খান অপূর্ব আহমদ
আমাদের চারপাশে গিয়ান-বারে সিনড্রোম অর্থাৎ জিবিএস রোগটি খুব একটা পরিচিত নয়। কিন্তু খুব সামান্য লক্ষণ দিয়ে শুরু হওয়া এ রোগ আপনাকে প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলতে পারে। আমরা যে হাত পা নাড়াচাড়া করছি, তাপমাত্রা এবং স্পর্শের অনুভূতি পাচ্ছি, আমাদের নিশ্বাস প্রশ্বাস- এসব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র। এক কথায় এটা মানবদেহের মাদারবোর্ডের মতো।
গিয়ান-বারে সিনড্রোম এমনই এক মারাত্মক রোগ, যেখানে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এ পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। ফলে মাংসপেশি দুর্বল হতে শুরু করে। এমন অবস্থা হয় যে, আক্রান্ত ব্যক্তি তার হাত পা ও অন্যান্য অঙ্গ নড়াচড়া করতে পারে না। খাবার চিবাতে বা গিলতে পারে না, কথা বলতে পারে না; এমনকি নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। একপর্যায়ে রোগী প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারেন।
যে কোনো বয়সেই হতে পারে জিবিএস নামের এই রোগ। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি মানুষ এবং নারীদের তুলনায় পুরুষদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
আপনার জিবিএস আছে কি না, সেটি বুঝতে কিছু লক্ষণের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তা হলো-
জিবিএসের লক্ষণ: ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য মতে, গিয়ান-বারে সিনড্রোমের উপসর্গ শুরুর দিকে টের পাওয়া যায় না। সাধারণত সমস্যার শুরু হয় পা থেকে। শুরুতে দুটি পায়ের পাতা একসাথে দুর্বল লাগতে শুরু করে। পায়ের আঙুল, পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে ঝিনঝিন, অসাড়তা ও সুই ফোটানোর মতো অনুভূতি হয়। এরপর ওই দুর্বলতা ও ঝিনঝিন অনুভূতি ক্রমেই উপরের দিকে আসতে থাকে। পেশি অনেক দুর্বল লাগে, পেশিতে ব্যথা হয় এবং জয়েন্টগুলো নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়।
এ সময় রোগীর চলাফেরা করতে, বিশেষ করে হাঁটতে বা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে খুব কষ্ট হয়। অনেকে চলতেই পারেন না। ভীষণ ক্লান্ত লাগে, অনেকের ওপর উদ্বেগ ও বিষণ্নতা ভর করে। ধীরে ধীরে পুরো পা থেকে কোমর, এরপর হাত, বাহু, মুখ অবশ হতে শুরু করে; একেবারেই নাড়াতে পারে না।
আক্রান্তদের এক-তৃতীয়াংশের বুকের পেশী দুর্বল হয়ে যায়। ফলে রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না। তখন ভেন্টিলেশনের অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া মুখের পেশী ঝুলে পড়ে, খাবার চিবাতে, গিলতে বা কথা বলতে সমস্যা হয়। এমন অবস্থায় রোগীকে বাঁচাতে আইসিইউতে চিকিৎসা দেয়া লাগে।
অনেকেরই ডবল ভিশন হয় অর্থাৎ সামনে থাকা একটা জিনিস দুটো করে দেখেন। প্রথম দুই থেকে চার সপ্তাহে লক্ষণগুলো স্থায়ী হয় এবং ক্রমেই প্রকট হতে থাকে।
অনেক সময় এই অসারতা পায়ের উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ার আগেই রোগটি থেমে যায়। তখন রোগী সেরে উঠতে থাকে। কিন্তু রোগটি শরীরের উপরের দিকে চলে এলেই বিপদ। তবে একটি বিষয় জেনে রাখবেন- এসব লক্ষণ থাকা মানেই যে কারো গিয়ান-বারে সিনড্রোম বা জিবিএস আছে, সেটি বলা যাবে না। শরীরের অন্য জটিলতার কারণেও হতে পারে এমনটা। তাছাড়া জিবিএস কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়।
জিবিএসের কারণ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, গিয়ান-বারে সিন্ড্রোম কেন হয়, এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের পরে এটি দেখা যায়। এইডস, হার্পিস সিমপ্লেক্স, ম্যাগনিওক্লিওসিস, এপস্টাইন বার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া ইত্যাদি সংক্রমণ থেকে এ রোগ দেখা দিতে পারে।
অনেক সময় সার্জারির পর কিংবা ডায়রিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত রোগীরা ক্যাম্পাইলো-ব্যাক্টর-জেজুনি ব্যাকটেরিয়া (ডায়রিয়া থেকে হয়) বা সাইটো-মেগালো ভাইরাসের (ফ্লু থেকে হয়) থেকেও জিবিএস সংক্রমণ হতে পারে। আবার ফ্লুর টিকা দেয়ার ফলেও জিবিএস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তবে এমনটা হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
প্রাথমিক পর্যায়ে গিয়ান-বারে সিন্ড্রোম বা জিবিএস সনাক্ত করা কঠিন। এমন অবস্থায় চিকিৎসকরা রোগীর মেডিকেল ইতিহাস, লক্ষণ, শারীরিক পরিস্থিতির সঙ্গে কিছু স্নায়বিক পরীক্ষা ও ফলাফলের মাধ্যমে জানিয়ে থাকেন তার জিবিএস আছে কি না। যদি জিবিএস এর লক্ষণ থাকে, তাহলে একজন নিউরোলজি বিশেষজ্ঞকে দেখানো জরুরি। চিকিৎসক শুরুতে শরীরের রিফ্লেক্স বা প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখেন।
বডি রিফ্লেক্স হলো- যখন শরীর কোন একটা পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায় কোন চিন্তাভাবনা ছাড়া। যেমন- আপনি পিছলে যাচ্ছেন বোধ করলে, আপনার হাত কোনো চিন্তা ছাড়াই নিজের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করবে।
শরীরে রিফ্লেক্স অনুভূতি ঠিকঠাক আছে কি না, পেশিতে কোনো অসাড়তা বা দুর্বলতা আছে কি না- চিকিৎসক সেটিই পরীক্ষা করেন। এরপর স্নায়ু ও পেশিতে ইলেকট্রিক্যাল টেস্ট করানো হয়। একই সঙ্গে স্পাইরোমেট্রি অর্থাৎ ফুসফুসের কার্যক্ষমতার পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা এবং লাম্বার পাংচার পরীক্ষাও করানো হয়ে থাকে।
লাম্বার পাংচার হলো এমন এক পরীক্ষা- যেখানে রোগীর মেরুদণ্ড থেকে তরলের একটি নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
গিয়ান-বারে সিনড্রোমের চিকিৎসা: স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যদি কারো গিয়ান-বারে সিনড্রোম ধরা পড়ে, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। তবে এ রোগের চিকিৎসা বহুল পরিচিত নয় বা খুব সাধারণও নয়। এ জন্য কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। এ সময় প্রতিনিয়ত রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন এবং রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করে জরুরি চিকিৎসা দেয়া হয়।
এই রোগের প্রধান চিকিৎসা হলো ইমিউনোথেরাপি; যাতে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আপনার স্নায়ুকে আর আক্রমণ করতে না পারে। সাধারণত রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি অপসারণে রোগীর শিরায় ইমিউনোগ্লোবুলিন বা প্লাজমা এক্সচেঞ্জ করা হয়। এ ছাড়া রোগের লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে, যেমন – ব্যথা কমানোর জন্য, রক্ত জমাট না বাঁধার জন্যে ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা চালু থাকে।
যদি রোগী হাঁটতে না পারে, তাহলে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস অর্থাৎ রক্ত জমাট বাধার ঝুঁকি কমাতে ওষুধ এবং কমপ্রেশন স্টকিংস দেয়া হয়।
কমপ্রেশন স্টকিংস হলো খুব টাইট ইলাস্টিকের মতো এক ধরনের মোজার মতো; যা পরে থাকলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং পা ফুলে যাওয়া রোধ করা যায়। এ ছাড়া পেশি শক্ত হয়ে গেলে হাত-পা সহজে নড়াচড়া করতে সাহায্য করার জন্য ফিজিওথেরাপি দেয়া হয়। এতে মাংসপেশির ক্ষয়, শুকিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করা যায়।
পেশিতে ব্যথা হলে ব্যথানাশক ওষুধ দেয়া হয়। তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা বা আইসিইউয়ে রাখা হয়। কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগলে তাকে প্রয়োজন অনুযায়ী থেরাপি দেয়া হয়।
স্বস্তির খবর হলো সময়মতো চিকিৎসা নিলে অর্থাৎ লক্ষণ দেখা দেয়ার সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে চিকিৎসা নিলে সম্পূর্ণ রোগমুক্তি সম্ভব। সাধারণত লক্ষণ দেখা দেয়ার দুই-তিন সপ্তাহ পর থেকেই রোগী সুস্থ হতে শুরু করে।
রোগ যদি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে, তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব। কারো কারো ক্ষেত্রে এই রোগ থেকে সেরে উঠতে ছয় মাস, এক বছর এমনকি তিন বছরের পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে চিকিৎসা নিতে দেরি হলে কিছু না কিছু শারীরিক দুর্বলতা স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে।
অনেক সময় শ্বাসকষ্ট, রক্তের সংক্রমণ, ফুসফুসের জমাট বাঁধা বা হার্ট অ্যাটাকে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ কারণে সুস্থ হওয়ার পরও চিকিৎসকরা কয়েক মাস অন্তর কিংবা বছরে অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে বলে থাকেন।
লেখক: সাংবাদিক
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























