ড. এ কে এম মাহমুদুল হক : গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নির্বাচন, সংস্কার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এখন যেন অনেকটা প্রচলিত আদর্শিক রাজনৈতিক বন্দনার মতোই শোনাচ্ছে। জানি না এর বাস্তব প্রতিফলন আদৌ দেখা যাবে কিনা। বাংলাদেশে একাধিক ক্ষেত্র রয়েছে; যেখানে পরিবর্তন প্রয়োজন এবং উন্নতির সুযোগ রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মতো মৌলিক বিষয়গুলো আগামী বছরে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
এর মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো সম্ভব।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গুরুত্বের জায়গা হওয়া উচিত খাদ্য। আমরা প্রায়ই শুনি যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে এর মধ্যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে দেশের খাদ্যাভ্যাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। প্রোটিন ও ভিটামিনের গ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে আর কার্বোহাইড্রেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে।
মাংস এবং মাছের সেবন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে—২০০৫ সালে দৈনিক ৫৭.৭ গ্রাম থেকে ২০২২ সালে ২০১.৯ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। ধীরে ধীরে এই বৃদ্ধি দেখা গেছে ২০১০ (৭৯.১ গ্রাম) এবং ২০১৭ (৮৮ গ্রাম) সালেও।
ফলের গ্রহণ তিনগুণ বেড়ে ৩২.৫ গ্রাম থেকে ৯৫.৪ গ্রাম হয়েছে, এবং শাকসবজির সেবন ২৮.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১.৯ গ্রামে দাঁড়িয়েছে। ডিমের সেবনও ২০০৫ সালে ৫.২ গ্রাম থেকে ২০২২ সালে ১২.৭ গ্রামে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের গ্রহণে কিছু ওঠানামা দেখা গেছে। ২০০৫ সালে ৩২.৪ গ্রাম থেকে ২০১০ সালে ৩৩.৭ গ্রামে বাড়ে, এরপর কমে যাওয়ার পর ২০২২ সালে ৩৪.১ গ্রামে ফের বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে চালের সেবন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে ২০০৫ সালে ৪৩৯.৬ গ্রাম থেকে ২০২২ সালে ৩২৮.৯ গ্রামে। গমের গ্রহণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১২ গ্রাম থেকে ২২.৯ গ্রামে পৌঁছেছে, এবং মুসুর ডালের সেবনও ১৪.২ গ্রাম থেকে ১৭.১ গ্রামে বেড়েছে।
এই ইতিবাচক পরিবর্তন সত্তে¡ও বাংলাদেশিরা এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত দৈনিক ৪০০ গ্রাম ফল এবং শাকসবজি গ্রহণের নিচে রয়েছে। এছাড়া মাংস ভক্ষণেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে মাত্র ৩ কেজির কিছু বেশি মাংস খাওয়া হয়; যা বিশ্বের সর্বনি¤েœর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের চেয়ে কম মাংস খাওয়া হলেও ভারতে নিরামিষভোজীদের সংখ্যা বেশি, তাই বাংলাদেশ সর্বনি¤œ অবস্থানে রয়েছে। এমনকি বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি বুরুন্ডিতেও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মাংস খাওয়া হয়। বাংলাদেশ প্রায়ই দাবি করে যে তারা পাকিস্তানকে সব সূচকে পিছনে ফেলেছে।
কিন্তু মাংস ভক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের ধারেকাছেও নেই।
মাংস ভক্ষণ নিয়ে আলোচনা করার মূল কারণ হলো, বাংলাদেশের জাতিগত দৈহিক শক্তি এবং সামর্থ্যের অভাব। বাংলাদেশ প্রায় সব বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে থাকে।
বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় প্রাণীজ আমিষ ভক্ষণ না করার প্রবণতাকে সমালোচনা করেছিলেন। তার দৃষ্টিতে, এটি শারীরিক ও মানসিক শক্তির ঘাটতি সৃষ্টি করে।
মাংস ভক্ষণ থেকে আলোচনা এবার প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকে সরাই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এখনো বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ইন্টারনেটকে প্রয়োজনীয় মনে করেন না।
নেপাল, শ্রীলঙ্কা, নামিবিয়া, জিবুতি এবং সেনেগালের মতো দেশগুলো এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশ সরকার এখনও পর্যন্ত ইন্টারনেটের উন্নয়নকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। উদাহরণস্বরূপÑ ব্রডব্যান্ড সংযোগের গুণমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ১০৮তম এবং মোবাইল ডেটার ক্ষেত্রে ১১১তম স্থানে রয়েছে।
২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যান্ডউইথের একটি অংশ বøক করে দেয় বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে। পরবর্তীতে বকেয়া পরিশোধের পর আইআইজিগুলো স্বাভাবিক সেবা পুনরায় চালু করে। এছাড়া ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে মাত্র ৩৫ শতাংশ এলাকায় উচ্চগতির অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পৌঁছেছে। বাংলাদেশ অতিমাত্রায় আন্তর্জাতিক কেবলের ওপর নির্ভরশীল, যা কেবল ত্রæটির ফলে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত করার অন্যতম কারণ।
তবুও ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকর প্রতিযোগিতার অভাবে সেবার মান নিয়ন্ত্রণে সমস্যা রয়েছে। ফলে ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং গুণমান উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবস্থান শোচনীয়। তাই ২০২৫ সালে বাংলাদেশকে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ বিস্তৃত করা এবং নতুন ডাটা সেন্টার স্থাপন করা উচিত।
স্থানীয় ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের প্রসারে জোর দিতে হবে, ৫জি এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তি দ্রæত চালু করতে হবে এবং আইএসপি-গুলোর কার্যক্রম আরও কার্যকরভাবে তদারকি করতে হবে।
এছাড়া ২০২৫ সাল হতে পারে শিক্ষার পরিবেশ পুনঃরুদ্ধারের বছর। কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার নিম্ন, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। মহামারির ভয়াবহতা কমলেও, বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্লাসের সংখ্যা কমে আসা এবং অন্যান্য নানা কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘অটোপাস’ নামক বিতর্কিত একটি পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে। যদিও এটি প্রশাসনিকভাবে লাভজনক বলে মনে করা হয়েছে।
এ জন্য শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম শিক্ষার মানদÐ পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
মহামারির পর মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের খরচও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। জাতীয় একটি প্রতিবেদনে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে দেশের প্রায় ৫৯ লাখ ২০ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। মহামারির সময় গ্রামীণ পরিবারে শিক্ষার ব্যয় ১১ গুণ এবং শহুরে পরিবারে ১৩ গুণ বেড়েছে; যা দরিদ্র পরিবারের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
এসব সমস্যার কারণে ‘অটোপাস’ পদ্ধতি অনেকের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে সুবিধাজনক মনে হলেও, এটি শিক্ষার মানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায়, ২০২৫ সালে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
আসন্ন বছরে মাদ্রাসাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে সরকার ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার উদ্যোগ নিতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষত মাদ্রাসাগুলো, এখনও কিছু নির্দিষ্ট ধারায় সীমাবদ্ধ থাকলেও, অবকাঠামো এবং শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের কিছু মাদ্রাসা ইতিমধ্যেই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছে এবং তাদের পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, এবং ইংরেজি ভাষার মতো আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
উদাহরণস্বরূপÑ বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৯ সালে ঢাকার কিছু মাদ্রাসায় আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে, যেখানে ২৫-৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিষয়ক সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এসব উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে, সরকার মাদ্রাসাগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে এবং তাদেরকে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পথ সুগম করতে পারে। এর মধ্যে পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ, প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের নিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর কর্মসূচি প্রণয়ন করা বিশেষভাবে জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বর্তমান অবস্থা গভীর উদ্বেগের বিষয়। মানবিক বিভাগে স্নাতকদের ৭৪ শতাংশ, সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগে ৭১ শতাংশ, বিজ্ঞান বিভাগে ৬৬ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৬৯ শতাংশ স্নাতক চাকরি পাচ্ছেন না। এটি সরকারের জন্য একটি বড় সংকট। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক সংকট, পঠন-পাঠনে গাফিলতি ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা শেষ করে যারা চাকরির বাজারে আসছেন, তাদের একটি বড় অংশ উপযুক্ত কর্মসংস্থান পাচ্ছে না।
এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর একটি অন্যতম কারণ হলো, বেশিরভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পঠনপদ্ধতি এবং শিক্ষাদানের মান আধুনিক চাকরির বাজারের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট কার্যকর নয়।
২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬০% শিক্ষার্থী তাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা শেষে কাজের জন্য প্রস্তুত নয়, এবং এই সংকট দিন দিন আরও গভীর হচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর বিদ্যমান শিক্ষা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত ও ফলপ্রসূ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
এছাড়া, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে সরকারের উচিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক মান, গবেষণার সুযোগ-সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্য যাচাই করা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শিক্ষাদান পদ্ধতি, গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাজেট, শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া, শিক্ষার্থীদের ভর্তি নীতিমালা এবং প্রাসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, কথিত ছাত্ররাজনীতি নামক প্রচারণামূলক কর্মকাÐ বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশকে সুশৃঙ্খল এবং পবিত্র রাখতে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
পরিশেষে ২০২৫ সালের বাংলাদেশ হোক একটি স্বপ্নময় দেশ, যেখানে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সুসংগঠিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি এবং জনগণসহ সর্বস্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিশ্চিত হবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ। টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উদাহরণ হয়ে উঠুকÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়