নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের দায়ের করা একটি মামলায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ নয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁদের পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবিরসহ ৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারক মো. আবুল কাশেম গতকাল মঙ্গলবার এ রায় দেন। অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের নামে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মামলায় এই সাজা দেওয়া হয়।
এ মামলায় প্রথম দফায় রায় ঘোষণার জন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য ছিল। তবে সেদিন মামলাটি রায় থেকে উত্তোলনপূর্বক ফের দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণের আবেদন করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে ৪ মার্চ দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করেন। সেদিন সাক্ষ্য দেন তৎকালীন দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমান ও কেশব রায় চৌধুরী। এরপর পুনরায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ১২ মার্চ দিন ধার্য করা হয়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ১৯ মার্চ ফের রায়ের দিন ধার্য করেন আদালত।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) হোটেল শাখা থেকে হলমার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে দায় (ফান্ডেড) অর্থ হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা। এই ঘটনায় ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের অপব্যবহার এবং পাচারের অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক।
তদন্ত শেষে পরের বছর ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ১১টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তাঁর ভায়রা তুষার আহমেদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়। পরে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৭ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এই ১১টি মামলা বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১–এ বদলি করা হয়। যার একটিতে তানভীর ও তার স্ত্রীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হলো।
রায়ে যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া বাকি সাতজন হলেনÑতানভীর মাহমুদের ভায়রা হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিযা, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক, আবদুল মতিন ও তসলিম হাসান।
বিভিন্ন কারাদ- পাওয়া বাকি আট আসামি হলেন, সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার, সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অফিসের জিএম ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সফিজউদ্দিন এবং এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান। এদের মধ্যে পাঁচ বছর কারাদ- দেওয়া হয়েছে জামাল উদ্দিনের। বাকিদের ১৭ বছর করে কারাদ- দিয়েছেন আদালত। আসামিদের মধ্যে জামাল উদ্দিন ও আলতাফ হোসেন জামিনে রয়েছেন। আর সাইফুল ইসলাম, আবদুল মতিন, হুমায়ুন কবির, গোপাল নাথ, তসলিম, সাইফুল হাসান, মেহেরুন্নেসা ও জাকারিয়া পলাতক রয়েছেন।
কারাদ-ের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি: এই মামলায় জামিনে থাকা একমাত্র আসামি সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার সকালে রায় শুনতে আদালতে আসেন। হাজিরায় স্বাক্ষরও করেন। রায় ঘোষণাও শোনেন। তাকে পৃথক দুই ধারায় সাত বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। কারাদ- শোনার পরই সবার অগোচরে আদালত থেকে পালিয়ে যান তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী হারুন অর রশিদ বলেন, জামাল উদ্দিন রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনি কোর্টে নেই। পরবর্তীতে তাকে খুঁজে আরও পাওয়া যায়নি। এর আগে এদিন বেলা ১২টা ৬ মিনিটে রায় ঘোষণা করতে আদালতের বিচারকাজ শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী শুধু মামলা নম্বর ডাকেন। আসামিদের অবস্থান জানতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরপর আদালত রায় ঘোষণা শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারি রাজীব ঘোষ জানান, রায় শেষে আসামিকে খুঁজতে গেলে দেখি তিনি নেই। আসামিদের নাম ডাকা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে বলেন, তখন পরিস্থিতি এমন ছিল না। এদিকে আসামি জামাল উদ্দিনের জামিন বাতিল করে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
আইনে থাকলে ‘মৃত্যুদ-ই দিতেন’ বিচারক: হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী জেসমিন ইসলামসহ তাদের সঙ্গীদের অপরাধের যে মাত্রা, তাতে তাদের মৃত্যুদ-ই হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বিচারক। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনের সীমাবদ্ধতায় তাদের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকার প্রথম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আবুল কাশেম। ২৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “মামলাটির ঘটনা ব্যাংকিং ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলা মনে করে, তাদের মৃত্যুদ-ের মতো সাজা হওয়া উচিত মর্মে আদালত মনে করে। “কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন। এমতাবস্থায় অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।”
হলমার্ক কেলেঙ্কারি তানভীর ও তার স্ত্রীসহ নয়জনের যাবজ্জীবন
জনপ্রিয় সংবাদ

























