মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম : আজকের লেখাটি আমি দুটি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। প্রথম গল্পটি আমার এক সাবেক শিক্ষার্থীকে নিয়ে। আমি তখন সবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণা পদ্ধতি বিষয়ে একটি কোর্স পড়াতে শুরু করেছি। তো একদিন সেই শিক্ষার্থী আমার কাছে হাজির। জীবনের দুটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমার পরামর্শ চায়। প্রথমত, আদতে সে যোগাযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়া শেষ করবে কিনা; দ্বিতীয়ত, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাকে একটি গবেষণা করতে হবে। আর সেই গবেষণাটি সে কীভাবে করবে তা বুঝতে পারছে না। তাই গবেষণা না করে কেবল কোর্সওয়ার্ক করেই ডিগ্রি নেবে কিনা?
গবেষণা করলে যোগাযোগ ও স্থাপত্যকে সন্নিবেশিত করে গবেষণার বিষয়বস্তু কীভাবে ঠিক করবে? তার সঙ্গে আলোচনায় আমি জানতে পারি যে সে স্নাতক পর্যায়ে পড়েছে স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে। কিন্তু স্নাতকোত্তর করতে চেয়েছে যোগাযোগবিদ্যায়। মানে আমার বিভাগে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি যে কোনোভাবেই যোগাযোগ ও স্থাপত্যের সম্পর্কের জায়গাটি বুঝে উঠতে পারছে না। বিদ্যা জগতের দুটি বিষয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে একরকম আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে বলে সে জানায়। আমি তাকে বলি স্থাপত্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পেলে আমি তাকে সাহায্য করতে পারি। যাহোক, এরপর সেই শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমার অনেক আলাপ-আলোচনা হয়। যুক্তি, তর্ক হয়। গবেষণাও করে সে। তবে গবেষণার বিষয় হিসেবে স্থাপত্য ও স্বাস্থ্যকে সে নেয়নি। তবে স্থাপত্য, হাসপাতাল ও যোগাযোগ নিয়ে বিদ্যায়তনিক আলোচনা ও গবেষণার প্রশ্নে আমার মাঝে চিন্তাবীজ বপন করে দিয়ে গেছে সে।
দ্বিতীয় গল্পটি বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও স্থপতি শ্রদ্ধেয় এনমুল করিম নির্ঝর ভাইকে নিয়ে। তিনি এক গভীর মুছিবত থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। শুধু উদ্ধারই করেননি, যাপিত জীবন, বোধ, দর্শন, কর্ম ও জগতে মানুষ হিসেবে দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে আমার উপলব্ধিতে নতুন এক মাত্রা দিয়েছেন। তো মুছিবতের গল্পটি বলি। আমার সম্প্রতি প্রকাশিত ‘চলচ্চিত্র, মনোরোগ ও যোগাযোগ বৈকল্য’ শীর্ষক একটি বইয়ের খসড়া প্রকাশককে দিয়েছিলাম বেশ উৎসাহের সঙ্গে। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রকাশক জানান বইটি তারা প্রকাশ করবেন। তবে শর্ত হলো যোগাযোগ বিদ্যা, চলচ্চিত্র, মনোরোগ কিংবা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানে বিখ্যাত কারও মুখবন্ধ যুক্ত করতে হবে। আমার সহকর্মী ও শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজনকে অনুরোধ করি মুখবন্ধ লেখার জন্য। তারা অপারগতা জানান। এই এক বড়ই বিপদ আমার জন্য। বিভিন্নজনকে নানাভাবে অনুরোধ করি। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে ফেসবুকে নির্ঝর ভাইকে নক করি। তিনি সাড়া দেন। পুরো বইটি পাঠাতে বলেন। আমি পাঠিয়েও দেই। বেশ কয়েক দিন পর বইটির খসড়া পড়ে তিনি জানান, ‘আমি স্থাপত্যের মানুষ। ইট, কাঠ ও পাথরের মানুষ। কিছুটা চলচ্চিত্র করার চেষ্টা করি। যোগাযোগ ও চলচ্চিত্র নিয়ে বইয়ের মুখবন্ধ লিখার জন্য আমাকে কেন নির্বাচন করলেন? আপনার বইয়ের মুখবন্ধ আমি লিখবো। তবে আপনার যোগাযোগ বিদ্যা ও আমার স্থাপত্যের পারস্পরিক সম্পর্কটি আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’
আমি রাজি হই। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ওই সাক্ষাতে তিনি কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেন। কিছু বিষয়ে আমরা একমত হই। কিছুতে দ্বিমত। তবে একমতের সবচেয়ে বড় জায়গাটি ছিল স্থাপত্য ও যোগাযোগ নিয়ে আমরা কিছু কাজ একসঙ্গে করবো। সেই কাজের মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো। আমি যেহেতু যোগাযোগ ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, কাজেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হবে স্বাস্থ্য ও হাসপাতালের নিরিখেই।
যাহোক, আমাদের প্রশ্নগুলো ছিল ঠিক এ রকমÑ স্থাপত্য কীভাবে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে? বিভিন্ন ধরনের বার্তা বিচ্ছুরিত করে? হাসপাতালের নকশা ও উপকরণ রোগীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলে? নির্দিষ্ট কোন স্থাপত্য উপাদানগুলো হাসপাতালে রোগীর আরোগ্য লাভে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে?
আজকের লেখাটি এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। বলা যেতে পারে এই লেখাটি এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রাথমিক প্রচেষ্টা মাত্র।
প্রথমেই আসা যাক রোগীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রশ্নে হাসপাতালের নকশা ও উপকরণের প্রভাবে প্রশ্নে। সুনির্দিষ্ট গবেষণা ছাড়া প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে গবেষণা আমার তেমন একটা চোখেও পড়েনি। কাজেই এই লেখার সব তথ্য প্রমাণ আমি হাজির করবো বিভিন্ন দেশের গবেষণার নিরিখেই।
যাহোক, হাসপাতালে রোগীর মানসিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং মানসিক রোগের চিকিৎসায় সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে প্রাকৃতিক আলো, মুক্ত মেঝে পরিকল্পনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরের জন্য খোলামেলা স্থান, অন্দর সজ্জায় শিল্পকর্মের ব্যবহার, নিরাপত্তা পদ্ধতি, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে। হাসপাতালের নকশায় বায়োফিলিক ডিজাইন দৃষ্টিভঙ্গি তথা প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে সন্নিবেশিত করা হলে রোগীর শারীরিক ও মানসিক আরোগ্য তুলনামূলক দ্রুত হয়। এই বায়োফিলিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস প্রবাহের সুযোগ; বিছানা ও জানালায় প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার; ঘরের ভেতর পাত্রে কিংবা ঝোলানো গাছপালা রাখা; মেঝেতে ঘাসযুক্ত সবুজ প্যাঁচসহ অমসৃণ প্যাটার্নযুক্ত কারপেট ব্যবহার করা; প্রকৃতির আদলে দেয়ালে অমসৃণ কাঠের ব্যবহার করা; এবং লম্বা সবুজ দেয়াল এবং এসব দেয়ালে লম্বা লম্বা তৃণ ও গাছ স্থাপন করা।
অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা এমন হাসপাতাল পরিবেশ পছন্দ করে, যেখানে খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ আছে। একই সঙ্গে আলো, রঙিন সাজসজ্জা, সবুজ স্থান এবং তাদের পরিবারের উপস্থিতির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আছে। অপর গবেষণায় দেখা যায়, তিনটি ভৌত পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য রোগীর দেহ ও মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর সেই বৈশিষ্ট্য তিনটি হলো প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ, উপযুক্ত আলো ও শব্দ নিয়ন্ত্রণ। অন্যদিকে রঙের ডিজাইনও মানুষের মনোভাবের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। আর তাই হাসপাতালের স্থাপত্যের নকশা ও রঙের ব্যবহার এমনভাবে করা উচিত; যার সংস্পর্শে এলে রোগীদের উদ্বেগ, ব্যথা ও মানসিক চাপের মাত্রা কমে যায়।
এক গবেষণায় গবেষকগণ হাসপাতালে ভর্তি অনেক রোগীকে তাদের ঘরের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখার সুযোগ করে দেন। আর আরেক দল রোগীকে কেবল বৈশিষ্ট্যহীন ইটের দেয়াল দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, যেসব রোগী জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখতে পেরেছেন তারা তুলনামূলক দ্রুত আরোগ্য লাভ করেছেন। তাদের হাসপাতালে তুলনামূলক কম সময় ভর্তি থাকতে হয়েছে এবং তুলনামূলক কম সংখ্যক ও পরিমাণে ওষুধ খেতে হয়েছে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালের জানালা ও বাইরের দৃশ্য দেখার সুযোগ অপারেশনের পর দ্রুত আরোগ্য লাভে ভূমিকা রাখে। গবেষণা বলছে, হাসপাতালের জানালা দিয়ে শহরের দৃশ্য দেখার তুলনায় প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সঙ্গে শান্তি, আরাম ও উপভোগে সম্পর্ক আছে। অন্য এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, হাসপাতালে বায়ুর গুণগত মান, রঙের ব্যবহার, টেক্সচার, আলো ও শব্দ চলাচল ইত্যাদি হাসপাতালে একটি আরোগ্যকারী আবহ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে হাসপাতালের বিছানা ও আশপাশের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা; দৃশ্যমানতা, সহজে বাথরুমে যাওয়ার সুবিধা কিংবা বাথরুমের সজ্জাবিন্যাস এবং ঘরে দিনের আলো প্রবেশের সুযোগ কিংবা ঘরের বাইরের দৃশ্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া পরিবেশগত বিভিন্ন সূচক রোগীর আরোগ্য লাভকে প্রভাবিত করে। এসব সূচকের মধ্য রয়েছে ঘরের আকার ও আঙ্গিক, চিকিৎসার বিভিন্ন বিভাগের বিন্যাস, মেঝেতে ব্যবহৃত উপকরণ, ঘর-সজ্জায় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ, চিকিৎসা যন্ত্রপাতির দৃশ্যমানতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, আলোর ব্যবহার ও উপস্থিতি ও সংগীত।
অন্য এক গবেষণা বলছে, হাসপাতালে রোগীদের কক্ষে অন্দর গাছপালা বা কৃত্রিমভাবে প্রকৃতির ডিজিটাল উপস্থাপনার তুলনায় জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানসহ একটি শহুরে ল্যান্ডস্কেপের ভিউ রোগীকে দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়তা করে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে শীতল রঙ কিংবা সাদা রঙের দেয়ালবেষ্টিত ঘরের থাকা রোগীদের তুলনায় উষ্ণ রঙের দেয়ালবেষ্টিত ঘরে থাকা রোগীরা দ্রুত আরোগ্য লাভ করেছেন। আরেক দল গবেষক দেখতে পেয়েছেন, রোগী ও হাসপাতাল পেশাজীবীগণ দিনের আলো সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করতে পারে এমন কক্ষগুলো পছন্দ করে বেশি। ঘরের জানালাগুলো উলম্বের তুলনায় আনুভূমিক হলে রোগীদের পছন্দের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কেননা, এসব জানালা দিয়ে বাইরের প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা যায় বেশি। দুয়ার খোলা থাকে বা খোলা রাখা যায় এমন ঘরের চাহিদা বেশি থাকে। হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রাকৃতিক দৃশ্য, দরজার স্থান, আসবাবপত্রের বিন্যাস, ঘরের আকার ও দেয়ালের রঙ আরোগ্যকারী আবহ সৃষ্টিতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
অন্য একটি গবেষণায় রোগীর ঘরের নকশা তৈরির ক্ষেত্রে চারটি মূল উপাদান চিহ্নিত করেছে। আর সেই উপাদানগুলো হলো, ঘরের আকার-আকৃতি, চার্টিং লোকেশন, পিপিই সাপ্লাই ও মোবাইল সাপ্লাই কার্ট। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্থাপত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য হাসপাতালে বয়স্ক রোগীদের অভিজ্ঞতাকে তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় প্রভাবিত করে। স্থাপত্যের এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে মজবুত বিছানা, আসবাবপত্রের পরিমাণ, আলোর ব্যবস্থা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার নৈকট্য এবং কতটুকু এলাকাজুড়ে ওয়ার্ড আছে তার মাত্রা। অন্য একটি গবেষণায় রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর হাসপাতালের অন্দর সজ্জার প্রভাবের কথা বলা হয়েছে।
এই অন্দর সজ্জা হাসপাতালে রোগীর আরোগ্যের প্রশ্নে এক ধরনের ইতিবাচক আবহ সৃষ্টি করে। কাজেই হাসপাতালের অন্দর সজ্জার প্রশ্নে অবশ্যই রোগীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক দিকের নজর অত্যন্ত জরুরি। হাসপাতাল স্থাপত্যের এসব নকশা রোগীর সেবা, মানসিক ও চিকিৎসা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
এখন পর্যন্ত আমাদের আলোচনায় একটি বিষয় সুস্পষ্ট। আর তা হলো হাসপাতালের স্থাপত্য আরোগ্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। হাসপাতালের নকশা, নির্মাণ কৌশল, ভবনের বিভিন্ন পরিসর এবং নির্মাণে বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার শারীরিক ও মানসিকভাবে কল্যাণকর একটি আবহ তৈরি করে। তবে প্রশ্ন হলো, কীভাবে করা উচিত সেই হাসপাতাল নির্মাণ? এই প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই বলা উচিত, আমাদের মনে রাখতে হবে হাসপাতালের স্থাপত্য কৌশল অন্যান্য ভবনের তুলনায় একটু জটিল। কেননা নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণে বিপুল সংখ্যক শর্ত পূরণ করতে হয়। মেনে চলতে হয় নানান নীতিমালা ও মানদণ্ড। তবে নীতিমালা ও মানদণ্ড যাহোক না কেন মূল লক্ষ্যটি হওয়া উচিত হাসপাতালে এমনটি পরিসর নিশ্চিত করা যেখানে রোগীর ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সন্তুষ্টি নিশ্চিতে দরকারি সবকিছু থাকবে এবং তা হবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর।
হাসপাতালে কেবল রোগীকে আরোগ্য দিয়েই চলবে না; বরং তার সামগ্রিক অভিজ্ঞতাটি হতে হবে স্বস্তিদায়ক। এছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার-নার্স, ব্যবস্থাপক, প্রশাসক ও রোগীর আত্মীয়-স্বজন ও দর্শনার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার ইতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। কাজেই হাসপাতাল নির্মাণ ও নকশায় যেসব বিষয়ের প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তা হলো প্রাকৃতিক আলোর প্রবাহ বৃদ্ধি, শব্দনিয়ন্ত্রণ, প্রকৃতির সংস্পর্শ ও ছোঁয়া, বায়ুর গুণগত মান ও সামাজিক সহায়তা সুবিধা। প্রাকৃতিক আলোর প্রবাহ বাড়ানোর প্রশ্নে জরুরি হলো জানালার আকার ও স্থান নির্বাচন; দেয়ালে আলো প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা ও সূর্যের আলো প্রবেশের সুযোগ; এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো প্রবেশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
অন্যদিকে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দরকার নির্মাণ ও অন্দর সজ্জায় শব্দ শোষণ করতে পারে এমন উপকরণ ব্যবহার এবং বাহ্যিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ কমাতে পারে এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার। আর প্রকৃতির সন্নিবেশ নিশ্চিত করার প্রশ্নে হাসপাতালের চারদিকে গাছপালা ও সবুজ মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। জানালা দিয়ে সেই সবুজ প্রকৃতি দেখার সুযোগ থাকতে হবে। প্রয়োজনে অন্দরে টিকে থাকে এমন গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বায়ুর গুণগত মান নিশ্চিতে উন্নত বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রাকৃতিক বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। অভ্যন্তরে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর সামাজিক সহায়তা নিশ্চিতে পরিবারের লোকজন যাতে রোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে, প্রয়োজনে তারা বসতে পারে, থাকতে পারে, আরাম করতে পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোনও রোগীর আত্মীয়স্বজন ও দর্শনার্থী যাতে অন্য রোগীর স্বজনদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ করতে পারে সেই সুযোগও থাকতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুযোগও। এসব বিষয় মাথায় রেখে হাসপাতালের নকশা ও নির্মাণ করলে সুফল হবে দ্বিমাত্রিক।
প্রথমত, স্বাস্থ্য সুফল এবং দ্বিতীয়ত হাসপাতাল পরিচলনগত সুফল। স্বাস্থ্যগত সুফলের মধ্যে রয়েছে রোগীর ব্যথা ও যন্ত্রণা কমানোর জন্য ওষুধের চাহিদার মাত্রা কমা, রোগীর ঘুমের গুণগত মান উন্নত হওয়া, তাদের দুশ্চিন্তার মাত্রা কমা, হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সময় কমা এবং সামগ্রিকভাবে রোগীর সন্তুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি। অন্যদিকে পরিচলনগত সুফলগুলো হলো হাসপাতালের কর্মপ্রবাহ ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভুলের মাত্রা কমা এবং কর্মীদের চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা কমা।
আমাদের মনে রাখাতে হবে, হাসপাতাল কেবল রোগের আরোগ্যের জায়গা নয়। বরং এটির রোগীর চিকিৎসারও জায়গা। কাজেই হাসপাতাল ভবন নির্মাণে স্থাপত্য, চিকিৎসাবিদ্যা, যোগাযোগ ও জনস্বাস্থ্য বিদ্যার বিশেষজ্ঞ লোকজনের সমন্বয়ে পরিকল্পনা করা উচিত। আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো জনসম্পৃক্ত করতে যোগাযোগ বিদ্যার দৃষ্টিকোণ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর রঙ ও স্থাপত্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই ভাবনায় অবশ্যই চিকিৎসা যোগাযোগ ও জনস্বাস্থ্য বিদ্যাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)