প্রত্যাশা ডেস্ক : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে পোড়া হাসেম ফুডস কারখানা থেকে আরও ৪৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫২ জন। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা ৪৯ জনের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছি ময়নাতদন্তের জন্য।”
ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক দেবাশিষ বর্ধন বলেন, ছয় তলা কারখানা ভবনের উপরের দুই ফ্লোরে এখনও আগুন জ্বলছে। “নেভানোর কাজ এখনও চলছে। এ পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃতদেহ পেয়েছি। আমাদের সার্চ এখনও শেষ হয়নি।”
উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সেজান জুস, কোমল পানীয় ও বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তৈরির ওই কারখানায় গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে আগুন লাগার পর রাতে তিনজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। দুপুরে লাশ উদ্ধারের আগে স্বজনদের বক্তব্যের ভিত্তিতে ৪৭ জন নিখোঁজ শ্রমিকের তালিকা করেছিল রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত বলেন, “অনেক লাশ শনাক্ত করার মত অবস্থায় নেই। সেগুলো ঢাকা মেডিকেলের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য বলা হবে।”
ঢামেকের মর্গে লাশের স্তুপ, স্বজনদের আহাজারি : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় আগুনে মারা যাওয়া ৪৯টি মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) জরুরি বিভাগের মর্গে নেয়া হয়েছে। শুক্রবার মরদেহগুলো উদ্ধারের পর সেগুলো ঢামেকে আনা হয়।
শুক্রবার দুপুরের পর ঢামেক মর্গে যখন লাশগুলো আনতে থাকেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা, তখন সেখানে ছুটে যাচ্ছেন নিহতদের স্বজন ও সহকর্মীরা। পোড়া মৃতদেহগুলোর বেশিরভাগই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ আর এর আশপাশের এলাকা। পুড়ে যাওয়া লাশের উৎকট গন্ধ আর লাশের বীভৎসতা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই প্রিয়জনদের খুঁজছেন স্বজনরা।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভুলতার কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুড বেভারেজ কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করে। ২২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি আগুন। এখনো ভবনটি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ভবনের যে অংশগুলোর আগুন নিভে গেছে সেগুলো থেকে এ পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া ৫২টি মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। ১ থেকে ৪তলা থেকে লাশগুলো বের করার পর সেগুলো গুনে গুনে গাড়িতে করে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠানো হয়। মর্গের ভেতর লাশের স্তুপ হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে স্বজনদের ভিড়ও। তাদের মধ্যে কেউ বন্ধুকে, কেউ ভাইকে, কেউ বোনকে, কেউ তার সহকর্মীকে খুঁজছেন। আবার কেউ মর্গের সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।
পোড়া লাশগুলো দেখে চেনার উপায় নেই : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকা-ে নিহত অধিকাংশের দেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে, চোখে দেখে তাদের আর ‘চেনার উপায় নেই’ বলে জানিয়েছে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা জানিয়েছেন, নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মৃতদেহগুলোর নমুনা সংরক্ষণ করা হবে।
শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে এক সংবাদ বিফ্রিংয়ে তিনি বলেন, “মৃতদেহগুলো পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পরিচয় সনাক্ত করা অসম্ভব। তাই আমরা ডিএনএ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ডিএনএ পরীক্ষা করে প্রকৃত স্বজনদের হাতে মৃতদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। “যতদিন লাগে মৃতদেহগুলো মর্গেই থাকবে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত স্বজনদের কাছে মৃতদেহগুলো বুঝিয়ে দিতে।” নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের ওই কারখানায় জুস ও বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা হত। বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে সেখানে ভয়াবহ আগুন লাগে; ২৪ ঘণ্টা পরও তা পুরোপুরি নেভানো যায়নি। অগ্নিকা-ের ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই ৩ জনের মৃত্যুর কথা স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছিল। শুক্রবার দুপুরে পোড়া কারখানা থেকে বের করে আনা হয় আরও ৪৯ জনের মৃতদেহ। বিকেল ৩টার দিকে পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ৪৯টি মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়।
শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার বলেন, “মৃতদেহগুলোর সুরতহাল করবে জেলা পুলিশ এবং তারপর ময়নাতদন্ত হবে। সার্বিক পর্যবেক্ষণ করার জন্য মহানগর পুলিশ মর্গে রয়েছে।” এদিকে মর্গে একের পর এক সাজিয়ে রাখা মৃতদেহগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করতে বিকালেই কাজ শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। বিকাল ৫টার দিকে সিআইডির কর্মীরা ছবি তুলে নম্বর বসানোর প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর মনির বলেন, “চিকিৎসক ওই নম্বর ধরে মৃতদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আমাদের দেবেন। আমরা সিআইডির ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষা করব।” পরিচয় নিশ্চিত করতে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের নমুনাও নেওয়া হচ্ছে। সেজন্য মর্গের পাশে একটি কক্ষে জড়ো হওয়া স্বজনদের কাছ থেকে নাম ঠিকানা সংগ্রহ করতে দেখা যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশকে। এর আগে স্বজনদের বক্তব্যের ভিত্তিতে ৪৮ জন নিখোঁজ শ্রমিকের একটি তালিকা করে রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। অগ্নিকা-ের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম বেপারী জানান, তার নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহতের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
হাসেম ফুডসে আগুনে অর্ধশতাধিক মৃত্যু
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ