প্রত্যাশা ডেস্ক: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণ করেনি বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সংস্থাটি বলছে, আসামিদের অনুপস্থিতিতে বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা আরো বাড়িয়েছে।
মঙ্গলবার (১৮ নভম্বর) এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি এসব উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলছে, নিজেদের পছন্দের আইনজীবী ছাড়াই অনুপস্থিতিতে বিচার পরিচালনা, সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদে সীমাবদ্ধতা এবং মৃত্যুদণ্ড—সবমিলিয়ে গুরুতর মানবাধিকার প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ জানায়, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর সুসংগঠিত হামলা চালাতে উসকানি দিয়েছেন এবং ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র মানুষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া তিনটি বেআইনি হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থতা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগও ছিল।
প্রসিকিউশন ৫৪ জন সাক্ষী উপস্থাপন করে, যাদের মধ্যে ছিলেন ভুক্তভোগী, নিহতদের পরিবার ও বিশেষজ্ঞরা। হাসিনার বিরুদ্ধে অডিও রেকর্ডিংও উপস্থাপন করা হয়, যাতে তাকে লেথাল ফোর্স ব্যবহারের নির্দেশ দিতে শোনা যায়। তবে সরকার–নিযুক্ত আইনজীবীরা সাক্ষীদের জেরা করলেও প্রতিরক্ষার কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি।
এইচআরডব্লিউ বলছে, অনুপস্থিতিতে বিচার আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে। আদালতে হাজির থাকার অধিকার এবং নিজ পছন্দের আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক।
৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত জানায়, রোম স্ট্যাটিউটের সংজ্ঞা ধরে বিচার হয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রায়ে বলা হয়, সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলাভঙ্গের দায় মাঠপর্যায়ের সদস্যদের ওপর চাপালেও তার ‘নেতৃত্বের দায়’ স্বীকার করেছেন।
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনী গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে জাতিসংঘ জানায়। তাদের হিসাব অনুযায়ী, গুলিতে নিহত হয় প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ—যাদের বেশিরভাগই বিক্ষোভকারী। এই দমন–পীড়নের পরপরই পতন ঘটে হাসিনা সরকারের।
এইচআরডব্লিউ মনে করে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি হলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত মামলা ও আইসিটির অপব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। হাসিনা সরকারের সময়ও অনেক ক্ষেত্রে বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করেনি এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। যদিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত মামলার অভিযোগ এখনো রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আইন সংশোধন করে কমান্ড রেসপনসিবিলিটি ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে আন্তর্জাতিক মানে আনা হলেও ২০২৫ সালের সংশোধনে রাজনৈতিক সংগঠন ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা যুক্ত হওয়ায় নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
রায়ে আওয়ামী লীগ বিলুপ্তির বিষয়ে কিছু না বলা হলেও শেখ হাসিনা ও কামালের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। হাসিনা আরো তিনটি মামলার আসামি—দুটি গুম এবং একটি ২০১৩ সালের গণহত্যার অভিযোগে।
সংস্থাটি বলেছে, অভিযুক্তদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং ন্যায্য বিচারের সীমাবদ্ধতা তৈরি করা সংবিধানের ৪৭(৩) ও ৪৭এ অনুচ্ছেদ পুনর্বিবেচনা করা উচিত। পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডের ওপর স্থগিতাদেশ (moratorium) দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সহায়তা কার্যকর করতে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত জরুরি।
রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকার ভারতকে হাসিনা ও কামালকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানায়। এইচআরডব্লিউ বলছে, ভারতকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে এবং এমন দেশে কাউকে পাঠানো যাবে না যেখানে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নেই বা মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি রয়েছে।
এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, হাসিনা সরকারের সময়কার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকাররা ন্যায়সংগত বিচার ও ক্ষতিপূরণের অধিকার রাখেন। অভিযুক্তদের অধিকার সুরক্ষিত করাও ন্যায়বিচারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করা তার অন্যতম শর্ত।
এর আগে সোমবার (১৭ নভেম্বর) জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এসি/আপ্র/১৮/১১/২০২৫




















