নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে নিউমার্কেট থানাধীন গাউছিয়া মার্কেটের সামনে মিরপুর সুপার লিংক লিমিটেড বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর (ডিবি) গোয়েন্দা-উত্তরা বিভাগ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, বাসে অগ্নিসংযোগের ভিডিও লন্ডনে পাঠানো হতো। এদিকে গত ১৮ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের কালশী এলাকায় বসুমতি পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেনÑআল মোহাম্মদ চাঁন (২৭), মো. সাগর (২৫), মো. আল আমিন ওরফে রুবেল (২৯) ও মো. খোরশেদ আলম (৩৪)। র্যাব জানায়, বাসে আগুন দেওয়ার জন্য আল মোহাম্মদ চাঁন নির্দেশদাতাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে পান। সাগর ও আল আমিনকে তিনি ৭ হাজার টাকা করে দেন। বাসে আগুন দেওয়ার জন্য বন্ধুর মোটরসাইকেল থেকে ২৫০ এমএল পরিমাণ পেট্রোল বের করে টাইগার এনার্জি ড্রিংকের বোতলে ভরে আল আমিনের কাছে দেন চাঁন।
গত সোমবার (২০ নভেম্বর) রাতে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। গতকাল মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। তাদের দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনায় তারা রাজধানীর মিরপুর ও পল্লবীর আশপাশের এলাকায় বাসে অগ্নিসংযোগ করার পরিকল্পনা করে। ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় চাঁন ও তার সহযোগীরা মিরপুর-১১, তালতলা নাভানা, কালশী রোড ও সিরামিক রোড এলাকায় যানবাহনে আগুন দেওয়ার জন্য রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত রেকি করে। তিনি বলেন, আল মোহাম্মদ চাঁন যানবাহনে আগুন দেওয়ার জন্য তার বন্ধুর মোটরসাইকেল থেকে ২৫০ এমএল পরিমাণ পেট্রোল বের করে টাইগার এনার্জি ড্রিংকের বোতলে ভরে আল আমিনের কাছে দেয়। পরে রাত ১১টার দিকে কালশী সড়কে মসজিদের পাশে পার্ক করা বসুমতি পরিবহনের একটি বাসের কাছে যায় সাগর ও আলআমিন। আল আমিন বাসের মাঝের জানালা খুলে পেট্রোল ঢেলে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ঘটনার সময় চাঁন রাস্তার আইল্যান্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অন্য কেউ যাতে কৃতিত্ব নিতে না পারে সেজন্য তিনি বাসে আগুন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খোরশেদকে ভিডিও ধারণ করে তাকে পাঠাতে বলেন। পরে চাঁন ভিডিওটি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের কাছে প্রেরণ করেন। কমান্ডার মঈন বলেন, এছাড়া তারা নাশকতার এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে তাদের সমমনা অন্যান্য অনুসারীদের নাশকতা সৃষ্টিতে প্ররোচিত করত। পরে স্থানীয় শীর্ষ নেতারা চাঁনকে ২১ নভেম্বর সন্ধ্যায়ও একইভাবে গাড়ি পোড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিল।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কার কী ভূমিকা: র্যাব জানায়, আল মোহাম্মদ চাঁন দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে মিরপুর এলাকায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা ও সহিংসতার পরিকল্পনা এবং নেতৃত্ব দেন। এছাড়া তিনি নাশকতা ঘটানোর জন্য সমর্থকদের কাজ ভাগ করে দিতো এবং টাকা সংগ্রহ করে সবার মাঝে বিতরণ করত। মো. সাগর চাঁনের সহযোগী। সে নাশকতার জন্য সুবিধাজনক টার্গেট ও স্থান রেকি করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করত। আল আমিন ওরফে রুবেলও চাঁনের সহযোগী এবং সাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে চাঁনের নির্দেশে কালশী সড়কে বসুমতি পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। আর খোরশেদ আলম চাঁনের নির্দেশে রাজধানীর কালশী সড়কে বসুমতি পরিবহনের বাসে অগ্নিসংযোগের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ছবি তুলে এবং ভিডিও ধারণ করে চাঁনকে পাঠায়।
বাসে অগ্নিসংযোগের ভিডিও পাঠানো হয় লন্ডনে: ডিবি প্রধান: গত ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে নিউমার্কেট থানাধীন গাউছিয়া মার্কেটের সামনে মিরপুর সুপার লিংক লিমিটেড বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর (ডিবি) গোয়েন্দা-উত্তরা বিভাগ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, বাসে অগ্নিসংযোগের ভিডিও লন্ডনে পাঠানো হতো। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গ্রেপ্তাররা হলেন, তানভীর আহমেদ (২৭), দেলোয়ার হোসেন (৫১) ও মো. ফারুক হোসেন (৪৩)। গ্রেপ্তারদের মধ্যে তানভীর আহমেদ ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক। দেলোয়ার হোসেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি ও ফারুক হোসেন বিএনপির সক্রিয় সদস্য। হারুন অর রশীদ বলেন, ‘‘বাসে অগ্নিসংযোগকারী তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর নিউমার্কেট যাত্রী ছাউনির পাশে বাসে আগুন লাগানোর ঘটনায় ডিবি-উত্তরা বিভাগ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার তানভীর আহমেদই সেদিন বাসটিতে আগুন দেয়। পরে তিনি নিজের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার থেকে আগুন লাগানোর কথা জানান তার এক বন্ধুর কাছে। কথোপকথনে তানভীর লিখেছেন, ‘আগুন লাগিয়ে কী হবে? আমরা আগুন লাগাচ্ছি আর লন্ডনে যারা আছেন তারা ভালো আছেন। উল্টো আগুন দিতে গিয়ে আমরা ধরা পড়ছি।’ তাদের মধ্যে এমন কথোপকথন হয়েছে। তাকে যখন ডিবিতে নিয়ে আসা হলো, তখন তিনি স্বীকার করেছেন যে এটি তিনি লিখেছেন।’’ তিনি বলেন, ‘ডিবির কাছে তানভীর বলেছেন, আমরা আগুন লাগাচ্ছি ও ককটেল নিক্ষেপ করছি। কিন্তু জেলে গেলে আমাদের দেখার কেউ নেই। যারা নির্দেশ দিচ্ছেন তারা কোথাও লুকিয়ে আছেন অথবা বিদেশে অবস্থান করছেন।’ তানভীরকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ডিবি প্রধান বলেন, ‘অনেকের নাম ও নম্বর পেয়েছি। তানভীরের সঙ্গে আর কারা কারা ছিল এসব বিষয় জানা যাবে। মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া থাকে যে, আগুন লাগানোর পর দলের সিনিয়র নেতাকর্মীদের ছবি-ভিডিও দেখাতে হবে। আগুন দেওয়ার সময় মুখে মাস্ক ও রুমাল ব্যবহার করতে হবে। যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে আগুন দিতে হবে। এরপর আগুন লাগিয়ে টাকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ককটেল কিনে এনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আবার কোথাও পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া হচ্ছে।’ ‘ডিবির বিভিন্ন টিম ইতোমধ্যে অনেককে আইনের আওতায় এনেছে। তাদের মধ্যে অনেকে আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ জবানবন্দি দিয়েছেন। কে কে তাদের সহয়তা করছে তাদের নামও আমরা পেয়েছি।’ ‘যার গাড়িতে আগুন লাগাচ্ছেন… তিনি হয়ত জীবনের শেষ সম্বল বিক্রি করে প্রতিদিনের রোজগারের জন্য বাসটি চালান। আপনারা যে বাসটি পুড়িয়ে ফেলছেন, আসলে একজন মানুষের স্বপ্ন পুড়িয়ে ফেলছেন। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে আগুনের পথ থেকে সরে আসুন। নয়তো আপনারা অবশ্যই গ্রেপ্তার হবেন। লুকিয়ে থাকলেও পার পাওয়া যাবে না।’ লন্ডন থেকে নেতাকর্মীদের কাছে বাসে অগ্নিসংযোগের কোনো নির্দেশনা আসছে কি না, জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা অনেককে গ্রেপ্তার করেছি। তারা বলছে, আগুন লাগানোর পরে সিনিয়র নেতাদের ভিডিও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে লন্ডন ও ঢাকার ঊর্ধ্বতন নেতাদের কথাও বলেছে। অগ্নিসংযোগের পরে গ্রেপ্তাররা অনুতপ্ত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগুন লাগানোর শেষ কোথায়… বিষয়টি তারাও উদ্বিগ্ন। তারা ধরা পরলে জামিনের জন্য তাদের বড় ভাইয়েরা কাজ করবে কি না এ নিয়েও উদ্বিগ্ন। গত সোমবার হরতাল ছিল। হরতালের মধ্যেও প্রচুর গাড়ি বের হয়েছিল। সাধারণ মানুষ আগুন লাগানো, ককটেল নিক্ষেপ পছন্দ করছে না। আমরা বার বার বলছি যে, নাশকতা এবং জনমনে সৃষ্টি করলে পুলিশ ডিমোরালাইজড হবে না।’