ঢাকা ০৭:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

হামলা ঠেকাতে প্রশাসনের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে প্রশ্ন পূজা উদযাপন পরিষদের

  • আপডেট সময় : ০৯:০৬:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১
  • ৯৬ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় কয়েকটি বিষয় তুলে ধরে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার একটিরও ‘সুষ্ঠু বিচার’ হয়েছে বলে তাদের জানা নেই।
কোনো ঘটনা ঘটার পর দেশের রাজনৈতিকদের দলগুলোর পাল্টাপাল্টি ‘দোষারোপের সংস্কৃতি পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলছে বলে মনে করছেন পরিষদের নেতারা।
শারদীয় দুর্গাপূজায় কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন ম-পে হামলার পর গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংবাদ সম্মেলন করে পূজা উদযাপন পরিষদ।
লিখিত বক্তব্যে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, “কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা ও হামলা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসন সময়োযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।”
দুর্গাপূজার মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ভোরে নানুয়া দীঘির পাড়ে দর্পন সংঘের পূজাম-পে হনুমানের মূর্তির কোলে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন রাখা দেখে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। হামলা, ভাংচুর চালানো হয় অন্তত আটটি মন্দিরে। তার জের ধরে সেদিনই চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে মন্দিরে হামলা হয়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় পাঁচজন। এর পরের কয়েকদিনে নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়। তাতে নোয়াখালীতে নিহত হয় দুজন। নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, কুমিল্লা নানুয়া দীঘিরপাড়ের ম-পটি অস্থায়ী। ঘটনার রাতে ম-পে মাত্র একজন পাহারায় ছিল। রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ম-প এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
“আমাদের প্রশ্ন, কী কারণে কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সেই বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে কি?… থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হনুমান মুর্তির কোলের ওপর রাখা পবিত্র কোরআন শরিফটি সরিয়ে নেওয়ার পর কেন ভিডিও করার সুযোগ করে দিলেন এবং কেন সে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তা সকলের কাছে বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।”
নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, “নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বেলা ১১টার মধ্যে সকল পূজা ম-পে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হওয়ার পরও যখন হামলা শুরু হয়, তখন পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি মর্মে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো পর্যায়ের দায়িত্ব পালনে গাফলতি আছে কি না তা অবিলম্বে চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করি আমরা।”
বিচারহীনতা বা বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি দুষ্কৃতকারীদের ‘উৎসাহিত করছে’ এবং প্রায়ই তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে পরে আওয়ামী লীগের সময়ে তদন্ত কমিশন গঠনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “সেই রিপোর্টের আলোকে একজনেরও বিচার হয়েছে কি না, তা দৃশ্যমান নয়।”
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, “কোনো একটি ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক দোষারোপ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রধান হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক দোষারোপের কারণে প্রকৃত দোষীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে, যা দেশের আইনশঙ্খলা ও পারস্পরিক আস্থার জন্য সুখকর নয়।”
সম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়ে গত ৫০ বছরে ‘উল্লেখযোগ্য সংখ্যক’ হিন্দু দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যারা এখনও দেশকে ভালোবেসে মাতৃভূমিতে থাকতে চাইছেন বা আছেন, তারাও পর্যায়ক্রমে সহিংসতার শিকার হয়ে যে আস্থার সঙ্কটে পড়েছেন, তাতে ভবিষ্যৎ বলে দেবে তারা কতদিন দেশে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেন।“
দেশের বিভিন্ন ম-পে হামলার ঘটনায় প্রায় একশ মতো মামলা হয়েছে। কুমিল্লায় ম-পে কোরআন রাখার ঘটনায় ইকবাল হোসেন নামে এক যুবককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। মামলার গতিবিধি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করেছেন না তারা। আরও কিছুদিন দেখতে চান।
পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে আট দফা দাবিও তুলে ধরা হয় এ সংবাদ সম্মেলনে।
১. ক্ষতিগ্রস্ত সকল মন্দির, বাড়ি ঘর সরকারি খরচে পুননির্মাণ করে দিতে হবে। গৃহহীনদের দ্রুত পুনর্বাসন করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ‘যথোপযুক্ত’ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২. নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বিশেষ ট্রাইবুনালে প্রকৃত দোষীদের বিচারের পদক্ষেপ নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ক্ষেত্রেই নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না।
৪. সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং তদন্ত কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. হিন্দু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ‘আস্থার সংকট’ দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য ও পূর্ণাঙ্গ শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
৬. ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর তদন্ত করে শাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্টের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় নৃগোষ্ঠীর বিষয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত স্বত্ত্বাধিকারীর কাছে ফেরত দেওয়া, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আইনের অবসানসহ অন্যান্য প্রতিশ্রুতিগুলো সরকারের এই মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. সংবিধানে বিরাজমান অসঙ্গতি দূর করে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯৭২ এর সংবিধানের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
শ্যামাপূজায় দীপাবলী বর্জন : সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবারের শ্যামাপূজা সংশ্লিষ্ট মন্দির কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিমা বা ঘটে করা হবে এবং একাধিক দিনের অনুষ্ঠান পরিহার করা হবে। দীপাবলীর উৎসব বর্জন করা হবে। সম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে পূজার দিন ম-পের পাশে ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াও’ স্লোগান লেখা ব্যানার টাঙিয়ে রাখা হবে। অন্যদের মধ্যে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
বাড়িসহ ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দাবি হিন্দু মহাজোটের : সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন সম্প্রদায়ের বাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় সরকারি খরচে এসব নির্মাণ করাসহ যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ও আহতদের ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এ দাবি জানান। মহাজোটের নেতারা বলেন, প্রশাসনের নীরবতা আমাদের হতাশা ও নিরাপত্তা সংকটের মধ্যে ফেলেছে। তাদের সদিচ্ছা থাকলে এই ঘটনা এড়ানো যেতো। দীর্ঘদিন ধরে চলা সংখ্যালঘু নির্যাতনে সরকারের নমনীয় নীতির কারণে আজকের এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। বক্তারা বলেন, আজ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এটা আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই। যতদিন অপরাধীর বিচার না হবে, ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে। সনাতন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। বরং, হতাশা বাড়ছে। এর কারণ—দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনও মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হচ্ছে। তারা আরও বলেন, আগে রাতের আধারে মন্দির ভাঙা হতো। আর এখন রাতে নয়, দিনে মন্দির ভাঙা হচ্ছে। ধরা পড়লে প্রশাসন বলছে, পাগল ও মানসিক ভারসাম্যহীন। এখন পাগল বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে তারা আরও উৎসাহ পাচ্ছে। এতেই প্রতীয়মান হয়, সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে আন্তরিক নয়। বিদ্যমান আইনে এই মন্দির ভাঙা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোধ করা সম্ভব নয়। ঘটনার সাতদিন পর সরকারের সম্প্রীতি মিছিল সনাতন সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রহসন ছাড়া কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেন তারা।
এসময় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির ও বাড়ি সরকারি খরচে পুনর্র্নিমাণ করার দাবি জানান তারা। পাশাপাশি নিহতের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ও আহতদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।
বিক্ষোভ সমাবেশে হিন্দু মহাজোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুধাংশু চন্দ্র বিশ্বাসের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন মহাজোটের প্রধান সমন্বয়কারী শ্যামল কুমার রায়, নির্বাহী মহাসচিব ও মুখপাত্র পলাশ কান্তি দে, সহ-সভাপতি প্রভাস চন্দ্ৰ ম-ল, ডি সি রায়, যুগ্ম-মহাসচিব সমীর সরকার, অখিল মজল, ফণি ভূষণ হালদার কেনেডি ঘোষ, সাংগঠনিক সম্পাদক আশীষ বাড়ই, মনোজ বিশ্বাস, হারাধন বিশ্বাস, জগন্নাথ হালদার। এছাড়া আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু যুব মহাজোটের প্রধান সমস্বকারী পংকজ হালদার, সভাপতি প্রদীপ কান্তি দে, সাংগঠনিক সম্পাদক সুকেন নাহা, প্রচার সম্পাদক বিপিন ম-ল, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সঞ্জীব বৈদ্য ও সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী রায়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

হামলা ঠেকাতে প্রশাসনের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে প্রশ্ন পূজা উদযাপন পরিষদের

আপডেট সময় : ০৯:০৬:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় কয়েকটি বিষয় তুলে ধরে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার একটিরও ‘সুষ্ঠু বিচার’ হয়েছে বলে তাদের জানা নেই।
কোনো ঘটনা ঘটার পর দেশের রাজনৈতিকদের দলগুলোর পাল্টাপাল্টি ‘দোষারোপের সংস্কৃতি পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলছে বলে মনে করছেন পরিষদের নেতারা।
শারদীয় দুর্গাপূজায় কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন ম-পে হামলার পর গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংবাদ সম্মেলন করে পূজা উদযাপন পরিষদ।
লিখিত বক্তব্যে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, “কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা ও হামলা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসন সময়োযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।”
দুর্গাপূজার মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ভোরে নানুয়া দীঘির পাড়ে দর্পন সংঘের পূজাম-পে হনুমানের মূর্তির কোলে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন রাখা দেখে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। হামলা, ভাংচুর চালানো হয় অন্তত আটটি মন্দিরে। তার জের ধরে সেদিনই চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে মন্দিরে হামলা হয়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় পাঁচজন। এর পরের কয়েকদিনে নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়। তাতে নোয়াখালীতে নিহত হয় দুজন। নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, কুমিল্লা নানুয়া দীঘিরপাড়ের ম-পটি অস্থায়ী। ঘটনার রাতে ম-পে মাত্র একজন পাহারায় ছিল। রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ম-প এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
“আমাদের প্রশ্ন, কী কারণে কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সেই বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে কি?… থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হনুমান মুর্তির কোলের ওপর রাখা পবিত্র কোরআন শরিফটি সরিয়ে নেওয়ার পর কেন ভিডিও করার সুযোগ করে দিলেন এবং কেন সে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তা সকলের কাছে বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।”
নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, “নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বেলা ১১টার মধ্যে সকল পূজা ম-পে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হওয়ার পরও যখন হামলা শুরু হয়, তখন পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি মর্মে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো পর্যায়ের দায়িত্ব পালনে গাফলতি আছে কি না তা অবিলম্বে চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করি আমরা।”
বিচারহীনতা বা বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি দুষ্কৃতকারীদের ‘উৎসাহিত করছে’ এবং প্রায়ই তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে পরে আওয়ামী লীগের সময়ে তদন্ত কমিশন গঠনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “সেই রিপোর্টের আলোকে একজনেরও বিচার হয়েছে কি না, তা দৃশ্যমান নয়।”
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, “কোনো একটি ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক দোষারোপ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রধান হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক দোষারোপের কারণে প্রকৃত দোষীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে, যা দেশের আইনশঙ্খলা ও পারস্পরিক আস্থার জন্য সুখকর নয়।”
সম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়ে গত ৫০ বছরে ‘উল্লেখযোগ্য সংখ্যক’ হিন্দু দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যারা এখনও দেশকে ভালোবেসে মাতৃভূমিতে থাকতে চাইছেন বা আছেন, তারাও পর্যায়ক্রমে সহিংসতার শিকার হয়ে যে আস্থার সঙ্কটে পড়েছেন, তাতে ভবিষ্যৎ বলে দেবে তারা কতদিন দেশে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেন।“
দেশের বিভিন্ন ম-পে হামলার ঘটনায় প্রায় একশ মতো মামলা হয়েছে। কুমিল্লায় ম-পে কোরআন রাখার ঘটনায় ইকবাল হোসেন নামে এক যুবককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। মামলার গতিবিধি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করেছেন না তারা। আরও কিছুদিন দেখতে চান।
পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে আট দফা দাবিও তুলে ধরা হয় এ সংবাদ সম্মেলনে।
১. ক্ষতিগ্রস্ত সকল মন্দির, বাড়ি ঘর সরকারি খরচে পুননির্মাণ করে দিতে হবে। গৃহহীনদের দ্রুত পুনর্বাসন করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ‘যথোপযুক্ত’ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২. নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বিশেষ ট্রাইবুনালে প্রকৃত দোষীদের বিচারের পদক্ষেপ নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ক্ষেত্রেই নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না।
৪. সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং তদন্ত কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. হিন্দু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ‘আস্থার সংকট’ দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য ও পূর্ণাঙ্গ শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
৬. ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর তদন্ত করে শাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্টের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় নৃগোষ্ঠীর বিষয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত স্বত্ত্বাধিকারীর কাছে ফেরত দেওয়া, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আইনের অবসানসহ অন্যান্য প্রতিশ্রুতিগুলো সরকারের এই মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. সংবিধানে বিরাজমান অসঙ্গতি দূর করে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯৭২ এর সংবিধানের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
শ্যামাপূজায় দীপাবলী বর্জন : সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবারের শ্যামাপূজা সংশ্লিষ্ট মন্দির কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিমা বা ঘটে করা হবে এবং একাধিক দিনের অনুষ্ঠান পরিহার করা হবে। দীপাবলীর উৎসব বর্জন করা হবে। সম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে পূজার দিন ম-পের পাশে ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াও’ স্লোগান লেখা ব্যানার টাঙিয়ে রাখা হবে। অন্যদের মধ্যে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
বাড়িসহ ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দাবি হিন্দু মহাজোটের : সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন সম্প্রদায়ের বাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় সরকারি খরচে এসব নির্মাণ করাসহ যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ও আহতদের ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এ দাবি জানান। মহাজোটের নেতারা বলেন, প্রশাসনের নীরবতা আমাদের হতাশা ও নিরাপত্তা সংকটের মধ্যে ফেলেছে। তাদের সদিচ্ছা থাকলে এই ঘটনা এড়ানো যেতো। দীর্ঘদিন ধরে চলা সংখ্যালঘু নির্যাতনে সরকারের নমনীয় নীতির কারণে আজকের এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। বক্তারা বলেন, আজ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এটা আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই। যতদিন অপরাধীর বিচার না হবে, ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে। সনাতন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। বরং, হতাশা বাড়ছে। এর কারণ—দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনও মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হচ্ছে। তারা আরও বলেন, আগে রাতের আধারে মন্দির ভাঙা হতো। আর এখন রাতে নয়, দিনে মন্দির ভাঙা হচ্ছে। ধরা পড়লে প্রশাসন বলছে, পাগল ও মানসিক ভারসাম্যহীন। এখন পাগল বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে তারা আরও উৎসাহ পাচ্ছে। এতেই প্রতীয়মান হয়, সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে আন্তরিক নয়। বিদ্যমান আইনে এই মন্দির ভাঙা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোধ করা সম্ভব নয়। ঘটনার সাতদিন পর সরকারের সম্প্রীতি মিছিল সনাতন সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রহসন ছাড়া কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেন তারা।
এসময় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির ও বাড়ি সরকারি খরচে পুনর্র্নিমাণ করার দাবি জানান তারা। পাশাপাশি নিহতের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ও আহতদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।
বিক্ষোভ সমাবেশে হিন্দু মহাজোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুধাংশু চন্দ্র বিশ্বাসের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন মহাজোটের প্রধান সমন্বয়কারী শ্যামল কুমার রায়, নির্বাহী মহাসচিব ও মুখপাত্র পলাশ কান্তি দে, সহ-সভাপতি প্রভাস চন্দ্ৰ ম-ল, ডি সি রায়, যুগ্ম-মহাসচিব সমীর সরকার, অখিল মজল, ফণি ভূষণ হালদার কেনেডি ঘোষ, সাংগঠনিক সম্পাদক আশীষ বাড়ই, মনোজ বিশ্বাস, হারাধন বিশ্বাস, জগন্নাথ হালদার। এছাড়া আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু যুব মহাজোটের প্রধান সমস্বকারী পংকজ হালদার, সভাপতি প্রদীপ কান্তি দে, সাংগঠনিক সম্পাদক সুকেন নাহা, প্রচার সম্পাদক বিপিন ম-ল, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সঞ্জীব বৈদ্য ও সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী রায়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।