ঢাকা ০৯:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি ছিল ধর্ষণ ও নারী-শিশু হত্যার ঘটনা

  • আপডেট সময় : ০৫:৫৮:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v62), quality = 80

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে নারীদের। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে বেশির ভাগ নারী। বিগত বছরগুলোর মতো ২০২৪ সালজুড়ে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ শিশুর প্রতি নানা সহিংস ঘটনা অব্যাহত ছিল। গত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে নারী নির্যাতন আর ধর্ষণের ঘটনা তুলনামূলক কিছতা কম হলেও ধর্ষণ শেষে হত্যা আর শিশু খুনের ঘটনা বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেশি।

এ সময়কালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, সহিংসতার কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৪৮২ শিশু। ২০২৩ সালে যার সংখ্যা ছিল ৪০৩। শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও এই বছরে বেশি সংঘটিত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত রবিবার পর্যন্ত ৫০২ জন শিশু নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালে যার সংখ্যা ছিল ৪৫৬ জন। বিদায়ি বছরের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক অস্থিরতার কারণে সারা দেশে পারিবারিক বিরোধ, পারিবারিক সহিংসতাও মারাত্মক আকার ধারণ করে। এতেও অনেক নারী ও শিশু নির্যাতন আর খুনোখুনির ঘটনা ঘটে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩২৯৪টি। নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬১২ জন। তাদের মধ্যে কন্যাশিশু ৩৩১ জন ও নারী ২৮১ জন। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১৮৫টি। যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ২৩৬টি।

পুলিশ সদর দপ্তর, হাসপাতাল, আইন সালিশ কেন্দ্রসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৪ সালের শুরু থেকে গত ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪০৭ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার। ধর্ষণ শেষে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৪৭ জন। ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশুর সংখ্যা ২৫৪ জন। ৩৯ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ৪২ কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু রয়েছে ১১ জন।

একই সূত্র মতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ১ হাজার ৫৭৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৯ জনকে। ২০২২ সালে ১ হাজার ৯৯৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের সময় এবং পরে হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে। তাদের মধ্যেও আন্দোলনে অগ্রগামী ছিল নারীরা।

গণঅভ্যুত্থানে একটা বড় শক্তির জায়গা ছিল নারীদের অংশগ্রহণ। অনেক মা সন্তানদের হারিয়েছেন, অনেকেই রাস্তায় নেমেছেন নিজের সন্তানের সঙ্গে। নারীদের আহত হওয়ার সংখ্যাটাও কম নয়।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মোট ১৩২ শিশু-কিশোর এবং ১১ নারী শহীদ হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শহীদ ১১ নারীর মধ্যে রয়েছেন মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেছা, লিজা, রিতা আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়া, নাছিমা আক্তার, রিয়া গোপ, কোহিনূর বেগম, সুমাইয়া আক্তার, মোসা. আক্তার ও নাঈমা সুলতানা। শহীদদের মধ্যে বরিশালে ১০৪ জন, চট্টগ্রামে ১২০ জন, খুলনায় ৬৮ জন, ময়মনসিংহে ৭৪ জন, রাজশাহীতে ৫৪ জন, রংপুরে ৬১ জন এবং সিলেটের ৩২ জন রয়েছেন।

এরই মধ্যে অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর যখন চলন-বলন পোশাক নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখে নারীরা, তখনই দেশের জন্য আরেক বিজয় নিয়ে আসে নারীরা।
সাফজয়ী নারী দল টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ধরে রেখেছে। এ শুধু শিরোপা জয় না, দেশের সকল নারীর জয়ের কথা বলেছিল। গত ৩০ অক্টোবর নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে আরেকবার ইতিহাস গড়লেন বাংলাদেশের মেয়েরা। স্বাগতিক নেপালকে আরেকবার বাকরুদ্ধ করে ২-১ ব্যবধানে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে হারিয়েই প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। মনিকা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমার দুই গোলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ জয়ের পেছনে রয়েছে সমাজের সঙ্গে নারীদের লড়াই করে বড় হওয়ার গল্প।

বারবার প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েও থেমে থাকেননি তারা। প্রথমবার সাফজয়ী নারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাজিয়া সুলতানা। পেটে সন্তান নিয়ে ফুটবল খেলেছেন। জয় এনেছিলেন দেশের জন্য। বাসায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। অর্থ সংকটে দ্রুত খেলায় ফিরতে চেয়েছিলেন রাজিয়া। তাই সিজারে সন্তান জন্ম দিতে চাননি। যে দেশে একজন খেলোয়াড়কে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতে হয়, অর্থসংকটে চিকিৎসা নিতে পারে না, সেই দেশে নারীদের এ জয় ছিল আকাশচুম্বী।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা বলেন, গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে আপনাদের ভালোবাসার শক্তিকে মূল্যায়ন করতে চাই। আপনাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়েই বহু পথ হাঁটতে চাই। যে পথ পেরিয়ে এসেছি, তা সহজ ছিল না। বাধামুক্ত পৃথিবী গড়ার হাতিয়ার হতে পারে ফুটবল। এটি নারীকে অগ্রসর করে তোলার একটি ধাপ।
শুধু এখানেই শেষ নয়, বছরজুড়ে নারীদের গল্প আরও আছে। বিবিসি ২০২৪ সালের বিশ্বের সবচেয়ে অনুপ্রেরণা জাগানো ও প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশি এক নারী। তার নাম রিক্তা আক্তার বানু। বিবিসি তার সম্পর্কে জানিয়েছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করেন নার্স রিক্তা আক্তার বানু। যেখানে অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়।

নিজের অটিস্টিক ও সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত কন্যাকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেননি বলে তিনি নিজের জমি বিক্রি করে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ‘রিক্তা আক্তার বানু লার্নিং ডিজেবিলিটি স্কুল’-এ এখন ৩০০ শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে এবং এটি প্রতিবন্ধিতার প্রতি সমাজের মনোভাব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুলটি প্রাথমিকভাবে অটিস্টিক বা শেখার প্রতিবন্ধকতা থাকা শিশুদের জন্য নির্মিত হলেও এখন এটি বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থাকা শিশুদের জন্যও সেবা দেয়।

গত বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বিগত সরকারের পতন। সেখানেও নারীরাই যেন জয় এনেছিল। রোকেয়া হলের তালা ভেঙে প্রথম প্রথম বেরিয়ে আসে নারীরাই। স্লোগানে উত্তাল করে তুলে রাতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর থেকে স্রোতের মতো আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষও। সেখানেও বারবার সামনে এসে দাঁড়ায় নারীরা। পুলিশের হাত থেকে ভাইকে বাঁচাতে গাড়ি আটকে দাঁড়িয়ে যান নুসরাত। যে ছবি এখনো দেখা যায় দেয়ালে দেয়ালে আঁকা শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতিতে।

পুলিশ ভ্যানের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন একা এক তরুণী। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ। ছবিটা অনেকের হৃদয়েই নাড়া দিয়েছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন যিনি এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তার নাম নুসরাত জাহান। দিনটা ছিল ৩১ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে বের হয়েছিল ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছোট্ট একটা দল। এই দলে ছিলেন আইন বিভাগের নূর আলম হাসান ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের নুসরাত জাহান। পথে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরও দুই শিক্ষার্থী।
যেহেতু সংখ্যায় তারা খুবই কম, সেহেতু গ্রেফতার এড়াতে দু’জন দু’জন ভাগ হয়ে দূরত্ব রেখে এগোচ্ছিলেন। একপর্যায়ে হাইকোর্টের মাজারগেট থেকে কিছতা দূরে অবস্থান নেন তারা।

সেখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী আগে থেকেই ছিল। কিছুক্ষণ পর পুলিশের একটি দল শিক্ষার্থীদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেদের আটক করতে শুরু করে। নুসরাত বলেন, ‘ওই সময় নূর ভাই আমার পাশেই ছিল। পুলিশ যখন নূর ভাইয়াকে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি হাত ধরে রাখি। এ রকম অন্যায়ভাবে কাউকে তারা আটক করতে পারে না, তাই বাধা দিচ্ছিলাম। পরে একজন পুলিশ আমার হাতে আঘাত করে, ভাইয়াকে নিয়ে যায়।’
শুধু সম্মুখ সারিতে নুসরাতের গল্প নয়, পেছনে থেকেও পাশে থেকেছেন নারীরা। এমন হাজার গল্প রচিত হয়েছে এ বছর। যা আগামী বছরেও নারীদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি ছিল ধর্ষণ ও নারী-শিশু হত্যার ঘটনা

আপডেট সময় : ০৫:৫৮:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে নারীদের। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে বেশির ভাগ নারী। বিগত বছরগুলোর মতো ২০২৪ সালজুড়ে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ শিশুর প্রতি নানা সহিংস ঘটনা অব্যাহত ছিল। গত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে নারী নির্যাতন আর ধর্ষণের ঘটনা তুলনামূলক কিছতা কম হলেও ধর্ষণ শেষে হত্যা আর শিশু খুনের ঘটনা বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেশি।

এ সময়কালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, সহিংসতার কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৪৮২ শিশু। ২০২৩ সালে যার সংখ্যা ছিল ৪০৩। শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও এই বছরে বেশি সংঘটিত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত রবিবার পর্যন্ত ৫০২ জন শিশু নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালে যার সংখ্যা ছিল ৪৫৬ জন। বিদায়ি বছরের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক অস্থিরতার কারণে সারা দেশে পারিবারিক বিরোধ, পারিবারিক সহিংসতাও মারাত্মক আকার ধারণ করে। এতেও অনেক নারী ও শিশু নির্যাতন আর খুনোখুনির ঘটনা ঘটে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩২৯৪টি। নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬১২ জন। তাদের মধ্যে কন্যাশিশু ৩৩১ জন ও নারী ২৮১ জন। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১৮৫টি। যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ২৩৬টি।

পুলিশ সদর দপ্তর, হাসপাতাল, আইন সালিশ কেন্দ্রসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৪ সালের শুরু থেকে গত ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪০৭ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার। ধর্ষণ শেষে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৪৭ জন। ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশুর সংখ্যা ২৫৪ জন। ৩৯ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ৪২ কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু রয়েছে ১১ জন।

একই সূত্র মতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ১ হাজার ৫৭৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৯ জনকে। ২০২২ সালে ১ হাজার ৯৯৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের সময় এবং পরে হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে। তাদের মধ্যেও আন্দোলনে অগ্রগামী ছিল নারীরা।

গণঅভ্যুত্থানে একটা বড় শক্তির জায়গা ছিল নারীদের অংশগ্রহণ। অনেক মা সন্তানদের হারিয়েছেন, অনেকেই রাস্তায় নেমেছেন নিজের সন্তানের সঙ্গে। নারীদের আহত হওয়ার সংখ্যাটাও কম নয়।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মোট ১৩২ শিশু-কিশোর এবং ১১ নারী শহীদ হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শহীদ ১১ নারীর মধ্যে রয়েছেন মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেছা, লিজা, রিতা আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়া, নাছিমা আক্তার, রিয়া গোপ, কোহিনূর বেগম, সুমাইয়া আক্তার, মোসা. আক্তার ও নাঈমা সুলতানা। শহীদদের মধ্যে বরিশালে ১০৪ জন, চট্টগ্রামে ১২০ জন, খুলনায় ৬৮ জন, ময়মনসিংহে ৭৪ জন, রাজশাহীতে ৫৪ জন, রংপুরে ৬১ জন এবং সিলেটের ৩২ জন রয়েছেন।

এরই মধ্যে অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর যখন চলন-বলন পোশাক নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখে নারীরা, তখনই দেশের জন্য আরেক বিজয় নিয়ে আসে নারীরা।
সাফজয়ী নারী দল টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ধরে রেখেছে। এ শুধু শিরোপা জয় না, দেশের সকল নারীর জয়ের কথা বলেছিল। গত ৩০ অক্টোবর নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে আরেকবার ইতিহাস গড়লেন বাংলাদেশের মেয়েরা। স্বাগতিক নেপালকে আরেকবার বাকরুদ্ধ করে ২-১ ব্যবধানে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে হারিয়েই প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। মনিকা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমার দুই গোলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ জয়ের পেছনে রয়েছে সমাজের সঙ্গে নারীদের লড়াই করে বড় হওয়ার গল্প।

বারবার প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েও থেমে থাকেননি তারা। প্রথমবার সাফজয়ী নারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাজিয়া সুলতানা। পেটে সন্তান নিয়ে ফুটবল খেলেছেন। জয় এনেছিলেন দেশের জন্য। বাসায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। অর্থ সংকটে দ্রুত খেলায় ফিরতে চেয়েছিলেন রাজিয়া। তাই সিজারে সন্তান জন্ম দিতে চাননি। যে দেশে একজন খেলোয়াড়কে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতে হয়, অর্থসংকটে চিকিৎসা নিতে পারে না, সেই দেশে নারীদের এ জয় ছিল আকাশচুম্বী।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা বলেন, গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে আপনাদের ভালোবাসার শক্তিকে মূল্যায়ন করতে চাই। আপনাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়েই বহু পথ হাঁটতে চাই। যে পথ পেরিয়ে এসেছি, তা সহজ ছিল না। বাধামুক্ত পৃথিবী গড়ার হাতিয়ার হতে পারে ফুটবল। এটি নারীকে অগ্রসর করে তোলার একটি ধাপ।
শুধু এখানেই শেষ নয়, বছরজুড়ে নারীদের গল্প আরও আছে। বিবিসি ২০২৪ সালের বিশ্বের সবচেয়ে অনুপ্রেরণা জাগানো ও প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশি এক নারী। তার নাম রিক্তা আক্তার বানু। বিবিসি তার সম্পর্কে জানিয়েছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করেন নার্স রিক্তা আক্তার বানু। যেখানে অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়।

নিজের অটিস্টিক ও সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত কন্যাকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেননি বলে তিনি নিজের জমি বিক্রি করে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ‘রিক্তা আক্তার বানু লার্নিং ডিজেবিলিটি স্কুল’-এ এখন ৩০০ শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে এবং এটি প্রতিবন্ধিতার প্রতি সমাজের মনোভাব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুলটি প্রাথমিকভাবে অটিস্টিক বা শেখার প্রতিবন্ধকতা থাকা শিশুদের জন্য নির্মিত হলেও এখন এটি বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থাকা শিশুদের জন্যও সেবা দেয়।

গত বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বিগত সরকারের পতন। সেখানেও নারীরাই যেন জয় এনেছিল। রোকেয়া হলের তালা ভেঙে প্রথম প্রথম বেরিয়ে আসে নারীরাই। স্লোগানে উত্তাল করে তুলে রাতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর থেকে স্রোতের মতো আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষও। সেখানেও বারবার সামনে এসে দাঁড়ায় নারীরা। পুলিশের হাত থেকে ভাইকে বাঁচাতে গাড়ি আটকে দাঁড়িয়ে যান নুসরাত। যে ছবি এখনো দেখা যায় দেয়ালে দেয়ালে আঁকা শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতিতে।

পুলিশ ভ্যানের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন একা এক তরুণী। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ। ছবিটা অনেকের হৃদয়েই নাড়া দিয়েছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন যিনি এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তার নাম নুসরাত জাহান। দিনটা ছিল ৩১ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে বের হয়েছিল ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছোট্ট একটা দল। এই দলে ছিলেন আইন বিভাগের নূর আলম হাসান ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের নুসরাত জাহান। পথে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরও দুই শিক্ষার্থী।
যেহেতু সংখ্যায় তারা খুবই কম, সেহেতু গ্রেফতার এড়াতে দু’জন দু’জন ভাগ হয়ে দূরত্ব রেখে এগোচ্ছিলেন। একপর্যায়ে হাইকোর্টের মাজারগেট থেকে কিছতা দূরে অবস্থান নেন তারা।

সেখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী আগে থেকেই ছিল। কিছুক্ষণ পর পুলিশের একটি দল শিক্ষার্থীদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেদের আটক করতে শুরু করে। নুসরাত বলেন, ‘ওই সময় নূর ভাই আমার পাশেই ছিল। পুলিশ যখন নূর ভাইয়াকে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি হাত ধরে রাখি। এ রকম অন্যায়ভাবে কাউকে তারা আটক করতে পারে না, তাই বাধা দিচ্ছিলাম। পরে একজন পুলিশ আমার হাতে আঘাত করে, ভাইয়াকে নিয়ে যায়।’
শুধু সম্মুখ সারিতে নুসরাতের গল্প নয়, পেছনে থেকেও পাশে থেকেছেন নারীরা। এমন হাজার গল্প রচিত হয়েছে এ বছর। যা আগামী বছরেও নারীদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।