প্রত্যাশা ডেস্ক: এবারের ২৬ মার্চ ৫৫তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ‘৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। যা চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ঘোষণা করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল- তা নিয়ে বিতর্ক আছে। গত তিন দশক ধরে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রশি টানাটানির মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাস একাধিকবার নতুন করে লেখা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের ভূমিকার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকসমূহ একাধিকবার পুনর্লিখিত হয়েছে।
২০২১ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে আনুষ্ঠানিক ইতিহাসের একটি কালক্রমটি পাওয়া যায়:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর থেকে ২৬ মার্চ ভোরের কোনো এক সময়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র লিখেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাপত্রটি সম্প্রচার করা হয়। তবে খুব কম মানুষই সম্প্রচারিত ঘোষণাটি শুনতে পেয়েছিল।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে একটি ঘোষণা পাঠ করেন। ওই ঘোষণা বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো শুনতে পেয়েছিল এবং বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে জানতে পারে।
উপরোক্ত কালক্রম অনুযায়ী, ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণা পাঠের আগ পর্যন্ত বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা শুনতে পায়নি।
স্বাধীনতার ঘোষণার এই বিবরণটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে এবং প্রথাগত বিচক্ষণতায় প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এটা গত তিন দশক ধরে তৈরি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, জনপ্রিয় ইন্টারনেট বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ায় কালুরঘাট রেডিও ট্রান্সমিটার-বিষয়ক নিবন্ধে বলা হয়েছে: ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এম এ হান্নান স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণার একটি ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করেছিলেন……ধারণা করা হয়, স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা বিশ্ব গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপকভাবে পৌঁছায়নি।’
মেজর জিয়াউর রহমানের শুরুর কথাগুলো ছিল বাংলায় ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’। এরপর তিনি সার্বভৌম-স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা পাঠ করেন, যা বার্তা সংস্থাগুলো শুনতে পেয়েছিল এবং তারা তা সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। জিয়াউর রহমানের ঘোষণা প্রথম শুনতে পায় চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা একটি জাপানি জাহাজ। তারা তাৎক্ষণিকভাবে তা সারা বিশ্বের কাছে প্রচার করে। জিয়ার ঘোষণার সংবাদ প্রথম সম্প্রচার করে রেডিও অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা বিস্তারিত জানতে পারে। তবে বাস্তবতা আর প্রামাণিক দলিলপত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।
বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঘোষণাটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছেন, যার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস-এ ওই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ঘোষণায় বলা হয়, ‘এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি, যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান-যতদিন না দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।’ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখন্ডের, যার নাম বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৯শ’ ৬১ মার্কিন ডলার। সময় পেরিয়েছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়েছে। মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ দৃশ্যমানভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রাপ্তি নিয়েই এবারও জাতি স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে।
ইতিহাসের এই পথপরিক্রমায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এক বিশাল স্থান করে নিয়েছে। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলটির নেতৃত্বে থাকা শেখ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘমেয়াদে দেশের সরকার প্রধান ছিলেন। গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরশাসন কায়েম করে গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে তার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকারের। অবসান ঘটে সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের। এরপর দেশের একমাত্র নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে আমূল বদলে দেওয়ার বার্তা ও ধারণা ইতিমধ্যে নানা কর্মকাণ্ড, বক্তব্য ও ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
এ উপলক্ষে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা এবং ঢাকা শহরের ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে।
এদিন সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা বাণী দিবেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র, নিবন্ধ ও সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করবে। এ উপলক্ষে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে।