ড. ফরিদ আহমেদ : ভালোবাসা আর জীবন এ দুইয়ের মূল্য যেমন দেওয়া যায় না, তেমনি মূল্য দেওয়া যায় না পতাকার। ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা ও পতাকা অর্জন করেছি তারও মূল্য কত আমরা কেউই জানি না। কারণ স্বাধীনতা স্বতঃমূল্য: অন্য কোনো কিছুর প্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত করে মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।
সেই স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালির অবদান কয়েক শতকের। ১৭৫৭ সালে মীরজাফরের লোভ স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করেছিল। সেখান থেকে মুক্ত করতে যে ত্যাগ আমাদের রয়েছে তার মহিমা বর্ণনার মহাকাব্য যুগে যুগে গ্রন্থিত করে গেছেন কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনীতিবিদরা। সংগ্রামের সেই গর্ব আমাদের স্বাধীনতা।
৫১ বছর পর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আজ আমি স্বাধীনতার অর্থ খুঁজছি। সেই অর্থ খোঁজার এটা প্রমাণ করে কি যে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি? হয়তো না- আবার হয়তো সত্যি। আজ আমি যা দেখছি আমার সমাজ জীবনে তা থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জাগছে। আমাদের রাজনীতিতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা আবির্ভুত হয়েছেন অভিভাবকের ভূমিকায়। তাদের সাবেক ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান ১৯৪৯ সালে পৃথিবীকে দুইভাগে ভাগ করে আমাদেরকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে ফেলেছিলেন এবং কিভাবে তারা আমাদের উন্নয়নের ভূমিকায় অবদান রাখবেন তার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন ডযরঃব ঐড়ঁংব এ বসে।
গবেষকদের ধারণা আসলে ভিন্ন। ট্রুম্যান আমাদের উন্নয়ন নয় বরং উপনিবেশিক সমাজ ব্যবস্থার সমাপ্তির পর কিভাবে নতুন ধরণের উপনিবেশ সৃষ্টি করা যায় তার পরিকল্পনা থেকেই উন্নয়নের পার্টনার হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন। সেই বাসনা থেকে আমাদেরকে দেওয়া হয় গণতন্ত্রের হার। আমরা সেই শৃংখলার হারকে এতটাই গুরুত্ব দেই যে, আমরা আমাদের অধিকার, মর্যাদা, স্বাধীনতাকে ভুলে যাই। আমরা আমাদের নাগরিকদেরকে শাসন করি উপনিবেশিক কায়দায় এবং সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য আবার তাদেরই কাছে যাই। তারা গণতন্ত্রের এবং উন্নয়নের যে ধারণা পোষণ করেন তারই মোহে মুগ্ধ হয়ে ছুটে যাই নতজানু হয়ে। আর এভাবেই আমাদের স্বাধীনতাকে শৃংখলিত করে ফেলি।
সম্প্রতিকালে আমাদেরকে নতুন একটি হার উপহার দেওয়া হয়েছে- যার নাম টেকসই উন্নয়ন। খুবই যুৎসই সেই হার আমাদেরকে নতুন করে শাসন ও শোষণের জন্য। বিষয়টিকে ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে নিজের পরকীয়া ঢাকতে নতুন উপহার দেওয়ার মতো বিষয়। আমাদের উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে সে কথা এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে খুঁজে পাই। পরকীয়া এখন এতটাই মহামারী আকার ধারণ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরকীয়ার সংজ্ঞা যতই সীমিত ভাবে নির্ধারণ করি না কেন এই নৈতিক স্থলন থেকে আমাদের মুক্তির পথ খোঁজা উচিত। নতুবা এই রোগ স্বাধীনতাকে বিপণ্ন ও অর্থহীন করে তুলবে। আমরা যে নারীমুক্তির কথা বলছি সেটাও হুমকিতে পড়বে।
বিদেশি পত্রিকায় আমাদের এক সহকর্মী অধ্যাপক বশির আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। সেখানে তিনি বলছেন কেন সারা বিশ্বে রক্ষণশীলদের হাতে বিজয় পতাকা উড়ছে। সেটি আমাদের উদারতাবাদের পরাজয়। আমাদের সমাজে রক্ষণশীলরা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে যেমনটি ভারতেও ঘটেছে। যেভাবে আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে উদারপন্থিদেরকে পরাস্থ করে ক্ষমতায় শক্ত অবস্থান করে নিচ্ছে রক্ষনশীলরা। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা যে স্বাধীনতাকামী বাঙালির রাষ্ট্র দর্শন ছিল, সেই সাম্প্রদায়িকতা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। আর তাই আমাদের কেউ কেউ বলছেন ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
আমাদের সর্বনাশ হয়ে যায়নি- আমাদের এখনো সুযোগ আছে। আর সেজন্য অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের পরিকল্পনার সঙ্গে পঁঃ ুড়ঁৎ পড়ধঃ ধপপড়ৎফরহম ঃড় ুড়ঁৎ পষড়ঃয নীতি অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছেন। উন্নয়নের ফাঁদে পড়ে শ্রীলংকা যেভাবে কাঁদছে সেভাবে যেন আমাদের কাঁদতে না হয়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে নতুন কোনো ফাঁদে শৃঙ্খলিত না হয় তা সরকার ও বিরোধীদলকে চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিবেচনা করতে হবে।
সরকারকে মানতে হবে বিরোধীদলের রাজনৈতিক স্পেস সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং নিজেদের মধ্যে অপসংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে। সুতরাং, বিদেশিরা এখানে আমাদেরকে শিকারে পরিণত করতে চেষ্টা করছে। পাশাপাশি বিরোধীদলকেও বুঝতে হবে তারা কতটুকু বিদেশ-নির্ভর রাজনীতি করবেন। তাদেরকে ক্ষমতায় বসানোর লোভ দেখিয়ে বিদেশিরা যাতে ফায়দা লুটে নিতে না পারে সেই সতর্কতা অবলম্বন জনদাবি। আমাদের সকলেরই উচিত রাজনীতিকে মানবসেবায় পরিণত করা। আর সে জন্য মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ সামাজিক আদর্শ নির্বাচন করা। আমাদের সংবিধানকে একটি দলিল হিসেবে না দেখে এটিকে বাস্তব স্বাধীনতা বাস্তবায়নের কাঠামো বিবেচনা করা। যদি আমরা সেটা করতে পারি তবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকারকে বুঝতে হবে কেন পিটার হাস কূটনীতিবিদ হয়ে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মনোযোগী হচ্ছে। সমাজে যিনি ক্ষমতায় আছেন তিনি তার শপথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন কি? এসব প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে যদি আমরা উন্নত সমাজ ব্যবস্থার দিকে যেতে চাই কিংবা আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে চাই।
বিজয়ের মাসে, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে রাজনৈতিক অঙ্গনে যা ঘটছে তাতে আমরা শঙ্কিত। সরকারকে মানতে হবে কিছু বিচ্যুতি ঘটেছে এবং সেখান থেকে আবার ফিরে আসতে হবে ঠিক সেই জায়গায় যা মহিমান্বিত করেছিল বাঙালিকে।
‘মানুষের স্বাধীনতা’ বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক আদর্শ নির্বাচনে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছি। আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এখন। বিজয় দিবসে কেবল আনন্দই নয় বরং যেন কঠোর শপথ নেই ‘সারাদিন যেন আমি ভালো হয়ে চলি।’ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বীরমুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়