ঢাকা ০৮:১৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫

হারিয়ে যাচ্ছে উজিরপুরের ঐতিহ্য ‘পুরা’

  • আপডেট সময় : ০৫:৪৫:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫
  • ২১ বার পড়া হয়েছে

 

শাহ আলম ডাকুয়া

 

‘সের’ বা ‘স্যার’ একটি হতো। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান- এ অঞ্চলে শব্দটি খুবই পরিচিত। ১ সের প্রায় ৯৩৩.১ গ্রাম (একক)-এর সমান।

দেশীয় রীতিতে ওজন পরিমাপের বা ভারের একক ‘সের’। ১ সের পরিমাণ ধান-চাল মাপার যে বস্তুটি/পাত্রটি তার নাম ‘পুরা’। যা সাধারণত বেত কিংবা বাঁশের বেতি দিয়ে তৈরি করা হতো। বানানোর পর পুরাটিকে গোবর/গাবের রস দিয়ে মুড়িয়ে শুকিয়ে নেয়া হতো। যাতে বাঁশ-বেত ঘুণে পোকায় না খায়।

পুরা যে শুধু এক সের পরিমাণ চাল ধরে সেই মাপের ছিল তা নয়। অনেকে ২ সের, ৫ সেরের পুরাও বানিয়ে নিতো মাপার সুবিধার্থে।

বর্তমানে শহর কিংবা গ্রামে টিনের বা স্টিলের পট ব্যবহার করে চাল মেপে রান্না করতে নেয়া হয়। আমরা পুরা বলতে এক প্রকারের পট বুঝি যা দিয়ে ১ সের পরিমাণ চাল মাপা হয়। দেশীয় রীতিতে আরো পরিমাপের একক আছে- তোলা, পোয়া, ছটাক, পাহাড়ি/ধরা মণ, কাডি ইত্যাদি।

উজিরপুরের কথ্যভাষার এই ‘পুরা’ (১ সেরের পট) দিয়ে শস্য-পণ্য মাপার কাজ করা হতো। বিশেষ করে চাল মাপার কাজে সেরের গ্রহণযোগ্যতা ছিল একক ও আকাশচুম্বী। সের হারিয়ে যাওয়াও পুরা নামক চাল মাপার বাঁশ-বেতের পটটি এমনকি পুরা নামটিই হারিয়ে গেছে।

১৯৮২ সালের পহেলা জুলাইয়ের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সময়ে বহুলভাবেই প্রচলিত ছিল। আর ১৯৮২ সালের পহেলা জুলাইয়ে আমাদের দেশে ম্যাট্রিক পদ্ধতি চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে এই দেশীয় রীতির পরিমাপ পদ্ধতিটির বিলুপ্তি শুরু হয়। আশির দশকে রেডিও খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখন দীর্ঘদিন ধরেই রেডিওতে একটি ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘১ জুলাই থেকে মেট্রিক পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে, তাই আর বাংলা পদ্ধতিতে পরিমাপ চলবে না এখন মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সেরের পরিবর্তে কেজি… ইত্যাদি।’

এ সময় থেকে ব্যাপকভাবে উজিরপুরের গ্রাম থেকে পুরা দিয়ে ধান-চাল মাপার পদ্ধতিটিও উঠে যেতে শুরু করে। এখন গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে কেজি চলে আসছে। এমনকি বাড়িতে বাড়িতেও কেজির মাপের জন্য ইলেকট্রিক ওজন পরিমাপক, দাড়িপাল্লা চলে এসেছে। আর কমে গেছে পুরার ব্যবহার।

পুরার সাথে সাথে গ্রাম থেকে উঠে গেছে বউড্ডা দিয়ে ধান মাপার পদ্ধতিটিও। তখন একটি বউড্ডায় যতটুকু ধান ধরতো তাকে ‘কাডি’ বলা হতো। ২০২৫ সালে এসে উজিরপুরের বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিনে কাডির অস্তিত্ব খুবই কম পাওয়া গেছে। বউডার আকৃতি ছিল বেশ বড়। বাঁশের তৈরি একটি বউডায় অঞ্চলভেদে ২০ সের, ২৫ সের ধান বা চাল মাপার মতো আকৃতি বড় করা হতো।

এক কাডি ধানের বীজ দিয়ে যতটুকু জমিতে ধান চাষ হতো তাকে বলা হতো ‘এক কাডির বাইন’। তোর ওখানে জমি কতটুকু? উত্তরে কৃষক বলতেন, ‘এক কাডির বাইন’। এক কাডির বাইন বলতে মোটামুটি ২০ শতাংশের মতো জমিকে বুঝাতো। অর্থাৎ বাঁশ-বেতের তৈরি ধান-চাল মাপার পুরা, বউড্ডা হারিয়ে যেতে বসেছে।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

হারিয়ে যাচ্ছে উজিরপুরের ঐতিহ্য ‘পুরা’

আপডেট সময় : ০৫:৪৫:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫

 

শাহ আলম ডাকুয়া

 

‘সের’ বা ‘স্যার’ একটি হতো। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান- এ অঞ্চলে শব্দটি খুবই পরিচিত। ১ সের প্রায় ৯৩৩.১ গ্রাম (একক)-এর সমান।

দেশীয় রীতিতে ওজন পরিমাপের বা ভারের একক ‘সের’। ১ সের পরিমাণ ধান-চাল মাপার যে বস্তুটি/পাত্রটি তার নাম ‘পুরা’। যা সাধারণত বেত কিংবা বাঁশের বেতি দিয়ে তৈরি করা হতো। বানানোর পর পুরাটিকে গোবর/গাবের রস দিয়ে মুড়িয়ে শুকিয়ে নেয়া হতো। যাতে বাঁশ-বেত ঘুণে পোকায় না খায়।

পুরা যে শুধু এক সের পরিমাণ চাল ধরে সেই মাপের ছিল তা নয়। অনেকে ২ সের, ৫ সেরের পুরাও বানিয়ে নিতো মাপার সুবিধার্থে।

বর্তমানে শহর কিংবা গ্রামে টিনের বা স্টিলের পট ব্যবহার করে চাল মেপে রান্না করতে নেয়া হয়। আমরা পুরা বলতে এক প্রকারের পট বুঝি যা দিয়ে ১ সের পরিমাণ চাল মাপা হয়। দেশীয় রীতিতে আরো পরিমাপের একক আছে- তোলা, পোয়া, ছটাক, পাহাড়ি/ধরা মণ, কাডি ইত্যাদি।

উজিরপুরের কথ্যভাষার এই ‘পুরা’ (১ সেরের পট) দিয়ে শস্য-পণ্য মাপার কাজ করা হতো। বিশেষ করে চাল মাপার কাজে সেরের গ্রহণযোগ্যতা ছিল একক ও আকাশচুম্বী। সের হারিয়ে যাওয়াও পুরা নামক চাল মাপার বাঁশ-বেতের পটটি এমনকি পুরা নামটিই হারিয়ে গেছে।

১৯৮২ সালের পহেলা জুলাইয়ের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সময়ে বহুলভাবেই প্রচলিত ছিল। আর ১৯৮২ সালের পহেলা জুলাইয়ে আমাদের দেশে ম্যাট্রিক পদ্ধতি চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে এই দেশীয় রীতির পরিমাপ পদ্ধতিটির বিলুপ্তি শুরু হয়। আশির দশকে রেডিও খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখন দীর্ঘদিন ধরেই রেডিওতে একটি ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘১ জুলাই থেকে মেট্রিক পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে, তাই আর বাংলা পদ্ধতিতে পরিমাপ চলবে না এখন মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সেরের পরিবর্তে কেজি… ইত্যাদি।’

এ সময় থেকে ব্যাপকভাবে উজিরপুরের গ্রাম থেকে পুরা দিয়ে ধান-চাল মাপার পদ্ধতিটিও উঠে যেতে শুরু করে। এখন গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে কেজি চলে আসছে। এমনকি বাড়িতে বাড়িতেও কেজির মাপের জন্য ইলেকট্রিক ওজন পরিমাপক, দাড়িপাল্লা চলে এসেছে। আর কমে গেছে পুরার ব্যবহার।

পুরার সাথে সাথে গ্রাম থেকে উঠে গেছে বউড্ডা দিয়ে ধান মাপার পদ্ধতিটিও। তখন একটি বউড্ডায় যতটুকু ধান ধরতো তাকে ‘কাডি’ বলা হতো। ২০২৫ সালে এসে উজিরপুরের বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিনে কাডির অস্তিত্ব খুবই কম পাওয়া গেছে। বউডার আকৃতি ছিল বেশ বড়। বাঁশের তৈরি একটি বউডায় অঞ্চলভেদে ২০ সের, ২৫ সের ধান বা চাল মাপার মতো আকৃতি বড় করা হতো।

এক কাডি ধানের বীজ দিয়ে যতটুকু জমিতে ধান চাষ হতো তাকে বলা হতো ‘এক কাডির বাইন’। তোর ওখানে জমি কতটুকু? উত্তরে কৃষক বলতেন, ‘এক কাডির বাইন’। এক কাডির বাইন বলতে মোটামুটি ২০ শতাংশের মতো জমিকে বুঝাতো। অর্থাৎ বাঁশ-বেতের তৈরি ধান-চাল মাপার পুরা, বউড্ডা হারিয়ে যেতে বসেছে।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ