ঢাকা ০৭:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বাবা হত্যার বিচার চায় তৌহিদুলের শিশুকন্যা

‘হেফাজতে’ যুবদল নেতার মৃত্যু

  • আপডেট সময় : ০৪:৪৬:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

তৌহিদুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: কুমিল্লায় যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার পর মারা যাওয়া যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের (৪০) বাড়িতে কান্নার রোল। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) রাত আটটার দিকে স্বজনেরা তৌহিদুলের নিথর দেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার কথা।

যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার পর যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর প্রতিবাদে শনিবার সকালে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ইটাল্লা গ্রামে মানববন্ধন করেছেন গ্রামবাসী। সেখানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এরপর অমানবিক নির্যাতন করে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার অবুঝ মেয়েগুলোকে যারা এতিম করেছে, তাদের বিচার চাই। আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তাহলে আমরা কেন বিচার পাব না?’

নিহত তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানেরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তৌহিদুল ইসলামকে তুলে নেওয়ার বর্ণনা দেন। শনিবার দুপুরে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে থেকে তোলা ছবিটি সংগৃহীত

বাবাকে হারিয়ে তৌহিদুলের বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের কান্না থামছেই না। তাসফিয়া বলেন, ‘আমরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকব। আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালো বাবাটাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চার বোন এতিম হয়ে গেছি। আমরা বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

মাত্র ছয় দিন আগে তৌহিদুলের বাবা মোখলেছুর রহমান (৮৫) বার্ধক্যের কারণে মারা যান। তাঁর কুলখানির আয়োজন করা হয়েছিল শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি)। সেটি শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। তৌহিদুলের মৃত্যুতে এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু।

তৌহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি। তাঁর শরীরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন থাকার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক ও স্বজনেরা। তবে বিষয়টি নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তৌহিদুলের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি এবং ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ হস্তান্তর করেছি।’

অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন ওই যুবদল নেতার পরিবার ও স্বজনেরা। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকালে তৌহিদুলের ভগ্নিপতি সোহেল মহিউদ্দিন একটি শীর্ষ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কতটা অমানবিক নির্যাতন করে তৌহিদুলকে মেরে ফেলা হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, একটি জিডিও ছিল না। আমরা এ ঘটনায় অবশ্যই মামলা করব। থানায় মামলা না নিলে আদালতে যাবো। তৌহিদুলের চারটি মেয়ে এতিম হয়ে গেল।’

তৌহিদুল ইসলামের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ‘আমার ভাইকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা যখন আমাদের বাড়িতে তল্লাশি করে, তখন বারবার বলছিল, অস্ত্র কোথায়। আমরা কোথা থেকে তাদের অস্ত্র দিতাম? ভিত্তিহীন একটি তথ্যে আমার ভাইকে নির্যাতন করে মেরে ফেলল তারা। আমরা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও বিচার চাই।’

তৌহিদুলের আরেক ভগ্নিপতি খান-ই-আলম বলেন, ‘বাড়ির পাশের একটি পরিবারের সঙ্গে তৌহিদুলদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। আমরা সন্দেহ করছি, তারাই আর্মিকে ভুয়া তথ্য দিয়েছে, তৌহিদুলের কাছে অস্ত্র আছে। আমরা পুরো ঘটনার তদন্ত চাই। যারা ঘটনার নেপথ্যে ছিল, তাদেরও বিচার চাই।’

তৌহিদুল ইসলাম কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি একই ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে একটি শিপিং এজেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁরা চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে তৌহিদুল তৃতীয়। তৌহিদুলের মা প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর নিজের সংসারে স্ত্রী ও চার মেয়ে আছে। চারজনের মধ্যে বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের বয়স ১৪ বছর, অন্যরা এখনো শিশু। স্বামীকে হারিয়ে দিশাহারা তৌহিদুলের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার।

লাশবাহী গাড়ি রেখে মানববন্ধন: শনিবার সকালে ইটাল্লা গ্রামে দেখা যায়, লাশবাহী ফ্রিজার অ্যাম্বুলেন্সে রাখা হয়েছে তৌহিদুলের নিথর দেহ। আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী তৌহিদুলের বাড়িতে ভিড় করেছেন তাঁকে শেষবারের মতো একনজর দেখার জন্য। তৌহিদুলের স্ত্রী, চার মেয়ে আর স্বজনদের কান্না কিছুতেই থামছে না।

সকাল ১০টার দিকে ইটাল্লা গ্রামের সড়কের ওপর লাশবাহী গাড়ি রেখে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন শত শত মানুষ। ওই যুবদল নেতাকে তুলে নিয়ে ‘নৃশংসভাবে হত্যা’ করা হয়েছে দাবি করেন এলাকাবাসী। চার মেয়েকে নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেন তৌহিদুলের স্ত্রীও। তাঁরা লাশবাহী গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে লাশবাহী গাড়ি সামনে নিয়ে আরেকটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। দুপুর ১টা পর্যন্ত চলা এই মানববন্ধনে তৌহিদুলের পরিবারের সদস্যরাসহ গ্রামবাসী অংশ নেন। মানববন্ধনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এরপর অমানবিক নির্যাতন করে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার অবুঝ মেয়েগুলোকে যারা এতিম করেছে, তাদের বিচার চাই। আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তাহলে আমরা কেন বিচার পাব না?’

বাবাকে হারিয়ে তৌহিদুলের বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের কান্না থামছেই না। তাসফিয়া বলেন, ‘আমরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকব। আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালো বাবাটাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চার বোন এতিম হয়ে গেছি। আমরা বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

মানববন্ধনে স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, ‘একজন ভালো মানুষকে তারা তুলে নিয়ে হত্যা করল। আমরা বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই। আমরা এখন মরদেহ নিয়ে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে মানববন্ধন করব। হত্যার বিচার চাইব।’

যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার পর যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর প্রতিবাদে শনিবার সকালে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ইটাল্লা গ্রামে মানববন্ধন করেন গ্রামবাসী। ছবি সংগৃহীত

তৌহিদুল ইসলামের ভাই সাদেকুর রহমান ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘গত ২৬ জানুয়ারি আমার বাবা মারা যান। মৃত্যুর খবর পেয়ে ওই দিনই চট্টগ্রাম থেকে বাড়িতে আসে আমার ভাই তৌহিদুল ইসলাম। শুক্রবার বাবার কুলখানি ছিল। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আমরা বাড়িতে কুলখানির আয়োজন নিয়ে কাজ করছিলাম। রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাড়িতে আসে। তাদের সঙ্গে পুলিশের পোশাক পরা কাউকে দেখিনি, তবে সাদাপোশাকে পাঁচজন যুবক ছিল। বাড়িতে প্রবেশ করেই তারা তৌহিদুলকে আটক করে। এরপর আমাদের সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে যায়। তারা আমাদের ঘরে ব্যাপক তল্লাশি করে, তবে কিছু পায়নি। আমরা বারবার জিজ্ঞাসা করি, তৌহিদুলকে কেন আটক করছেন? কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু বলে, অস্ত্র কোথায়? একপর্যায়ে তারা আমার ভাইকে বাড়ি থেকে ধরে তাদের গাড়িতে করে নিয়ে যায়। এরপর শুক্রবার সকালে আবারও সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে এসে ব্যাপক তল্লাশি করে, তখনো কিছু পায়নি।’

সাদেকুর রহমান আরও বলেন, ‘শুক্রবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোরশেদ আলম আমাদের অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে কল করে জানান, তৌহিদুলের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা যেন দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসি। হাসপাতালে আসার পর দেখি, তৌহিদুল আর নেই। তাকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তার কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত এমনভাবে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে যে কালো ফোলা জখমের চিহ্ন রয়েছে। আমার ভাইয়ের পেট, বুক, পিঠ, পা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে শুধুই নির্যাতনের চিহ্ন।’

এর আগে শুক্রবার বিকেলে এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাইফুল মালিক বলেন, ‘শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে থানা-পুলিশকে বলা হয় তৌহিদুল ইসলামকে নেওয়ার জন্য। যখন পুলিশের কাছে তৌহিদুলকে হস্তান্তর করা হয়, তখন তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেছেন। তাঁকে কেন আটক করা হয়েছিল বা কীভাবে তিনি মারা গেছেন, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা বিষয়টির বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। আর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাবা হত্যার বিচার চায় তৌহিদুলের শিশুকন্যা

‘হেফাজতে’ যুবদল নেতার মৃত্যু

আপডেট সময় : ০৪:৪৬:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: কুমিল্লায় যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার পর মারা যাওয়া যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের (৪০) বাড়িতে কান্নার রোল। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) রাত আটটার দিকে স্বজনেরা তৌহিদুলের নিথর দেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার কথা।

যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার পর যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর প্রতিবাদে শনিবার সকালে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ইটাল্লা গ্রামে মানববন্ধন করেছেন গ্রামবাসী। সেখানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এরপর অমানবিক নির্যাতন করে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার অবুঝ মেয়েগুলোকে যারা এতিম করেছে, তাদের বিচার চাই। আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তাহলে আমরা কেন বিচার পাব না?’

নিহত তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানেরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তৌহিদুল ইসলামকে তুলে নেওয়ার বর্ণনা দেন। শনিবার দুপুরে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে থেকে তোলা ছবিটি সংগৃহীত

বাবাকে হারিয়ে তৌহিদুলের বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের কান্না থামছেই না। তাসফিয়া বলেন, ‘আমরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকব। আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালো বাবাটাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চার বোন এতিম হয়ে গেছি। আমরা বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

মাত্র ছয় দিন আগে তৌহিদুলের বাবা মোখলেছুর রহমান (৮৫) বার্ধক্যের কারণে মারা যান। তাঁর কুলখানির আয়োজন করা হয়েছিল শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি)। সেটি শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। তৌহিদুলের মৃত্যুতে এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু।

তৌহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি। তাঁর শরীরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন থাকার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক ও স্বজনেরা। তবে বিষয়টি নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তৌহিদুলের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি এবং ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ হস্তান্তর করেছি।’

অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন ওই যুবদল নেতার পরিবার ও স্বজনেরা। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকালে তৌহিদুলের ভগ্নিপতি সোহেল মহিউদ্দিন একটি শীর্ষ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কতটা অমানবিক নির্যাতন করে তৌহিদুলকে মেরে ফেলা হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, একটি জিডিও ছিল না। আমরা এ ঘটনায় অবশ্যই মামলা করব। থানায় মামলা না নিলে আদালতে যাবো। তৌহিদুলের চারটি মেয়ে এতিম হয়ে গেল।’

তৌহিদুল ইসলামের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ‘আমার ভাইকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা যখন আমাদের বাড়িতে তল্লাশি করে, তখন বারবার বলছিল, অস্ত্র কোথায়। আমরা কোথা থেকে তাদের অস্ত্র দিতাম? ভিত্তিহীন একটি তথ্যে আমার ভাইকে নির্যাতন করে মেরে ফেলল তারা। আমরা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও বিচার চাই।’

তৌহিদুলের আরেক ভগ্নিপতি খান-ই-আলম বলেন, ‘বাড়ির পাশের একটি পরিবারের সঙ্গে তৌহিদুলদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। আমরা সন্দেহ করছি, তারাই আর্মিকে ভুয়া তথ্য দিয়েছে, তৌহিদুলের কাছে অস্ত্র আছে। আমরা পুরো ঘটনার তদন্ত চাই। যারা ঘটনার নেপথ্যে ছিল, তাদেরও বিচার চাই।’

তৌহিদুল ইসলাম কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি একই ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে একটি শিপিং এজেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁরা চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে তৌহিদুল তৃতীয়। তৌহিদুলের মা প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর নিজের সংসারে স্ত্রী ও চার মেয়ে আছে। চারজনের মধ্যে বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের বয়স ১৪ বছর, অন্যরা এখনো শিশু। স্বামীকে হারিয়ে দিশাহারা তৌহিদুলের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার।

লাশবাহী গাড়ি রেখে মানববন্ধন: শনিবার সকালে ইটাল্লা গ্রামে দেখা যায়, লাশবাহী ফ্রিজার অ্যাম্বুলেন্সে রাখা হয়েছে তৌহিদুলের নিথর দেহ। আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী তৌহিদুলের বাড়িতে ভিড় করেছেন তাঁকে শেষবারের মতো একনজর দেখার জন্য। তৌহিদুলের স্ত্রী, চার মেয়ে আর স্বজনদের কান্না কিছুতেই থামছে না।

সকাল ১০টার দিকে ইটাল্লা গ্রামের সড়কের ওপর লাশবাহী গাড়ি রেখে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন শত শত মানুষ। ওই যুবদল নেতাকে তুলে নিয়ে ‘নৃশংসভাবে হত্যা’ করা হয়েছে দাবি করেন এলাকাবাসী। চার মেয়েকে নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেন তৌহিদুলের স্ত্রীও। তাঁরা লাশবাহী গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে লাশবাহী গাড়ি সামনে নিয়ে আরেকটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। দুপুর ১টা পর্যন্ত চলা এই মানববন্ধনে তৌহিদুলের পরিবারের সদস্যরাসহ গ্রামবাসী অংশ নেন। মানববন্ধনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এরপর অমানবিক নির্যাতন করে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার অবুঝ মেয়েগুলোকে যারা এতিম করেছে, তাদের বিচার চাই। আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তাহলে আমরা কেন বিচার পাব না?’

বাবাকে হারিয়ে তৌহিদুলের বড় মেয়ে তাসফিয়া আক্তারের কান্না থামছেই না। তাসফিয়া বলেন, ‘আমরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকব। আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালো বাবাটাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চার বোন এতিম হয়ে গেছি। আমরা বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

মানববন্ধনে স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, ‘একজন ভালো মানুষকে তারা তুলে নিয়ে হত্যা করল। আমরা বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই। আমরা এখন মরদেহ নিয়ে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে মানববন্ধন করব। হত্যার বিচার চাইব।’

যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার পর যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর প্রতিবাদে শনিবার সকালে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ইটাল্লা গ্রামে মানববন্ধন করেন গ্রামবাসী। ছবি সংগৃহীত

তৌহিদুল ইসলামের ভাই সাদেকুর রহমান ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘গত ২৬ জানুয়ারি আমার বাবা মারা যান। মৃত্যুর খবর পেয়ে ওই দিনই চট্টগ্রাম থেকে বাড়িতে আসে আমার ভাই তৌহিদুল ইসলাম। শুক্রবার বাবার কুলখানি ছিল। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আমরা বাড়িতে কুলখানির আয়োজন নিয়ে কাজ করছিলাম। রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাড়িতে আসে। তাদের সঙ্গে পুলিশের পোশাক পরা কাউকে দেখিনি, তবে সাদাপোশাকে পাঁচজন যুবক ছিল। বাড়িতে প্রবেশ করেই তারা তৌহিদুলকে আটক করে। এরপর আমাদের সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে যায়। তারা আমাদের ঘরে ব্যাপক তল্লাশি করে, তবে কিছু পায়নি। আমরা বারবার জিজ্ঞাসা করি, তৌহিদুলকে কেন আটক করছেন? কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু বলে, অস্ত্র কোথায়? একপর্যায়ে তারা আমার ভাইকে বাড়ি থেকে ধরে তাদের গাড়িতে করে নিয়ে যায়। এরপর শুক্রবার সকালে আবারও সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে এসে ব্যাপক তল্লাশি করে, তখনো কিছু পায়নি।’

সাদেকুর রহমান আরও বলেন, ‘শুক্রবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোরশেদ আলম আমাদের অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে কল করে জানান, তৌহিদুলের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা যেন দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসি। হাসপাতালে আসার পর দেখি, তৌহিদুল আর নেই। তাকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তার কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত এমনভাবে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে যে কালো ফোলা জখমের চিহ্ন রয়েছে। আমার ভাইয়ের পেট, বুক, পিঠ, পা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে শুধুই নির্যাতনের চিহ্ন।’

এর আগে শুক্রবার বিকেলে এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাইফুল মালিক বলেন, ‘শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে থানা-পুলিশকে বলা হয় তৌহিদুল ইসলামকে নেওয়ার জন্য। যখন পুলিশের কাছে তৌহিদুলকে হস্তান্তর করা হয়, তখন তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেছেন। তাঁকে কেন আটক করা হয়েছিল বা কীভাবে তিনি মারা গেছেন, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা বিষয়টির বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। আর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’