শাহ আলম ডাকুয়া
বরিশাল জেলার উত্তরের প্রাচীন জনপদের নাম উজিরপুর। একসময় উজিরপুর থানা সদর থাকলেও এখন এটি উপজেলা। এ উপজেলাটি বরিশাল বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে সন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় একসময় সম্ভ্রান্ত পরিবারে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল কাচারিঘর। বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই কাচারিঘর। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও মক্তব হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক আলাপচারিতারও কেন্দ্র ছিল এই কাচারিঘর। কাচারিঘরের ব্যবহারে ছিল এরকম নানা বৈচিত্র্য। পাড়ামহল্লার ছোট ছেলেমেয়েদের মক্তবের আলেম ও মসজিদের ইমাম সাহেবদের থাকার একটি উপযুক্ত স্থান ছিল কাচারিঘর।
উজিরপুরের বিভিন্ন বাড়িতেই দেখা যেত উপরে টিন বা ছনের ছাউনি দিয়ে ঘেরা মূল বাড়ির বাইরে এই ঘরটি। বাইরের লোকজন যেন অন্দরমহলের নারীদের দেখতে না পান, সে জন্যই বাহির বাড়িতে স্থাপিত হতো এই কাচারিঘর।
কালের বিবর্তনে বাঙালি সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গের মতো হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাচারিঘর। নব্বই দশকে ও এর ২০০ বছর আগে থেকে উজিরপুরের প্রায় সচ্ছল ও বনেদি পরিবারের বাড়িতে ছিল কাচারিঘর। এটি ২০২৫ সালে এসে তেমনটি দেখা যায় না।
৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত উজিরপুর উপজেলা। এ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল কাচারিঘর।
উজিরপুর এলাকার বাসিন্দা ও বর্তমানে নিইউ ইয়র্ক প্রবাসী লেখক-কবি এসএম মোজাম্মেল হক বলেন, চারদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় গ্রাম বাংলার কাচারিঘর এখন বিলুপ্ত প্রায়। পূর্বপুরুষরা কাছারিঘরে সালিশ-বৈঠক, গল্প-আড্ডা, পথচারী ও মুসাফিরদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এখন গ্রামের লোকসংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি শহরের মতো আধুনিক নকশার বাড়িঘর তৈরি হওয়ায় প্রয়োজন ফুরিয়েছে কাচারিঘরের।
উজিরপুরের ক্রীড়াব্যক্তিত্ব আব্বাস আলী তালুকদার বলেন, তাদের গ্রামের ডাকুয়া বাড়ি, তালুকদার বাড়ি, মোল্লাবাড়ি, হাওলাদার বাড়িতে তিনি কাচারিঘর দেখেছেন। তবে বর্তমানে সেগুলো হারিয়ে গেছে।
লেখক-গবেষক মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, উজিরপুরের মানুষের কাচারিঘরের সাথে ছিল ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পর্ক। গ্রামে কোনো কমিউনিটি সেন্টার না থাকায় আগে ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি হতো এ কাচারিঘরে বসেই। যা এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
অধ্যাপক ও লেখক-কবি মাহবুব রহমান বলেন, ‘‘আজ থেকে (২০২৫ সাল) ৫০ বছর আগে উজিরপুরের গ্রামে ছোটদের তেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। শিশুদের পাঠশালা, মক্তবের কাজটি চলতো এই কাচারিঘরেই। অনেক এনজিও তাদের শিক্ষাকার্যক্রম চালাতো কাচারিঘরে। বাড়িতে মেহমান আসলে রাত্রিযাপন ও সালিশবৈঠকও হতো কাচারিঘরে।
উজিরপুরের কাচারিঘর ছিল গ্রামবাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটি অংশ। কালের বিবর্তনে আজ (২০২৫ সালের জানুয়ারি) কাচারিঘর বাঙালির সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গেস্টরুম কিংবা ড্রয়িং রুমের আদি ভার্সন কাচারিঘর এখন আর গ্রামীণ জনপদে দেখা যায় না।
উজিরপুরের সন্তান সিনিয়র সাংবাদিক ও যুগবার্তাডটকমের সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘কাচারিঘর মূল বাড়ির একটু বাইরে/সামনে আলাদা খোলামেলা ঘর। অতিথি, পথচারী কিংবা সাক্ষাৎ প্রার্থীরা এই ঘরে এসেই বসতেন। প্রয়োজনে দু-এক দিন রাতযাপনেরও ব্যবস্থা থাকত কাচারিঘরে। কাচারিঘর ছিল বাংলার অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের আভিজাত্যের প্রতীক। কাঠের কারুকাজ করা টিন অথবা ছনের ছাউনি থাকত কাচারিঘরে। আলোচনা, শালিস বৈঠক, গল্প-আড্ডার আসর বসত কাচারিঘরে। বর্ষা মৌসুমে গ্রামের লোকজনদের উপস্থিতিতে কাচারিঘরে বসত পুঁথিপাঠ। পথচারীরা এই কাচারিঘরে ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিতেন।’
তিতাস গ্যাস কোম্পানির সাবেক ডিজিএম ও উজিরপুরের বিশিষ্ট সমাজসেবক শহিদুল হক ডাকুয়া বলেন, ‘বিপদে পড়লে রাতযাপনের ব্যবস্থা থাকত কাচারিঘরে। গৃহস্থের বাড়ির ভেতর থেকে খাবার পাঠানো হতো কাচারিঘরের অতিথির জন্য। আবাসিক গৃহশিক্ষকের (লজিং মাস্টার) থাকার ব্যবস্থা থাকত কাচারিঘরেই। কোনো কোনো বাড়ির কাচারিঘর সকাল বেলা মক্তব হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।’
বিলুপ্তপ্রায় ‘বাংলো ঘর’ নামে খ্যাত ‘কাচারিঘর’। এখন সে জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ড্রয়িং রুম। বর্তমানে উজিরপুরে যে কয়টি কাচারিঘর অবশিষ্ট আছে তাও অবহেলা-অযত্নে ধ্বংস প্রায়।
সময়ের বিবর্তনে শহরের পাশাপাশি গ্রামের পরিবারগুলোও ছোট ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। তাই বিলুপ্তির পথে শতবর্ষের বাঙালি ঐতিহ্য কাচারিঘর নামে খ্যাত বাহির বাড়ির বাংলো ঘরটি।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ