মাহমুদ আহমদ
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। ঈদ আনন্দে ধনী-গরীব সবারই আশা থাকে পরিবারের লোকদের নিয়ে আনন্দময় সময় অতিবাহিত করার। কিন্তুহয়তো সাধারণ খেটে খাওয়া ও দরিদ্র শ্রেণির পক্ষে সম্ভব হবে না ঈদে পরিবারের জন্য বাড়তি কিছু করার।
হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কোরবানির অনুসরণে মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ১০ জিলহাজ তারিখে পশু কোরবানি করে থাকে। ইসলামে এই যে কোরবানির শিক্ষা তা কি কেবল একটি পশু কোরবানির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়ে যায়? আসলে পশু কোরবানি করাটা হচ্ছে একটা প্রতীকীমাত্র। গরীব অসহায়দের সাথে নিয়ে যে আনন্দ উদযাপন করা হয় তাই মূলত আল্লাহপাকের কাছে গ্রহণীয় হয়ে থাকে। এবারের কোরবানির ঈদ আমরা আরো আনন্দময় করতে পারি যদি গরীব ও সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষদের সাথে নিয়ে উদযাপন করি। বাজারে গেলে দেখা যায় কার চেয়ে কে বড় পশু ক্রয় করবে তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়। অথচ আল্লাহর কাছে এর রক্ত এবং মাংসের কোনই মূল্য নেই। তিনি তো মানুষের হৃদয় দেখেন। এই কোরবানির মাধ্যমে আমি কতটা নিজেকে পরিবর্তন করেছি, এটা হল মূল বিষয়। আসলে আমরা যদি নিজেদের পশুসুলভ হৃদয়কে কোরবানি দিয়ে একে অপরের জন্য হয়ে যাই তাহলে কতই না উত্তম হত। এ ছাড়া আল্লাহ তাআলাও চান মানুষ যেন তার পশুসুলভ হৃদয়কে কোরবানি করে, তার আমিত্বকে কোরবানি করে আর সেই সাথে তার নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়াকে আল্লাহর খাতিরে কোরবানি করে দেয়। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামও ও তার পুরো পরিবারের কোরবানি এমনই ছিল। তারা ব্যক্তি স্বার্থকে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছিলেন।
আল্লাহর সাথে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি কোরবানি চান আর এ কোরবানির অর্থ কেবল পশু জবেহ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ কোরবানি কারো জন্য নিজ প্রাণের কোরবানিও হতে পারে আবার কারো নিজ পশুত্বের কোরবানিও হতে পারে। আমরা যদি মনের পশুকে কোরবানি করতে পারি তাহলেই আমরা আল্লাহ তাআলার প্রিয়দের অন্তর্ভুক্ত হতে পারব। কোরবানির ঈদ-পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামএর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে থাকে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন’ (সুরা কাউসার, আয়াত ২)।
কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার। এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয় তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এবং প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলো আল্লাহ তাআলা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি তার পুত্রকে জবাহ করছেন (সুরা সাফ)। যেভাবে কোরবানি কবিতায় কবি নজরুল বলেছেন: এই দিনই মিনা ময়দানে, পুত্র-স্নেহের গর্দানে, ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে, রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম সে আপনা রুদ্র পণ! ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন! আজ জল্লাদ নয়, প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন! ওরে হত্যা নয় আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ পিতা ইব্রাহিম স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে আল্লাহ বললেন, হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। আমি তোমাকে নিজ পুত্রকে আমার পথে উৎসগ করতে বলেছি, হত্যা করতে নয়। তোমার পুত্র সারাজীন লোকদেরকে বুঝাবে আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন দুম্বা বা ছাগল জবাই করলেন? এর উত্তর হলো: যদি সেদিন এই ঘটনা না ঘটতো তাহলে তৎকালীন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কোন কোন জাতিতে প্রভুকে বা দেব-দেবীদের খুশি করার জন্য নরবলি তথা মানুষ কোরবানি চলমান থাকতো। অতএব আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষ জবাহ করার জিনিস নয়, জবাহ যদি করতে হয় তাহলে পশু জবাহ করো।
ইতিহাস পাঠে জানা গেছে, হজরত মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রদ্ধেয় পিতা একবার অসুস্থ হলে তার দাদা একশত উট জবাহ করেছিলেন (সিরাতে নববী)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পশু জবাই করা মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রচলন করেন নি বরং পূর্বেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা হতো। পশু কোরবানির আরো একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে মুসা আলাইহিস সালাম এর জাতিকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, ‘তোমরা যে গাভীকে পুজা করো, সে পুজনীয় নয় বরং আমি পুজনীয়, অতএব সেটাকে জবাহ করো’ (সুরা আল বাকারা, রুকু ৮)। অর্থাৎ গরু আমাদের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে, আমরা যেন এর দুধ পান করতে পারি এবং এর গোশত খেতে পারি এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য উপকার সাধন করতে পারি। মূল উদ্দেশ্য হলো, আমাদের হৃদয়ে যদি কোন পশু থাকে সেই পশুকে হত্যা করা, সেটাকে জবাই করা। হাদিসে আছে, পশু জবাই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম তবে তা ওই ব্যক্তির জন্য যে নিষ্ঠার সাথে কেবল আল্লাহ তাআলার ভালোবাসায়, তার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে ঈমান সহকারে পশু জবাই করে এমন কোরবানিকে আরবিতে ‘নুসক’ বলা হয়েছে, যার আরেকটি অর্থ অনুগত।
আসলে আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন, কে কোন উদ্দেশ্যে কোরবানি করছে তা তিনি ভাল করেই জানেন। মূলত মানুষের মধ্যে সকল লোভ লালসা দূর করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সকল পশুত্বকে বিসর্জনের শিক্ষাই হলো কোরবানির শিক্ষা। তাই কোরবানির অন্যতম ধর্মীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে পশুত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা। কাজী নজরুল ইসলাম তার এক কবিতায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন- ‘মনের পশুরে কর জবাই/পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।’ এই পশু কোরবানি সম্পূর্ণ রূপক। আল্লাহর পথে ত্যাগই ঈদের আসল শিক্ষা। আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মানে দান নয়, তা ত্যাগ। তাই তো কবি নজরুল ‘ঈদজ্জোহা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘চাহি নাকো দুম্বা-উট, কতটুকু দান? ও দান ঝুট। চাই কোরবানি, চাই না দান।’ আমাদের পুণ্যকর্মগুলোর মূল উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি তাহলে তিনি হয়তো আমাদের আমল গ্রহণ করবেন। যাদের আল্লাহ সামর্থ্য দিয়েছেন তারা ইচ্ছা করলে কোরবানি ঈদের বাজেটের একটি অংশ গরিবদের জন্য ব্যয় করতে পারেন। ঈদের আনন্দে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া। আসলে অসহায়দের সাহায্য করাই ধর্মের শিক্ষা। আর এর মাধ্যমেই আল্লাহপাক বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হোন।
আল্লাহপ্রেমিক বান্দারা ঘরে বসেই তার বান্দাদের কষ্ট দূর করার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। যারা তার বান্দার কষ্টের সময় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে, আল্লাহপাক তাদের তার বন্ধু বানিয়ে নেন। দয়াময় সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের সবিনয় প্রার্থনা, হে আল্লাহ! বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর এ কোরবানি তুমি গ্রহণ করো। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ