এ আর খান : ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর পালিত হবে ৭৬তম সর্বজনীন মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে এই দিনটি মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। সেই থেকে প্রত্যেক বছর এই বিশেষ দিনটি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি ও সচেতনতামূলক উদ্যোগের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। বাংলাদেশও এই দিবসটি পালন করে, কারণ এটি জাতিসংঘের মানবাধিকার দলিলে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর একটি। তবে মানবাধিকার শুধু পালনের জন্য নয়; এটি প্রতিদিনের জীবনে বাস্তবায়ন করার এক ধরনের অঙ্গীকার।
মানবাধিকারের বিষয়গুলো মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরকে প্রভাবিত করে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে একজন শিশু পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে, যা তার জন্মগত অধিকার। এরূপ জন্মগত অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বেঁচে থাকার অধিকার। আবার কিছু অধিকার মানুষ অর্জন করে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে, যেমন ভোটাধিকার বা আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার।
মানবাধিকার ব্যাপক একটি ধারণা, যা আইন, সামাজিক নীতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার থেকে শুরু করে কাজের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, এমনকি আশ্রয়ের অধিকার—সবই এই ধারার মধ্যে পড়ে। তবে একটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন—অধিকারগুলো যখন ব্যক্তিগত থেকে দলগত পর্যায়ে যায়, তখন তা অন্যের অধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে।
একটি সাধারণ উদাহরণ হলো, আমি ও আমার বন্ধু যদি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকি, আমি আমার হাত ইচ্ছামতো তার দিকে প্রসারিত করতে পারবো না, কারণ সেটা তার ব্যক্তিগত গণ্ডিকে লঙ্ঘন করবে। একজনের অধিকার অন্যজনের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না, তাই অধিকারগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য ও শ্রদ্ধা থাকা জরুরি।
বিশ্বজুড়ে কোনও দেশই সম্পূর্ণভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে মুক্ত নয়। পার্থক্যটি কেবল পরিমাণে—কোনও দেশে বেশি, কোথাও কম। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় খালিয়াজুরির মানুষকে ট্যাবলেট ব্যবহার করে নদীর পানি ফুটিয়ে পান করতে হয়, আর ঢাকায় আমরা অফিসে বোতলজাত পানি ব্যবহার করি। এটা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? এমন অমিলগুলো মানবাধিকারের প্রকৃত অর্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তবে মানবাধিকারের বিষয়টি নতুন নয়। প্রাচীনকালে, এমনকি ৩৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও মানবাধিকারের বিভিন্ন ধারা স্বীকৃত ছিল। মেসোপটেমিয়ায় আবিষ্কৃত সাইরাস সিলিন্ডারে মানবাধিকারের কিছু মৌলিক ধারা লিখিত রয়েছে। গ্রিক সভ্যতায় এবং ইসলামি সভ্যতার সূচনাতেও মানবাধিকারের উল্লেখ রয়েছে। ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী, কালো বা ধলো, ধনী বা দরিদ্র—সবাই সমান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা অন্যরকম।
মধ্যযুগে ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে ‘ম্যাগনা কার্টা’ স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে সাধারণ মানুষ রাজার বিরুদ্ধে তাদের অধিকারের জন্য সরাসরি কথা বলার সুযোগ পায়। ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের পর ‘ভার্জিনিয়া অধিকার ঘোষণা’ প্রণয়ন করা হয়, যেখানে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের অন্বেষণকে অমূল্য অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ধরনের দলিলগুলোর মধ্য দিয়েই মানবাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে ওঠে, যা আধুনিক যুগের মানবাধিকারের ধারণার মূল ভিত্তি।
বিশ্বের দুটি মহাযুদ্ধের ফলে মানবাধিকারের প্রশ্নটি আরও গুরুত্ব পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। এরপর ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’ দলিলটি গৃহীত হয়। এই দলিলের মূল ভিত্তি ছিল মানবতার সুরক্ষা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। এতে মোট ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যেখানে ১৮ এবং ১৯নং অনুচ্ছেদে বিশেষভাবে ব্যক্তির চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশেও একটি সংবিধান রয়েছে, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদি তারা দলের নির্দেশের বিরুদ্ধে ভোট দেন বা ফ্লোর ক্রস করেন, তবে তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হতে পারে। এটি একজন মানুষের চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে মানুষ তাদের চিন্তা বা মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে ব্যক্তি আদালতে যেতে পারবেন। তবে বাস্তবতায় আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। বহু মানুষ মিথ্যা মামলায় জর্জরিত, অনেকেই ‘নিরুদ্দেশ’ বা ‘গুম’ হওয়ার শিকার। এ অবস্থায় কাগজে থাকা অধিকারগুলোর কোনও বাস্তবায়ন দেখা যায় না। বিচার বিভাগও প্রায়শই রাজনৈতিক চাপের কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, যা দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলছে। মানবাধিকারের বিষয়টি সর্বজনীন হলেও বাস্তবিক চর্চায় তার অভাব প্রকট। বিশ্বের প্রতিটি দেশ মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে, দলিল তৈরি করে, কিন্তু তাদের নিজেদের চর্চায় তা কতটা মেনে চলে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেভাবে মানুষের বাকস্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে, তা স্পষ্টতই মানবাধিকারের মৌলিক নীতির পরিপন্থি। মানবাধিকার মানে শুধু মানুষের জীবনের সুরক্ষা নয়, এটি মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। তাই এই অধিকারগুলো কাগজে আটকে না রেখে, বাস্তব জীবনে কার্যকর করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অদ্ভুত মনে হয়, যখন ভাবি আমার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সেটিও যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করে বা করতে হয়। সংবিধানে বর্ণিত মানুষের চিন্তা ও বিবেককে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কালা কানুন দিয়ে। সংগীতশিল্পী হায়দার ৩০ বছর যাবৎ স্বাধীনতাকে খুঁজছেন, তিনি কি আজও তার সন্ধান পেয়েছেন?
লেখক: সাবেক পুলিশ সুপার।
৭০ অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার
ট্যাগস :
৭০ অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার
জনপ্রিয় সংবাদ