ঢাকা ০৭:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

হঠাৎ পানি ও জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই

  • আপডেট সময় : ০৪:১৯:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম :বিষয়টি অনেকটা বিস্ময়কর! ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫ রাতের টিভি সংবাদের মাঝে মরা তিস্তায় হঠাৎ পানির প্রবাহ শুরু হয়েছে বলে ভিডিও দেখানো হচ্ছিল। খবরটা অনেকগুলো টিভিতে প্রচারিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনা যখন ঘটছিল তখন তিস্তার ধু ধু বালুচরে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে শামিয়ানা টাঙ্গানোর কাজ চলছে। তিস্তা পাড়ের হাজারো ভুক্তভোগী মানুষ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে একজোট হয়ে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে চারদিক মুখরিত করে ধ্বনি তুলে অবস্থান কর্মসূচিকে সফল করার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্যোগী হয়েছে ঠিক সেসময়ে শুষ্ক তিস্তার বুকে হঠাৎ পানির তোড় নেমে আসতে দেখে সবাই খুব অবাক।

তাহলে শীতকালে তিস্তায় পানি নেই বলে সীমান্তের ওপাড়ে এতকাল ধরে যে বক্তব্য প্রচার করা হতো তা শুধুই ভাঁওতাবাজি? দুই পাড়ের মানুষ বিস্ময়ের সাথে বলছেন, এবার শীতকালে হিমালয়ের পাদদেশে আগাম বরফ গলতে শুরু হয়েছে নাকি? এই শীতের রাতে তিস্তায় হঠাৎ কেন পানি আসছে?

গত কয়েক মাস থেকে বাংলাদেশের তিস্তা নদী তীরবর্তী মানুষ নতুন আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছে এই নদীর শুষ্ক মৌসুমের পানিপ্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য একটি বৃহত্তর আন্দোলনে শরিক হতে। অবশেষে দুই দিনব্যাপী তার সফল রূপায়ণ শুরু হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে এমন ঘটনা মানুষকে আরও বেশি ফুঁসে ওঠার খোরাক জুগিয়েছে।

কারণ তিস্তা পাড়ের হাজারো ভুক্তভোগী মানুষ বালুচরে শীতকালীন ফসল বুনেছেন। শামিয়ানা টাঙানোর মাধ্যমে চমকপ্রদ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষাকে সারা বিশ্বে তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়ার শুরুতে বিস্ময়ে লক্ষ্য করছেন যে হঠাৎ পানির প্রবাহ দিয়ে তাদের সভাস্থল ডুবিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে প্রতিবেশী দেশের স্বার্থান্বেষী কুচক্র। এবং এর সাথে যুক্ত হওয়া বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ভারতে পালিয়ে থাকা দোসরদের উসকানি বা করসাজির কথাও কেউ কেউ ভাবছেন! সেটা যাই হোক না কেন পরে বিশদ জানা যেতে পারে। তবে তিস্তা নিয়ে তেলেসমাতির ঘটনা এই নতুন নয়।

২০২২ সালে এপ্রিলের খরতাপে তিস্তানদীর ধু ধু বালুচরে বহুযুগ পরে হঠাৎ পানিপ্রবাহ শুরু হয়েছিল। তখন গত ৪ এপ্রিল থেকে নিলফামারী জেলার বাইশপুকুর এলাকায় চরের মধ্যে পানিপ্রবাহ দেখা যাচ্ছিল। চৈত্রের দাবদাহের মাঝে উত্তরের জেলাগুলোতে ধুলিঝড় হয়। কোন বছর বৃষ্টিছাড়া কালবৈশাখী ছোবল হানে বারবার। কালবৈশাখী ঝড়ে গাইবান্ধা জেলায় তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত এলাকায় মানুষের বসতবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে একদিনে ১২ জনের প্রাণহানির খবর জানা গিয়েছিল একই দিনে।

এর দু-তিনদিন আগে লালমনিরহাটের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ছিল মাত্র এক হাজার আটশ কিউসেক। সেখানকার পানিপ্রবাহ পরিমাপক অফিস জানিয়েছিল সীমান্তের ওপারের উজান থেকে পানির স্রোত এসে আমাদের মিটারে হঠাৎ ১৫ হাজার কিউসেক পানিপ্রবাহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল (দৈনিক ইত্তেফাক ০৫.০৪.২০২১)।

দ্রুত নদীতে নৌকা নিয়ে নেমে পড়েছে তীরবর্তী মানুষ। উজানের পানির স্রোতে হঠাৎ বৈরালী মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠেছেন তারা। তবে চরের অনেক বীজতলা ও উঠতি ফসল পানিতে ডুবে গেছে। বহু বছর জুনের আগে নদীতে পানির দেখা মেলেনি। তাই তারা এবছরও চরের উর্বর জমিতে গ্রীষ্মকালীন নানা ফসল বুনেছেন।

এপ্রিলে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তিস্তার উৎসমুখে পাহাড়ের পাদদেশে বরফ গলতে শুরু করে। সাধারণত বরফগলা পানি দিয়ে তিস্তা খরা মৌসুমে প্রাণ ফিরে পায়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এ নদীর শতাব্দীর ইতিহাসে এটাই চলে আসছিল। কিন্তু সিকিম ও জলপাইগুড়ির গাজলডোবাসহ উজানে অনেক ড্যাম ও বাঁধ দিয়ে এর পানিপ্রবাহ একচেটিয়াভাবে আটকিয়ে তারা নিজেরা ব্যবহার শুরু করলে বাংলাদেশের তিস্তা ক্যাচমেন্ট এলাকা শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠলেও বিষয়টি নানা তালবাহানার মাধ্যমে অতিক্রান্ত হতে থাকে।

বিশেষ করে গত কয়েক যুগ ধরে অসংখ্য মিটিং-মিছিল হয়। অনেক আশ্বাস দেওয়া হলেও বিশ্বাসের বরফ গলেনি। আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে কালক্ষেপণ চলছে। বর্তমানে শোনা যাচ্ছে গত ১০ বছর আগেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী বেশি কিছু প্রকাশিত হয়নি, তথ্য জানা যায়নি, পানিও আসেনি। এটা এখন দুই দেশের বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, “ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতপার্থক্যের কারণে তিস্তা চুক্তি আটকে আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ভারত।” ভারতের সাথে পানিসম্পদ বিষয়ক সচিব পর্যায়ের বৈঠকের বিস্তারিত নিয়ে ১৭ মার্চ ২০২১ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।

তিনি আরও বলেন, “২০১৯ সালের আগস্টে বাংলাদেশ-ভারতের সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। …এই বৈঠকটি আবার আমাদের গতকাল নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিস্তাসহ আমাদের সবগুলো অভিন্ন নদী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খুব পজিটিভ ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ..তাদের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে নির্বাচনের কারণে এই মুহূর্তে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর বা পারস্পরিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর তারা করবে না, নির্বাচনের পর তারা করতে সক্ষম হবেন।” (দৈনিক ইত্তেফাক ১৭ .০৩. ২০২১)।

প্রশ্ন হলো- তিস্তা চুক্তি যদি ১০ বছর আগে হয়ে থাকে তবে এখনো কেন নতুন করে চুক্তি করার ব্যাপারে একেকজন একেক কথা বলছেন তা বোধগম্য নয়। তিস্তা ইস্যুর কার্যকরী সমাধান নিয়ে আমাদের দায়িত্বশীলদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য মানুষকে বিভ্রান্ত ও হতাশ করছে।

এর আগে ২০১৭ সালে মমতা ব্যানার্জী বলেছিলেন, ‘তিস্তায় তো পানি নেই-চুক্তি হবে কীভাবে’? তার কথা ছিল তিস্তা নয়- তোরসা, জলঢাকা, মানসাই, ধানসাই ইত্যাদি নদীতে পানি আছে। সেগুলো থেকে বাংলাদেশের জন্য পানি দেওয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন-বাংলাদেশের তিস্তা চুক্তি নয়, দরকার তো জলের! তবে এসব ক্ষীণ জলধারাকে বর্ষাকালে নদী মনে হলেও এগুলো সারা বছর প্রবহমান কোন নদী নয়। এসব নদীর কোন অস্তিত্ব বা প্রবাহ কি বাংলাদেশে আছে? তিনি তিস্তা পানি বণ্টনের কথা অন্যখাতে নিয়ে গেছেন।

তিস্তা শুধু বৃষ্টিপাতনির্ভর পাহাড়ি ঢলের নদী নয়। বর্ষাকালে অতি বৃষ্টিপাাতের ফলে অতিরিক্ত পানি পাহাড়ি ঢল হয়ে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করে দেয়। শীতকাল পেরিয়ে মার্চ মাস শুরু হলে এ নদী বরফ গলা পানি নিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ছিল। তাই শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানিকে সিকিমে আটকালো বা কে মহানন্দা দিয়ে সরিয়ে নিল? কোথায় গেল? কোথায় যাচ্ছে? কোথায় কে ব্যবহার করছে বা কে কোথায় আটকে রেখে, কে খাচ্ছে? প্রযুক্তির বহুধা ব্যবহারের এ যুগে অনেকেই তা জানেন। এপ্রিলে উপরের বরফ গলা পানি এবং শীতকালে গাজলডোবায় উজানের সংরক্ষিত পানিও হঠাৎ তিস্তা দিয়ে নেমে আসে। মমতা ব্যানার্জীর কথা যে সঠিক নয় তা সবাই স্বীকার করবেন।

প্রশ্ন হলো- এপ্রিলের শুরুতে হঠাৎ পানিপ্রবাহ কি অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়? এতদিন পানিবণ্টন নিয়ে মমতা বলেছিলেন মোদীর কথা আর মোদী বলছিলেন মমতার একগুঁয়ে মনোভাবের কথা। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন শুরু হলে ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকা সফর করেন। সে সময় তিস্তা ইস্যু হালে পানি পায়নি। সবাই নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন।

তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে শুধু রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি নয়- চলছে সঠিক তথ্যসংক্রান্ত লুকোচুরি ও মিথ্যাচার। ‘তিস্তায় তো পানি নেই’- এ কথার সত্য-মিথ্যা এবার এপ্রিলের শুরুতে বরফগলা স্রোতের ঢল বাংলাদেশে নেমে এসে প্রমাণ করে দেখিয়েছে। তাই সবাইকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রকাশ করা উচিত। পাশাপাশি সবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিতরে সততা ও নৈতিকতার উন্মেষ ঘটানোর জন্য এ ধরনের কুৎসিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ধর্মের ঢোল একদিন নিজেই বেজে যাবে।

এর ক’বছর আগে উল্লেখ করেছিলাম, চীনের সঙ্গে তিস্তা পুনর্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে গেলেও প্রতিবেশী ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। বিগত আওয়ামী সরকার বহু চেষ্টা করেও তিস্তা সমস্যার সমাধান করাতে বিফল হয়েছে। তবে জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের এই সুবর্ণ সময়ে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক নতুন প্রেক্ষাপটে সেটার ন্যায্য হিস্যা আদায় করার নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকে মনে করছেন।

ছোট ছোট প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য ভারতকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। এটা যদি এখন করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে আর কখনো তিস্তা সমস্যার কার্যকরী সমাধান হবে তা বলাই বাহুল্য। যে ষড়যন্ত্রের পানি বা ইচ্ছের বরফগলা পানি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তিস্তায় প্রবাহিত হয়ে হঠাৎ বাংলাদেশে ঢুকেছে তা যেন রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার যাঁতাকলে ঘুরে আবার বন্ধ হয়ে না যায় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি থাকা দরকার।

পাশাপাশি বিশ্লেষকরা মনে করছেন বাংলাদেশের সাথে সুপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাব বজায় রাখা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও তিস্তাপাড়ের ভুক্তভোগী মানুষগুলোর দীর্ঘদিনের ক্ষোভ নিরসন কল্পে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ নাম লক্ষ জনতার দুই দিনব্যাপী প্রতিবাদের ভাষার দিকেও ভারতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সমস্যা সমাধানে দ্রুত হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

হঠাৎ পানি ও জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই

আপডেট সময় : ০৪:১৯:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম :বিষয়টি অনেকটা বিস্ময়কর! ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫ রাতের টিভি সংবাদের মাঝে মরা তিস্তায় হঠাৎ পানির প্রবাহ শুরু হয়েছে বলে ভিডিও দেখানো হচ্ছিল। খবরটা অনেকগুলো টিভিতে প্রচারিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনা যখন ঘটছিল তখন তিস্তার ধু ধু বালুচরে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে শামিয়ানা টাঙ্গানোর কাজ চলছে। তিস্তা পাড়ের হাজারো ভুক্তভোগী মানুষ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে একজোট হয়ে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে চারদিক মুখরিত করে ধ্বনি তুলে অবস্থান কর্মসূচিকে সফল করার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্যোগী হয়েছে ঠিক সেসময়ে শুষ্ক তিস্তার বুকে হঠাৎ পানির তোড় নেমে আসতে দেখে সবাই খুব অবাক।

তাহলে শীতকালে তিস্তায় পানি নেই বলে সীমান্তের ওপাড়ে এতকাল ধরে যে বক্তব্য প্রচার করা হতো তা শুধুই ভাঁওতাবাজি? দুই পাড়ের মানুষ বিস্ময়ের সাথে বলছেন, এবার শীতকালে হিমালয়ের পাদদেশে আগাম বরফ গলতে শুরু হয়েছে নাকি? এই শীতের রাতে তিস্তায় হঠাৎ কেন পানি আসছে?

গত কয়েক মাস থেকে বাংলাদেশের তিস্তা নদী তীরবর্তী মানুষ নতুন আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছে এই নদীর শুষ্ক মৌসুমের পানিপ্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য একটি বৃহত্তর আন্দোলনে শরিক হতে। অবশেষে দুই দিনব্যাপী তার সফল রূপায়ণ শুরু হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে এমন ঘটনা মানুষকে আরও বেশি ফুঁসে ওঠার খোরাক জুগিয়েছে।

কারণ তিস্তা পাড়ের হাজারো ভুক্তভোগী মানুষ বালুচরে শীতকালীন ফসল বুনেছেন। শামিয়ানা টাঙানোর মাধ্যমে চমকপ্রদ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষাকে সারা বিশ্বে তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়ার শুরুতে বিস্ময়ে লক্ষ্য করছেন যে হঠাৎ পানির প্রবাহ দিয়ে তাদের সভাস্থল ডুবিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে প্রতিবেশী দেশের স্বার্থান্বেষী কুচক্র। এবং এর সাথে যুক্ত হওয়া বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ভারতে পালিয়ে থাকা দোসরদের উসকানি বা করসাজির কথাও কেউ কেউ ভাবছেন! সেটা যাই হোক না কেন পরে বিশদ জানা যেতে পারে। তবে তিস্তা নিয়ে তেলেসমাতির ঘটনা এই নতুন নয়।

২০২২ সালে এপ্রিলের খরতাপে তিস্তানদীর ধু ধু বালুচরে বহুযুগ পরে হঠাৎ পানিপ্রবাহ শুরু হয়েছিল। তখন গত ৪ এপ্রিল থেকে নিলফামারী জেলার বাইশপুকুর এলাকায় চরের মধ্যে পানিপ্রবাহ দেখা যাচ্ছিল। চৈত্রের দাবদাহের মাঝে উত্তরের জেলাগুলোতে ধুলিঝড় হয়। কোন বছর বৃষ্টিছাড়া কালবৈশাখী ছোবল হানে বারবার। কালবৈশাখী ঝড়ে গাইবান্ধা জেলায় তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত এলাকায় মানুষের বসতবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে একদিনে ১২ জনের প্রাণহানির খবর জানা গিয়েছিল একই দিনে।

এর দু-তিনদিন আগে লালমনিরহাটের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ছিল মাত্র এক হাজার আটশ কিউসেক। সেখানকার পানিপ্রবাহ পরিমাপক অফিস জানিয়েছিল সীমান্তের ওপারের উজান থেকে পানির স্রোত এসে আমাদের মিটারে হঠাৎ ১৫ হাজার কিউসেক পানিপ্রবাহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল (দৈনিক ইত্তেফাক ০৫.০৪.২০২১)।

দ্রুত নদীতে নৌকা নিয়ে নেমে পড়েছে তীরবর্তী মানুষ। উজানের পানির স্রোতে হঠাৎ বৈরালী মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠেছেন তারা। তবে চরের অনেক বীজতলা ও উঠতি ফসল পানিতে ডুবে গেছে। বহু বছর জুনের আগে নদীতে পানির দেখা মেলেনি। তাই তারা এবছরও চরের উর্বর জমিতে গ্রীষ্মকালীন নানা ফসল বুনেছেন।

এপ্রিলে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তিস্তার উৎসমুখে পাহাড়ের পাদদেশে বরফ গলতে শুরু করে। সাধারণত বরফগলা পানি দিয়ে তিস্তা খরা মৌসুমে প্রাণ ফিরে পায়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এ নদীর শতাব্দীর ইতিহাসে এটাই চলে আসছিল। কিন্তু সিকিম ও জলপাইগুড়ির গাজলডোবাসহ উজানে অনেক ড্যাম ও বাঁধ দিয়ে এর পানিপ্রবাহ একচেটিয়াভাবে আটকিয়ে তারা নিজেরা ব্যবহার শুরু করলে বাংলাদেশের তিস্তা ক্যাচমেন্ট এলাকা শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠলেও বিষয়টি নানা তালবাহানার মাধ্যমে অতিক্রান্ত হতে থাকে।

বিশেষ করে গত কয়েক যুগ ধরে অসংখ্য মিটিং-মিছিল হয়। অনেক আশ্বাস দেওয়া হলেও বিশ্বাসের বরফ গলেনি। আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে কালক্ষেপণ চলছে। বর্তমানে শোনা যাচ্ছে গত ১০ বছর আগেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী বেশি কিছু প্রকাশিত হয়নি, তথ্য জানা যায়নি, পানিও আসেনি। এটা এখন দুই দেশের বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, “ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতপার্থক্যের কারণে তিস্তা চুক্তি আটকে আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ভারত।” ভারতের সাথে পানিসম্পদ বিষয়ক সচিব পর্যায়ের বৈঠকের বিস্তারিত নিয়ে ১৭ মার্চ ২০২১ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।

তিনি আরও বলেন, “২০১৯ সালের আগস্টে বাংলাদেশ-ভারতের সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। …এই বৈঠকটি আবার আমাদের গতকাল নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিস্তাসহ আমাদের সবগুলো অভিন্ন নদী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খুব পজিটিভ ও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ..তাদের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে নির্বাচনের কারণে এই মুহূর্তে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর বা পারস্পরিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর তারা করবে না, নির্বাচনের পর তারা করতে সক্ষম হবেন।” (দৈনিক ইত্তেফাক ১৭ .০৩. ২০২১)।

প্রশ্ন হলো- তিস্তা চুক্তি যদি ১০ বছর আগে হয়ে থাকে তবে এখনো কেন নতুন করে চুক্তি করার ব্যাপারে একেকজন একেক কথা বলছেন তা বোধগম্য নয়। তিস্তা ইস্যুর কার্যকরী সমাধান নিয়ে আমাদের দায়িত্বশীলদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য মানুষকে বিভ্রান্ত ও হতাশ করছে।

এর আগে ২০১৭ সালে মমতা ব্যানার্জী বলেছিলেন, ‘তিস্তায় তো পানি নেই-চুক্তি হবে কীভাবে’? তার কথা ছিল তিস্তা নয়- তোরসা, জলঢাকা, মানসাই, ধানসাই ইত্যাদি নদীতে পানি আছে। সেগুলো থেকে বাংলাদেশের জন্য পানি দেওয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন-বাংলাদেশের তিস্তা চুক্তি নয়, দরকার তো জলের! তবে এসব ক্ষীণ জলধারাকে বর্ষাকালে নদী মনে হলেও এগুলো সারা বছর প্রবহমান কোন নদী নয়। এসব নদীর কোন অস্তিত্ব বা প্রবাহ কি বাংলাদেশে আছে? তিনি তিস্তা পানি বণ্টনের কথা অন্যখাতে নিয়ে গেছেন।

তিস্তা শুধু বৃষ্টিপাতনির্ভর পাহাড়ি ঢলের নদী নয়। বর্ষাকালে অতি বৃষ্টিপাাতের ফলে অতিরিক্ত পানি পাহাড়ি ঢল হয়ে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করে দেয়। শীতকাল পেরিয়ে মার্চ মাস শুরু হলে এ নদী বরফ গলা পানি নিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ছিল। তাই শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানিকে সিকিমে আটকালো বা কে মহানন্দা দিয়ে সরিয়ে নিল? কোথায় গেল? কোথায় যাচ্ছে? কোথায় কে ব্যবহার করছে বা কে কোথায় আটকে রেখে, কে খাচ্ছে? প্রযুক্তির বহুধা ব্যবহারের এ যুগে অনেকেই তা জানেন। এপ্রিলে উপরের বরফ গলা পানি এবং শীতকালে গাজলডোবায় উজানের সংরক্ষিত পানিও হঠাৎ তিস্তা দিয়ে নেমে আসে। মমতা ব্যানার্জীর কথা যে সঠিক নয় তা সবাই স্বীকার করবেন।

প্রশ্ন হলো- এপ্রিলের শুরুতে হঠাৎ পানিপ্রবাহ কি অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়? এতদিন পানিবণ্টন নিয়ে মমতা বলেছিলেন মোদীর কথা আর মোদী বলছিলেন মমতার একগুঁয়ে মনোভাবের কথা। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন শুরু হলে ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকা সফর করেন। সে সময় তিস্তা ইস্যু হালে পানি পায়নি। সবাই নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন।

তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে শুধু রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি নয়- চলছে সঠিক তথ্যসংক্রান্ত লুকোচুরি ও মিথ্যাচার। ‘তিস্তায় তো পানি নেই’- এ কথার সত্য-মিথ্যা এবার এপ্রিলের শুরুতে বরফগলা স্রোতের ঢল বাংলাদেশে নেমে এসে প্রমাণ করে দেখিয়েছে। তাই সবাইকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রকাশ করা উচিত। পাশাপাশি সবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিতরে সততা ও নৈতিকতার উন্মেষ ঘটানোর জন্য এ ধরনের কুৎসিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ধর্মের ঢোল একদিন নিজেই বেজে যাবে।

এর ক’বছর আগে উল্লেখ করেছিলাম, চীনের সঙ্গে তিস্তা পুনর্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে গেলেও প্রতিবেশী ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। বিগত আওয়ামী সরকার বহু চেষ্টা করেও তিস্তা সমস্যার সমাধান করাতে বিফল হয়েছে। তবে জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের এই সুবর্ণ সময়ে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক নতুন প্রেক্ষাপটে সেটার ন্যায্য হিস্যা আদায় করার নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকে মনে করছেন।

ছোট ছোট প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য ভারতকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। এটা যদি এখন করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে আর কখনো তিস্তা সমস্যার কার্যকরী সমাধান হবে তা বলাই বাহুল্য। যে ষড়যন্ত্রের পানি বা ইচ্ছের বরফগলা পানি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তিস্তায় প্রবাহিত হয়ে হঠাৎ বাংলাদেশে ঢুকেছে তা যেন রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার যাঁতাকলে ঘুরে আবার বন্ধ হয়ে না যায় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি থাকা দরকার।

পাশাপাশি বিশ্লেষকরা মনে করছেন বাংলাদেশের সাথে সুপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাব বজায় রাখা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও তিস্তাপাড়ের ভুক্তভোগী মানুষগুলোর দীর্ঘদিনের ক্ষোভ নিরসন কল্পে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ নাম লক্ষ জনতার দুই দিনব্যাপী প্রতিবাদের ভাষার দিকেও ভারতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সমস্যা সমাধানে দ্রুত হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর।