ধি, সমরাস্ত্র, অর্থ সম্পদসহ সব দিক থেকে এমন পর্যায় পৌঁছায় ছিল যে, অনেকের মনে এমন ধারণা জন্মেছিল ব্রিটিশ সিংহ কোনো দিন পরাজিত হয় না, তারা অপরাজেয়। ১৭৫৭ সালের পর থেকে প্রায় একশ বছর এই ধারণায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে ছিল ভারতীয়রা। মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়েছিল এই ভেবে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কী হবে, তাদেরকে পরাজিত করা যাবে না, অতএব স্বাধীনতা আসবে না। আর এই ধারণার বিরুদ্ধে প্রথম প্রচার শুরু ছিল করেন আজিমুল্লাহ খাঁ। যাকে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের আদর্শ, কূটনীতিতে নেতৃত্বদানকারী ও বিদ্রোহের দূত বলেই অভিহিত করা হয়ে থাকে।
মারাঠা নেতা নানা সাহেবের অনুরোধে ১৮৫৩ সালে লন্ডনে যান পেনশন পুনর্বহালের জন্য। তৎকালীন ব্রিটিশ কোম্পানি যখন সাফ সাফ জানিয়ে দেয় যে, কোনো পেনশন দেওয়া হবে না। তখন আজিমুল্লাহ খান চরম ব্যথিত ও হতাশ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশদের প্রতি চরম মাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়ে ভারত থেকে তাদের হটিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তায় লিপ্ত হন। আজিমুল্লাহ খাঁ ভারতে ফিরে না এসে, নেমে পড়েন ইংরেজ শক্তির দুর্বলতা খুঁজতে। তিনি প্রথমে যান তুরস্কের তৎকালীন রাজধানী কনিস্ট্যান্টিপোলে। সেখান থেকে দ্রুত চলে যান ক্রিমিয়ার যুদ্ধ দেখার জন্য। এক দিকে ছিল তুরস্ক, ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও ইতালি অন্যদিকে ছিল রাশিয়া। বলাকান অঞ্চলের সেবাস্তপালে রাশিয়ার বাহিনী ইংরেজদের দারুণভাবে মার দিয়েছিল। আজিমুল্লাহ গোপনে গোপনে ইংরেজদের বিভিন্ন দুর্বলতা পর্যবেক্ষণ করেন।
১৮৫৪ সালে আজিমুল্লাহ ভারতে ফিরে এসে নানা সাহেবসহ অন্যান্যদের বোঝাতে সক্ষম হয় ব্রিটিশদেরও আঘাত ও পরাস্ত করা জয়। রীতিমত ‘পায়াম-ই-আজাদী’ নামে একটি পত্রিকা খুলে প্রচার শুরু করেন। ফলাফল, পরাক্রমশালী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ। সফল না হলেও, যে প্রত্যাঘাত শুরু হয়ে ছিল, যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল তা পরবর্তীতে অব্যাহত থাকে। এক সময় ব্রিটিশ শাসকদের অহংকারে আঘাত হানে এবং উপমহাদেশে তাদের অপরাজেয় ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে শক্তি বা বল প্রয়োগের নীতি এখন শান্তির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তির নিজস্ব একটি প্রকৃতি ও রূপ আছে। যুগে যুগে মানবজাতি সেটা অর্জনের চেষ্টা করেছে। শান্তিপূর্ণ সমাজে থাকে না সংঘাত, হিংসা, অস্থিরতা আর বিভেদ।
বর্তমান বিশ্বে দখলদার ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শান্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে। যার কাছে পারমাণবিক অস্ত্রসহ অন্যান্য মারণাস্ত্র আছে, অত্যাধুনিক ফাইটার জেট, ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাবমেরিন, শক্তিশালী সেনাবাহিনী আছে; সেই শান্তিপ্রিয়। আর যাদের এসব কিছু নেই; তারাই অশান্তিপ্রিয়, সন্ত্রাসবাদী ও বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। বর্তমান বিশ্বে ‘মনে করা নীতি’ ও শান্তির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েল মনে করে ইরান তাদের হামলা করতে পারে তাই নিরাপত্তার জন্য ২০০ ফাইটার জেট দিয়ে আগেই হামলা চালিয়ে দিল। একইভাবে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবালনসহ প্রভৃতি দেশে হামলা চালানো হয়েছে। সেসব দেশে সামরিক অভিযান চালানোর সময় বলা হয়ে ছিল তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রসহ নানা ধরনের মারণাস্ত্র আছে। অথচ এসব কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি। অথচ তাদের থেকে অনেক দেশের অস্ত্র ভাণ্ডার বহুগুণ বেশি। সে ক্ষেত্রে বিশ্বমোড়লরা নীরব।
আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি- যারা যুদ্ধ বাঁধায়, অস্ত্র সরবরাহ করে, মানুষ হত্যা করে, মানুষের আবাসস্থল গুঁড়িয়ে দেয়; তারাই আবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের দাবিদার হয়ে ওঠে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড কয়েক মাস আগে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না।’ তবে হামলার কয়েকদিন সবাই ভোল পাল্টিয়ে বলা শুরু করল ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি। তাছাড়া ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা চালায়, তাহলে সেটি পরাশক্তি হওয়ার জন্য নয়; বরং আত্মরক্ষার জন্য। কেননা এই অস্ত্র থাকলে অন্যের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যায়।
আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম দ্বারা কোনো রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারে না। এনপিটি বা পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় না। ইউক্রেনের হাতে এক সময় পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। ১৯৯৪ সালে এক চুক্তি অনুযায়ী ইউক্রেন স্বেচ্ছায় তার পারমাণবিক অস্ত্রগুলো রাশিয়া ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে এবং ঘঁপষবধৎ ঘড়হ-চৎড়ষরভবৎধঃরড়হ ঞৎবধঃু (ঘচঞ)-তে অংশ নেয়। এর বিনিময়ে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ইউক্রেন তার ফলাফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আসল উদ্বেগের জায়গা হলো, একটি দ্বিমুখী নীতিমালা বলবৎ রাখা হয়েছে যেন ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে, অন্য কেউ নয়। বিশেষ করে এই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব। ইসরায়েল যেন পশ্চিমাদের একটি ঘাঁটি, কোনো দেশ নয়।
ইসরায়েল অনেক আগেই পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছে অথচ পশ্চিমা বিশ্ব, জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা’ (আইএইএ) সব কিছু দেখে না দেখার ভান করেছে। বিশ্বের কতিপয় পরাশক্তির ছত্রছায়ায় গত প্রায় ছয় দশকে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে ইসরাইলের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার গল্প। শুধু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। জাতিসংঘের ব্যানারে পরাশক্তিগুলোর তত্বাবধানে ১৯৪৭/৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমি দখল করে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরায়েল সৃষ্টি হয়। সেই সময় পাশে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল। কিন্তু সেটা কাগজে-কলমেই থেকে যায়। কয়েক প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিদের একটা বড় অংশ কাম্পে বসবাস করে যাচ্ছে।
সূচনাটা অনেক আগে থেকে শুরু হয় যখন ১৮৯৭ ইহুদি কংগ্রেসে তাদের নেতা থিওডর হার্জেল ফিলিস্তিনিদের এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। একই সালে ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া ও আমিরিকা এই ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। শুরু হয় ইহুদি বসতি স্থাপন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন আরবীয়দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ১৯১৯ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর ইহুদি আগমন ব্যাপকহারে শুরু হয়। ১৯২১ সালে আরব- ইহুদি দাঙ্গায় প্রায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি মারা যায়। ১৯২২ সালে লীগ অব নেশনস ইহুদিদের বসতি স্থাপনের বৈধতা দিয়ে দেয়।
এ পর্যন্ত আরব-ইসরায়েল চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে। প্রতিটা যুদ্ধে তারা জয় পায়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ছয় দিন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল প্রতিবেশী মিসরের সিনাই ও গাজা উপত্যকা, জর্ডানের পশ্চিম তীর ও জেরুসালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুসারে নাইল (মিসর) নদী থেকে ইউফ্রেটিস (ইরাক) নদী পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে গ্রেটার ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের শত বছরের পরিকল্পনা নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালায় এবং সেখানে নির্বিচার হাজার হাজার নাগরিক হত্যা করে।
১৯৮৬ ও ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বাহিনী লিবিয়ায় হামলা চালায়। ২০০৩ সালে তথাকথিত ‘ঐচ্ছিক জোট’ পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। নারী, শিশুসহ লাখ লাখ ইরাকি প্রাণ হারায়। তাদের দাবি ছিল, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, যদিও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আর এ সব কাজে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল ইসরায়েল। ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েল বিমান হামলা করে ধ্বংস করে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আল-তুয়াতিয়াহতে নির্মাণাধীন ওসিরাক পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রের গোলাকার গম্বুজ।
অপারেশন ব্যাবিলনের ২৬ বছর পর ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল একই রকম হামলা চালিয়ে সিরিয়ার কথিত আণবিক কর্মসূচি স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। তবে সিরিয়ার সরকার কখনোই স্বীকার করেনি যে কোনো ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি তারা নিয়েছিল। এমনকি, পাকিস্তানের কাহুতায় অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার পরিকল্পনাও করেছিল। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েল ধ্বংসের হুমকি দিয়ে আসছে। ১৯৯২ সাল থেকেই ইসরায়েল দাবি করে আসছে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে।
গত ১৩ জুন কোনো রকম বিনা উসকানিতে ও কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই গভীর রাতে ইসরায়েল স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ ইরানের ওপর ২০০ জঙ্গি বিমান নিয়ে দুই দফা হামলা শুরু করে। ১২ দিনের এই হামলায় ইরানে অন্তত ৬১০ জন নিহত এবং চার হাজার ৭০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। এক ডজনের ও বেশি শীর্ষ সামরিক ও পরমাণু বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামোসহ তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলা হয়েছে। বি-২ বা বি-৫২ যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। তারা ইরানে অত্যাধুনিক সাইবার হামলাও চালিয়েছে। ১২ দিনের যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ইসরায়েল, ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র—প্রতিটি দেশই নিজেদের বিজয়ের গল্প বলছে।
যুদ্ধে ইরানের অনেক ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যাশিত ছিল, কেননা ইসরায়েল ইরানকে ধ্বংসের মহা-পরিকল্পনা নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, ইরান খুব তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ করবে। যুদ্ধ শুরুর সময় নেতানিয়াহু দুটি উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন। আর তা হলো- ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংস করা এবং ইরানে সরকার পরিবর্তন বা ‘রেজিম চেঞ্জ’। একদিকে যেমন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ইরানে সরকার পরিবর্তনতো দূরের কথা বরং সরকারের পক্ষে জনমত গড়ে গড়ে উঠেছে এবং জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
ইরান শক্তিশালী ইসরায়েলের পাল্টা জবাব দিয়েছে। ইসরায়েলের গর্বের আয়রন ডোমসহ তিন স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে তেলআবিব ও হাইফাসহ বেশ কয়েকটি শহরে হামলা চালিয়েছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট আর ড্রোন হামলায় তাদের অনেক আবাসিক ভবনের সাথে সাথে কৌশলগত স্থাপনা, সেনাঘাঁটিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ইসরায়েলের গর্বের বিজ্ঞান গবেষণাগার ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দফতর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সরাসরি বস্তুগত ক্ষতির জন্য প্রথম কয়েক দিনে প্রায় ৩৯ হাজারটি ক্ষতিপূরণ দাবির আবেদন পেয়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। আরও কয়েক হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ইরানের আক্রমণ প্রতিরোধ–প্রতিহত করার জন্য ইসরায়েল তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো দেশের সহায়তা নিতে হয়েছে।
১৯৯৩ সালে শান্তি চুক্তি ও ১৯৯৮ সালে ভূমির বিনিময়ে শান্তি চুক্তি হলেও সেগুলো লঙ্ঘন করে বার বার আগ্রাসী হয়ে উঠছে ইসরায়েল । ইসরায়েল কোনো আন্তর্জাতিক আইন, মানবতা কিছুই মানে না। খোড়া যুক্তি বা অজুহাত দেখায়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর একের পর এক নিপীড়নের খড়গ চালিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে এক লাখ পৌঁছেছে (ইসরায়েলের পত্রিকা হারেৎজ-এর খবর অনুযায়ী)। আহত হয়েছে প্রায় দুই লাখ। গাজায় নিহত বেশির ভাগ শিশু ও নারী। অথচ এই শিশুরা বোঝে না মুসলমান আর ইহুদির পার্থক্য।
গাজাবাসীর খাবার পাওয়ার একমাত্র উৎস হলো এই ত্রাণকেন্দ্রগুলো। খাবার না পাওয়ার অর্থ হলো ফিলিস্তিনি শিশুদের অনাহারে থাকা। অথচ এই সামান্য ত্রাণের বিনিময়ে তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বুলেট। ত্রাণকেন্দ্রগুলো যেন ‘কিলিং ফিল্ড’ বা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে হামলা হচ্ছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরান বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে। জ্বালানি ও পানি ঘাটতি, মুদ্রামূল্যের পতন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং সামরিক বাজেটের সীমাবদ্ধতা সব মিলিয়ে দেশটি গভীর ও বহুমাত্রিক সংকটে রয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছেই। ২০২৩ সালে ১৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে ২৮ বিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালে (প্রাক্কলন) ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
এক ইহুদি এনজিও প্রধান দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেন, তিনি যদি মার্কিন সিনেটে একটি সাদা রুমাল পাঠান তবে তাতে অন্তত ৭০ জন সিনেটর স্বাক্ষর করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ ইহুদি সম্প্রদায়ের অথচ তারা সে দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৩০ শতাংশের মালিক। তেমনি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২ শতাংশ ইহুদি তবে তারা বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মালিক। বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ধনী ব্যক্তির মধ্যে কয়েকজন ইহুদি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম, হলিউড, ধর্মসহ অনেক কিছু ইহুদি লবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় পৃথিবীর আরও কয়েকটি প্রভাবশালী দেশও ইসরায়েল লবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা নিরলসভাবে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার কাজ করে চলেছে। যেসব কারণে ইসরায়েল বর্তমানে সারা বিশ্বে ‘ধরাকে সরাজ্ঞান’ করতে চায়। ইসরায়েল বার বার অপরাধ করার পরেও তারা সবসময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। এমনও কথা প্রচলিত আছে ইসরায়েল বা ইহুদিদের স্বার্থ না দেখলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জয়লাভ করা বা টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
ভারতের ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ সফল হয়নি, আজিমুল্লাহ খাঁ’রা পরাজিত হয়েছিলেন। সফলতা আসতে পারত, কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। তবে প্রমাণ হয়েছিল কেউ অপরাজেয় নয়, আগ্রাসী, দখলদার ও অত্যাচারীরাদেরও আঘাত করা যায়। ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়, একতা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয় এবং সেই পথ ধরেই ভারতে স্বাধীনতা আসে। অর্থ, প্রভাব প্রতিপত্তি আর পরাশক্তিদের ছত্রছায়ায় ইসরায়েল যেন অহংকারী হয়ে উঠেছিল। তারা মনে করেছিল তারা অপরাজেয়, তাদেরকে কেউ আঘাত করতে পারবে না। ইরান নিজে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও ইসরায়েলকে আঘাত করে তাদের গর্বদর্প চূর্ণ করল।
এই যুদ্ধ হয়তো আরব বা অন্যান্য অত্যাচারিত-নিপীড়িতদের একদিন একত্রিত ও উজ্জীবিত করবে। একদিন দখলদার, আগ্রাসী, খুনি, দাম্ভিক ইসরাইলকে ‘ধরাশয়ী’ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে- এটিই শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ