অধ্যাপক ডা. এম এ খান : পৃথিবীতে বিচিত্র রকমের রোগে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে কিছু রোগ খুবই পরিচিত। আবার কিছু রোগ বিরল। এসব রোগের নাম অনেক মানুষের অজানা। এমনই একটি রোগ হলো হিমোফিলিয়া। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
হিমোফিলিয়া আসলে কী: হিমোফিলিয়া শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ হাইমা ও ফিলিয়া থেকে। হাইমা অর্থ রক্ত ও ফিলিয়া অর্থ আকর্ষণ। দেহের কোনো অংশে রক্তপাত শুরু হলে সাধারণত সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। এ প্রক্রিয়াকে ক্লটিং বলে। ক্লটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কোনো কারণে ক্ষতস্থানে এ ক্লট তৈরি না হলে সেখান থেকে একাধারে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। একজন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে এ ক্লট সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক নয়। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
জিনগত রোগ: হিমোফিলিয়া বাবা-মায়ের জিন থেকে সন্তানের শরীরে প্রবেশ করে। পুরুষদের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং নারীরা বংশানুক্রমে এ রোগের জিন বহন করে। হিমোফিলিয়া একটি জন্মগত রক্তরোগ, যেখানে রক্ত স্বাভাবিকভাবে জমাট বাঁধতে পারে না। রক্ত জমাট বাঁধার জন্য শরীরের যে উপকরণ থাকে, হিমোফিলিয়া রোগীর দেহে সেটি কম থাকে। আন্তর্জাতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, হিমোফিলিয়া প্রতি ১০ হাজারে একজনের মধ্যে দেখা দেয়। তবে বাংলাদেশে কতজন হিমোফিলিয়া রোগী রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
হিমোফিলিয়ার প্রকারভেদ: শরীরে ক্লটিং ফ্যাক্টরের অভাবের ওপর ভিত্তি করে হিমোফিলিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। তা হলো-
এক. হিমোফিলিয়া এ: ক্লটিং ফ্যাক্টর ৮-এর অভাবে হয়।
দুই. হিমোফিলিয়া বি: ক্লটিং ফ্যাক্টর ৯-এর অভাবে হয়।
যদি বাবা হিমোফিলিয়ার রোগী হন এবং মায়ের মধ্যে হিমোফিলিয়ার জিন না থাকে, তাহলে সন্তানদের সবাই সুস্থ হয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং মেয়ে সন্তান রোগের জিন বহন করে। যদি কোনো মেয়ের দেহে হিমোফিলিয়ার জিন থাকে এবং তার স্বামী সুস্থ থাকেন, তাহলে ছেলে সন্তানদের ৫০ শতাংশ হিমোফিলিয়া রোগ নিয়ে এবং মেয়ে সন্তানদের ৫০ শতাংশ রোগের বাহক হিসেবে জন্ম নেয়। যদি বাবা হিমোফিলিয়া রোগী ও মা বহনকারী হন, তাহলে মেয়ে সন্তানদের মধ্যেও হিমোফিলিয়া দেখা দিতে পারে।
হিমোফিলিয়ার প্রকাশ: সাধারণত ক্লটিং ফ্যাক্টরের পরিমাণের ওপর এ রোগের প্রকার নির্ভর করে। ফ্যাক্টর যত কম হবে, রোগ তত বেশি প্রকট হবে। অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণই এ রোগের প্রকাশ জানান দেয়। এ রোগ থাকলে শিশু খেলাধুলার সময় পড়ে গেলে মাংসপেশিতে কালশিরা পড়ে যায়। অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণের ফলে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ফুলে যায় এবং ব্যথা থাকে। খতনা করার পর অতিরিক্ত রক্তপাত হতে থাকে। দুর্ঘটনা ঘটলে বা শরীরের কোনো স্থান কেটে গেলে একটানা রক্ত ঝরতে থাকে। চামড়ার নিচে ছোট রক্তক্ষরণ থেকে শুরু করে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন অস্থিসন্ধি, মস্তিষ্ক, পেটের গহ্বর ইত্যাদি কেটে গেলে বা সার্জারির সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
হিমোফিলিয়া সোসাইটির তথ্য মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসেবে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৬ হাজার থাকার কথা থাকলেও দেশে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আছে প্রায় দুই হাজার।
চিকিৎসা: এটি একটি জন্মগত রোগ। তাই বিশ্বে এখন পর্যন্ত হিমোফিলিয়া সম্পূর্ণভাবে নিরাময়ের কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। তবে অত্যাধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এ রোগের মূল লক্ষণই হলো রক্তক্ষরণ। তাই রক্তক্ষরণ যাতে না হয় কিংবা রক্তক্ষরণ হলেই দ্রুত যাতে বন্ধ করা যায়, সেদিকেই বেশি নজর দিতে হবে। যেসব কাজকর্মে আঘাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে, তা থেকে দূরে থাকতে হবে। রক্তক্ষরণ শুরু হলে বিশ্রামে থাকা, রক্তক্ষরণের স্থলে বরফ দিয়ে চেপে রাখতে হবে। অস্থিসন্ধি স্থলে রক্তক্ষরণ হলে সে জায়গাটির নড়াচড়া বন্ধ করতে হবে অথবা ক্রেপ ব্যান্ডেজ ব্যবহার করা যেতে পারে। যেসব ওষুধ রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি করতে পারে, সেগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অ্যাসপিরিন ও মাংসপেশিতে ইনজেকশন নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
হিমোফিলিয়া রোগীদের হিমোফিলিয়া সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা দরকার। যদি কোনো রোগী এ রোগ ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানেন, তাহলে তার চিকিৎসা করা সহজ হয়ে যায়। হিমোফিলিয়া একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে রোগীকে সহজে সুস্থ রাখা সম্ভব।
লেখক: রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ফিজিশিয়ান, ল্যাবএইড হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা