নিজস্ব প্রতিবেদক : তীব্র শীত, কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ার মধ্যে আরও ২১ জেলায় বিস্তৃত হয়েছে শৈত্যপ্রবাহ। দেশের ৪৩ জেলায় মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বইছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর, গত সোমবার যা ছিল ২২ জেলায়। এরও আগের দিন ছয় জেলায় বইছিল মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। এদিকে রাজধানীসহ সারা দেশেই দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তীব্র ঠান্ডায় নাকাল মানুষ। শীতজনিত নানা সমস্যা নিয়ে দেশের জেলা হাসপাতালগুলোর সঙ্গে ভিড় বাড়ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোতেও। তাদের বেশিরভাগই শিশু আর বয়স্ক।
গতকাল মঙ্গলবার দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা আরও কমে ৬ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে নেমেছে। এদিন সকালে চুয়াডাঙ্গা পর্যবেক্ষণাগারে এই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগে সোমবার দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল দিনাজপুর এবং নওগাঁর বদলগাছীতে ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি। রবিবার দেশের তিনটি পর্যবেক্ষণাগারে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় মঙ্গলবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, চলতি শীত মৌসুমে যা সর্বনি¤œ। ঢাকার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মঙ্গলবার ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমেছে। আগেরদিন সোমবার সকালে ঢাকার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন সকালে ছিল ১৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গলবার সারা দেশেই সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে ছিল। এদিন দেশের দ্বিতীয় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ৭ দশমিক ১ ডিগ্রি। তৃতীয় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ফরিদপুর এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাট পর্যবেক্ষণাগারে ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া গোপালগঞ্জ ও রাজশাহীতে ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি, পাবনার ঈশ্বরদীতে সর্বনি¤œ ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। শৈত্যপ্রবাহের এমন বিস্তৃতি এবং তাপমাত্রার নি¤œগামিতার মধ্যেই দেশের পাঁচ বিভাগে কমবেশি স্থানে বৃষ্টির পূর্বাভাস এসেছে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এদিন খুলনা বিভাগের দু-এক জায়গায় হালকা অথবা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে আজ বুধবার সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং তা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে বিঘœ ঘটতে পারে।
তবে এসময়ে সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে বলে জানানো হয়েছে পূর্বাভাসে।
শৈত্যপ্রবাহ পূর্বাভাস থেকে জানা গেছে, মৌলভীবাজার, বরিশাল, ভোলা ও কুমিল্লা জেলা এবং ঢাকা বিভাগ (ঢাকা, গাজীপুর , নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলা); রংপুর (রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট জেলা); রাজশাহী (রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, নাটোর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ জেলা); খুলনা (যশোর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ জেলা) বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু জায়গায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে অব্যাহত থাকতে পারে এবং কিছু জায়গা থেকে প্রশমিত হতে পারে।
আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরের ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়- খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং ঢাকা বিভাগের দু-এক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। এসময়ে মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। তাপমাত্রা সম্পর্কে বলা হয়, সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাস বলছে, এসময়ে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। কুয়াশা সম্পর্কে বলা হয়েছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। সারা দেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাসে জানানো হয়। বর্ধিত পাঁচ দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় বলা হয়েছে, এ সময়ে রাতের তাপমাত্রা কমতে পারে।
ক্যাপশন: ভেতরে জায়গা না পেয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের সিঁড়িতেই আসন পেতেছেন রোগীরা।
বাড়ছে শীতজনিত অসুখ, মিটফোর্ডে মেঝে ও সিঁড়িতেও রোগী: সাতাশ দিনের মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে এসেছেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ইশতিয়াক আহমেদ রানা; মেয়ে তার জ্বরে ভুগছে। ভিড়ে ঠাসা হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে দেখা গেল ইশতিয়াক ও রাশেদা বেগম দম্পতিকে। কয়েক দিন ধরে প্রচ- শীতে শিশু মেয়েটার নিউমোনিয়া ধরে গেলে কিনা, তা নিয়ে তাদের দুঃশ্চিন্তা। কাছে গিয়ে সমস্যার কথা জানতে চাইতেই ইশতিয়াক একটি সংবাদসংস্থাকে বললেন, “ঢাকায় এ বছরের মত প্রচ- শীত আর আমি অনুভব করিনি। আমার মেয়েটা শীতে কাবু হয়ে গেছে। নিউমোনিয়া না হলেই বাঁচি।”
ইশতিয়াকের মত অনেকেই সন্তানদের নিয়ে এসেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালে, আছেন বয়স্করাও। শয্যা খালি না পেয়ে কেউ পাটি আর কাথা-কম্বল নিয়ে বসে পড়েছেন বারান্দা আর সিঁড়িতে। রাজধানীসহ সারা দেশেই দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তীব্র ঠান্ডায় নাকাল মানুষ। শীতজনিত নানা সমস্যা নিয়ে দেশের জেলা হাসপাতালগুলোর সঙ্গে ভিড় বাড়ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোতেও। তাদের বেশিরভাগই শিশু আর বয়স্ক।
পৌষের শেষ সপ্তাহ থেকে থার্মোমিটারে পারদ ক্রমশ নিচে নামছে। মাঘের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বনি¤œ ৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন সকালে রাজধানীতে সূর্যের দেখা মিললেও ঘন কুয়াশা আর হিম হাওয়ায় কাঁপছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসাপাতালে এলেও রোগীর চাপে চিকিৎসা পেতেও বেগে পেতে হচ্ছে। রোগীরা বলছেন, শীতের সঙ্গে ঠান্ডা বাতাসে হাড়ে কাঁপুনি ধরে। মেঝেতে কিংবা বারান্দায় যারা আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের অবস্থা আরও নাজুক।
মঙ্গলবার সকালে মিটফোর্ড হাসপাতালের বহির্বিভাগের সিঁড়ির সামনে এক শিশুকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন রোজিনা বেগম। কেরানীগঞ্জ থেকে নৌকায় নদী পার হয়ে রিয়াদ ও জিহাদ নামে ৩ মাস ১৪ দিন বয়সের যমজ ভাতিজিদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন তিনি। রিয়াদ কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও জিহাদ নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। রোজিনা বলেন, “দুই সপ্তাহ আগে রিয়াদের তীব্র জ্বর হওয়ায় তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসি। আর আজকে আবার জিহাদকে নিয়ে আসতে হল। ডাক্তার দেখিয়েছি, পরীক্ষা দিছে। রিপোর্ট দেখার পর প্রয়োজনে ভর্তি দেবেন।”
গায়ে কম্বল জড়িয়ে রিকশায় করে বৃদ্ধ বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন রমজান মিয়া। তিনি বলেন, “অন্যান্য রোগের পাশাপশি গত কয়েকদিনের ঠান্ডায় আব্বার শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। সর্দি-কাশি তো আছেই। এখনই ভর্তি করাচ্ছি না, ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে বাসায় নিয়ে যেতে চাই।”
হাসপাতালের এক নম্বর ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় দেখা যায়, শীতের মধ্যে কাঁথা-বালিশ আর কম্বল নিয়ে সিঁড়িতেই বিছানা পেতেছেন কয়েকজন রোগী। এক রোগী বলেন, “ভেতরে জায়গা না থাকার কারণে আমাদের বাইরে থাকতে বলা হয়েছে। বেড খালি হলে তারা ডেকে নেবে বলেছে। এভাবে শীতের মধ্যে ঠান্ডা বাতাসে কী বাইরে থাকা যায় বলেন?”
হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. জাকিরুল ইসলাম বলেন, “ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে নবজাতক ও শিশুরা ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। ব্রঙ্কিওলাইটিস ভাইরাস সংক্রমিত শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং এর প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে রোগীকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া। এটা বাড়িতে সম্ভব নয়। “তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদের শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসা।”
ভর্তি হওয়া শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশই ঠান্ডাজনিত রোগে ভুগছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সময়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। যদি বাচ্চারা দ্রুত শ্বাস নেয় এবং যদি তারা শ্বাস নিতে অস্বস্তি অনুভব করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।”