ঢাকা ০৩:৩৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
আল–জাজিরার বিশ্লেষণ

হাসিনাকে যেসব কারণে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না ভারত

  • আপডেট সময় : ০৮:১০:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
  • ৩০ বার পড়া হয়েছে

ফাইল ছবি

প্রত্যাশা ডেস্ক: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। রায়ের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ফেরত দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ভারত কি তাঁকে ফেরত দেবে? এ নিয়ে আল–জাজিরার অনলাইন সংস্করণে মঙ্গলবার ১৮ নভেম্বর বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করেছেন।

ঢাকার ফুটবল মাঠে অনুশীলনের মাঝখানে খবরটি শুনে থমকে গিয়েছিলেন শিমা আক্তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থীকে তার এক বন্ধু জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর কাছে এটি ছিল ন্যায়বিচারের এক মুহূর্ত। গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর দমনপীড়নে শিমার কয়েকজন বন্ধু নিহত হন। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে আন্দোলন দমনে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে।

শিমার কথায়, ফ্যাসিবাদী হাসিনা ভাবত, তাকে হারানো যাবে না। মৃত্যুদণ্ড আমাদের শহীদদের ন্যায়বিচারের পথে একটি ধাপ। তবে এই শিক্ষার্থীর দাবি, কেবল রায়ই যথেষ্ট নয়। আমরা তাকে ঢাকায় ফাঁসিতে ঝুলতে দেখতে চাই!

কিন্তু শেখ হাসিনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোটা সহজ হবে না। কারণ গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা রাজধানী ঢাকা ছাড়েন ও ভারতে পালিয়ে যান। এখনো তিনি নয়াদিল্লিতেই নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন।

গত ১৫ মাস ধরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রধান অস্বস্তির জায়গা হয়ে আছে হাসিনার এই উপস্থিতি। মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ভারতীয় বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, ভারতের পক্ষে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর পরিস্থিতি মোটেও তৈরি হয়নি।

সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, নয়াদিল্লি কীভাবে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে?

‘ভারতের অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ’

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০১ সালে পরাজয়ের পর ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে টানা ১৫ বছর শাসন করেন তিনি। এ সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও বিরোধীদের গ্রেফতারের অভিযোগ ছিল প্রায় নিয়মিত।

অর্থনৈতিক সফলতার গল্প তুলে তিনি কঠোর শাসনব্যবস্থাকে সঠিক দেখানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর কঠোর দমন-পীড়নের পর রাজপথে তৈরি হয় দেশব্যাপী বিদ্রোহ। জাতিসংঘের হিসেবে, ওই সহিংসতায় প্রায় ১,৪০০ মানুষ প্রাণ হারায়।

এরপর ৫ আগস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ও বিদ্যমান উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও ভারতের প্রতি কঠোর অবস্থান নেন।

ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) ভারতের প্রতি কড়া বার্তা দেয়। তারা বলে, দুই দেশের মধ্যে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়ো ভারতের ‘বাধ্যতামূলক দায়িত্ব’। না দিলে তা হবে অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ ও ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞা।

তবে ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দেন যে চুক্তিতে ‘রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধে’ ব্যতিক্রমের বিধান রয়েছে।

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরতদ্বাজ বলেন, ভারতের চোখে হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলা ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’। নয়াদিল্লি মনে করে, বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রয়েছে ‘ভারতবিরোধী শক্তি’।

ভরতদ্বাজ মনে করেন, এই সরকার প্রায়ই ভারতের সমালোচনা করে। আবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতা ও অংশগ্রহণকারীরাও শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারতকে দায়ী করেন। এসব দিক বিবেচনায় নিলে হাসিনাকে হস্তান্তর করার মানে হবে ‘ভারতবিরোধী শক্তিকে’ বৈধতা দেওয়া।

ভারতকে তার সমীকরণ বদলাতে হবে

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা রায়ে নজরে রেখেছে ও সকল পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করবে। দেশটি বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে।

কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক এখন বেশ শীতল। হাসিনার শাসনামলে যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে তা অবিশ্বাসে ভরপুর। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, এই অবস্থা শিগগিরই বদলাবে না।

তবে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দুই দেশের জন্য নতুন সুযোগ আনতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, নির্বাচিত সরকারকে নিয়েই কাজ করা ভারতের জন্য সহজ হবে, যদিও বর্তমানে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সমালোচক।

অন্যদিকে, ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তের মতে, ভারত এখন এক ধরনের সংকটে পড়লেও বাংলাদেশে হাসিনার বিরুদ্ধে জনরোষকে অস্বীকার করতে পারছে না। তিনি বলেন, আদর্শ অবস্থায় ভারত চায়, ভবিষ্যতের কোনো সময়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের জনগণ হাসিনাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না।

শ্রীরাধা দত্তের মতে, এখন ভারতের উচিত ঢাকার অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া। ভারতের কখনোই তাদের সঙ্গে সমীকরণ ভালো ছিল না। কিন্তু এখন তা বদলানো জরুরি।

হাসিনাকে ধরে রাখার সম্ভাব্য লাভ

৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত ও ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। চীনের পর ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।

রাজনৈতিক বাস্তবতায় দিল্লির ঘনিষ্ঠতা বরাবরই বেশি ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ১৯৭১ সাল থেকেই হাসিনার পরিবার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জার্মানিতে থাকায় হাসিনা ও রেহানা বেঁচে যান। তারপরে তারা আশ্রয় নেন দিল্লিতে। সেসময় হাসিনা অল ইন্ডিয়া রেডিওর বাংলা বিভাগে কাজও করেন।

২০০৯ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার মতে, এবার হাসিনাকে ভারত আমন্ত্রণ জানায়নি; বরং তিনি পালিয়ে আসায় একজন ‘কার্যরত’ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে ভারত।

পিনাক চক্রবর্তী আল-জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশের এই সরকারের অধীনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে যাবে। কারণ, তারা বারবার বলতে থাকবে, ভারত শেখ হাসিনাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছে না।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, এখন যখন তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, তিনি কি এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারেন? এক্ষেত্রে ভারতকে ‘নৈতিক অবস্থান’ নেওয়া উচিত বলেই মনে করেন পিনাক রঞ্জন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, হাসিনার উপস্থিতি দুই দেশের সম্পর্কে ‘কাঁটা’ হয়ে থাকবে, কিন্তু ভারতের কাছে এটি বন্ধুত্ব রক্ষার অঙ্গীকারও বটে। তার মতে, দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বংশীয় দলগুলো কখনো পুরোপুরি বিলীন হয় না। দীর্ঘমেয়াদে আবারও ফিরে আসার সম্ভাবনা সবসময় থাকে।

তার ভাষায়, যদি আপনি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন, তাহলে আবারও বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে ও এমন পদক্ষেপ নয়াদিল্লির জন্য দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সুবিধাও নিয়ে আসতে পারে।

সূত্র: আল-জাজিরা

ওআ/আপ্র/১৮/১১/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

আল–জাজিরার বিশ্লেষণ

হাসিনাকে যেসব কারণে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না ভারত

আপডেট সময় : ০৮:১০:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। রায়ের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ফেরত দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ভারত কি তাঁকে ফেরত দেবে? এ নিয়ে আল–জাজিরার অনলাইন সংস্করণে মঙ্গলবার ১৮ নভেম্বর বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করেছেন।

ঢাকার ফুটবল মাঠে অনুশীলনের মাঝখানে খবরটি শুনে থমকে গিয়েছিলেন শিমা আক্তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থীকে তার এক বন্ধু জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর কাছে এটি ছিল ন্যায়বিচারের এক মুহূর্ত। গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর দমনপীড়নে শিমার কয়েকজন বন্ধু নিহত হন। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে আন্দোলন দমনে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে।

শিমার কথায়, ফ্যাসিবাদী হাসিনা ভাবত, তাকে হারানো যাবে না। মৃত্যুদণ্ড আমাদের শহীদদের ন্যায়বিচারের পথে একটি ধাপ। তবে এই শিক্ষার্থীর দাবি, কেবল রায়ই যথেষ্ট নয়। আমরা তাকে ঢাকায় ফাঁসিতে ঝুলতে দেখতে চাই!

কিন্তু শেখ হাসিনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোটা সহজ হবে না। কারণ গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা রাজধানী ঢাকা ছাড়েন ও ভারতে পালিয়ে যান। এখনো তিনি নয়াদিল্লিতেই নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন।

গত ১৫ মাস ধরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রধান অস্বস্তির জায়গা হয়ে আছে হাসিনার এই উপস্থিতি। মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ভারতীয় বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, ভারতের পক্ষে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর পরিস্থিতি মোটেও তৈরি হয়নি।

সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, নয়াদিল্লি কীভাবে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে?

‘ভারতের অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ’

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০১ সালে পরাজয়ের পর ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে টানা ১৫ বছর শাসন করেন তিনি। এ সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও বিরোধীদের গ্রেফতারের অভিযোগ ছিল প্রায় নিয়মিত।

অর্থনৈতিক সফলতার গল্প তুলে তিনি কঠোর শাসনব্যবস্থাকে সঠিক দেখানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর কঠোর দমন-পীড়নের পর রাজপথে তৈরি হয় দেশব্যাপী বিদ্রোহ। জাতিসংঘের হিসেবে, ওই সহিংসতায় প্রায় ১,৪০০ মানুষ প্রাণ হারায়।

এরপর ৫ আগস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ও বিদ্যমান উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও ভারতের প্রতি কঠোর অবস্থান নেন।

ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) ভারতের প্রতি কড়া বার্তা দেয়। তারা বলে, দুই দেশের মধ্যে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়ো ভারতের ‘বাধ্যতামূলক দায়িত্ব’। না দিলে তা হবে অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ ও ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞা।

তবে ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দেন যে চুক্তিতে ‘রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধে’ ব্যতিক্রমের বিধান রয়েছে।

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরতদ্বাজ বলেন, ভারতের চোখে হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলা ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’। নয়াদিল্লি মনে করে, বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রয়েছে ‘ভারতবিরোধী শক্তি’।

ভরতদ্বাজ মনে করেন, এই সরকার প্রায়ই ভারতের সমালোচনা করে। আবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতা ও অংশগ্রহণকারীরাও শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারতকে দায়ী করেন। এসব দিক বিবেচনায় নিলে হাসিনাকে হস্তান্তর করার মানে হবে ‘ভারতবিরোধী শক্তিকে’ বৈধতা দেওয়া।

ভারতকে তার সমীকরণ বদলাতে হবে

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা রায়ে নজরে রেখেছে ও সকল পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করবে। দেশটি বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে।

কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক এখন বেশ শীতল। হাসিনার শাসনামলে যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে তা অবিশ্বাসে ভরপুর। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, এই অবস্থা শিগগিরই বদলাবে না।

তবে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দুই দেশের জন্য নতুন সুযোগ আনতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, নির্বাচিত সরকারকে নিয়েই কাজ করা ভারতের জন্য সহজ হবে, যদিও বর্তমানে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সমালোচক।

অন্যদিকে, ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তের মতে, ভারত এখন এক ধরনের সংকটে পড়লেও বাংলাদেশে হাসিনার বিরুদ্ধে জনরোষকে অস্বীকার করতে পারছে না। তিনি বলেন, আদর্শ অবস্থায় ভারত চায়, ভবিষ্যতের কোনো সময়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের জনগণ হাসিনাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না।

শ্রীরাধা দত্তের মতে, এখন ভারতের উচিত ঢাকার অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া। ভারতের কখনোই তাদের সঙ্গে সমীকরণ ভালো ছিল না। কিন্তু এখন তা বদলানো জরুরি।

হাসিনাকে ধরে রাখার সম্ভাব্য লাভ

৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত ও ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। চীনের পর ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।

রাজনৈতিক বাস্তবতায় দিল্লির ঘনিষ্ঠতা বরাবরই বেশি ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ১৯৭১ সাল থেকেই হাসিনার পরিবার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জার্মানিতে থাকায় হাসিনা ও রেহানা বেঁচে যান। তারপরে তারা আশ্রয় নেন দিল্লিতে। সেসময় হাসিনা অল ইন্ডিয়া রেডিওর বাংলা বিভাগে কাজও করেন।

২০০৯ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার মতে, এবার হাসিনাকে ভারত আমন্ত্রণ জানায়নি; বরং তিনি পালিয়ে আসায় একজন ‘কার্যরত’ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে ভারত।

পিনাক চক্রবর্তী আল-জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশের এই সরকারের অধীনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে যাবে। কারণ, তারা বারবার বলতে থাকবে, ভারত শেখ হাসিনাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছে না।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, এখন যখন তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, তিনি কি এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারেন? এক্ষেত্রে ভারতকে ‘নৈতিক অবস্থান’ নেওয়া উচিত বলেই মনে করেন পিনাক রঞ্জন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, হাসিনার উপস্থিতি দুই দেশের সম্পর্কে ‘কাঁটা’ হয়ে থাকবে, কিন্তু ভারতের কাছে এটি বন্ধুত্ব রক্ষার অঙ্গীকারও বটে। তার মতে, দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বংশীয় দলগুলো কখনো পুরোপুরি বিলীন হয় না। দীর্ঘমেয়াদে আবারও ফিরে আসার সম্ভাবনা সবসময় থাকে।

তার ভাষায়, যদি আপনি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন, তাহলে আবারও বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে ও এমন পদক্ষেপ নয়াদিল্লির জন্য দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সুবিধাও নিয়ে আসতে পারে।

সূত্র: আল-জাজিরা

ওআ/আপ্র/১৮/১১/২০২৫