প্রত্যাশা ডেস্ক : লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি ও পবিত্র কাবা প্রদক্ষিণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে চলতি বছরের পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা। বিশ্বের নানা প্রান্তের লাখ লাখ মুসলমান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হয়েছেন মক্কায়।
করোনাভাইরাস মহামারির আগের মতো এবারই প্রথম সারা বিশ্বের লাখো মুসল্লি হজ পালনে জড়ো হয়েছেন। গতকাল সোমবার (২৬ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে সোমবার। হাজিরা এদিন সকালে ফজরের নামাজের পর মিনার উদ্দেশে যাত্রার মধ্য দিয়ে হজের মূল কার্যক্রম শুরু করেন। আর শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে আগামী ১২ জিলহজ এই আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। আল আরাবিয়া বলছে, হাজিরা রোববার মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে পৌঁছেন এবং সেখানে তারা তাওয়াফ আল-কুদুম সম্পন্ন করেন। এটি আগমনের তাওয়াফ নামে পরিচিত। এছাড়া এটি ইহরাম অবস্থায় প্রবেশের পর হজ যাত্রার প্রথম ধাপ বলেও পরিচিত। তারপরে তারা সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাঈ পালন করেন।
পরে সোমবার সকালে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে হজযাত্রীরা মিনায় যাত্রার আগে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য গ্র্যান্ড মসজিদে জড়ো হন। নামাজ শেষে তারা মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। আর সোমবার পুরো দিন ও রাত হাজিরা সেখানে অবস্থান করে প্রার্থনা করবেন এবং হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনটির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের ভালোভাবে বিশ্রামে থাকা নিশ্চিত করতে মিনা এলাকায় হাজার হাজার তাঁবু স্থাপন করেছে। এখানে অবস্থানকালে হজযাত্রীরা সারারাত কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ আদায় করবেন। মূলত তাঁবুর শহর নামে পরিচিত মিনা প্রান্তরে পৌঁছানোর মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। হজের পাঁচ দিনের প্রথম দিন মিনায় অবস্থান করতে হয়। এখানে অংশ গ্রহণ করা এবং ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা সুন্নত। মিনায় অবস্থানের পর পর্যায়ক্রমে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, মুজদালিফায় রাতযাপন এবং জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ, কোরবানিসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করবেন হাজিরা। জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে ১২ জিলহজ শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা। আল আরাবিয়া বলছে, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে গত কয়েক বছরে হাজিদের সংখ্যা সীমিত করতে বাধ্য হওয়ার পর চলতি বছরের হজ মৌসুমে হজযাত্রীদের সংখ্যার ওপর বিধিনিষেধ প্রথমবারের মতো তুলে নেওয়া হয়েছে। সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী ড. তৌফিক আল-রাবিয়া গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাদশাহ সালমান এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে হজযাত্রীদের সর্বোত্তম পরিষেবা প্রদান অব্যাহত রাখবে কর্তৃপক্ষ। এবার বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২০ লাখের অধিক মুসল্লি পবিত্র হজ পালন করবেন বলেও জানান হজ ও ওমরাহ বিষয়ক মন্ত্রী ড. তৌফিক আল রাবিয়া।
পবিত্র মক্কা নগরী থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিনা প্রান্তর। হজ পালনকারীরা সবাই গতকাল সোমবার মিনায় পৌঁছে গেছেন। লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পদচারণায় মুখরিত মিনা প্রান্তর। সোমবার (৮ জিলহজ) জোহর থেকে আরাফার দিন (মঙ্গলবার) ফজর পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। এখানে হজ পালনকারীরা ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন।
মিনাগামী সবার উদ্দেশ্য একটাই-আজ মঙ্গলবার ফজর নামাজ পড়ে সম্ভব হলে গোসল করে কিংবা ওজু করেই হজের মূল কাজ আরাফার ময়দানে গিয়ে উপস্থিত হবেন। ফজর নামাজ আদায় করে মিনা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে রওয়ানা হবেন তারা। মিনা থেকে আরাফা প্রান্তর তালবিয়ার ‘লাব্বাইক’ ধ্বনি এবং তাকবির, তাসবিহ-তাহলিলে মুখরিত হবে মিনা ও আরাফা প্রান্তর।
মিনা প্রান্তরে অবস্থিত লক্ষাধিক তাঁবুতে অবস্থান করছেন হজপালনকারীরা। নামাজ, তাসবিহ-তাহলিলের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করবে ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাঁবুতে তাঁবুতে চলছে আজান-ইকামত ও নামাজ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসল্লিদের জন্য লক্ষাধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু স্থাপন করে আবাসনের ব্যবস্থা করেছে সৌদি সরকার। তাঁবুর বাইরে ছোট ছোট ড্রামভর্তি খাবারের পানি। এ তাঁবুতেই ৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে এবং অবস্থান করবে হজ পালনকারীরা।
৯ জিলহজ ফজরের পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমান রওয়ানা হবে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে। সেখানে হজপালনকারীরা অবস্থান নেবে জাবালে রহমত, মসজিদে নামিরাসহ আরাফাতের বিশাল ময়দানে। জোহরের নামাজের আগেই মুসলিম উম্মাহ পৌঁছে যাবে আরাফাতের ময়দানে। কেননা আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়ায়ই হলো হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। জোহরের পর মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা প্রদান করা হবে। এবারের খুতবা প্রদান করবেন সৌদি আরবের সিনিয়র উলামা কাউন্সিলের সদস্য শায়খ ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ।
উল্লেখ্য, জাবালে রহমত নামক পাহাড় থেকে আগে হজের খুতবা প্রদান করা হতো। প্রায় ২০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের পূর্ব দিকের পাথরের সিঁড়িতে একটি মঞ্চ ও মিম্বার ছিল। সে সিঁড়ির ৬ষ্ঠ ধাপে দাঁড়িয়ে ৯ জিলহজ হজের খুতবা প্রাদান করা হতো।
বর্তমানে সেই মঞ্চ ও মিম্বার নেই। এখন জাবালে রহমত থেকেও হজের খুতবা দেওয়া হয় না। এখন তা প্রদান করা হয় মসজিদে নামিরা থেকে। মাইকের মাধ্যমে দেওয়া এ খুতবা এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সম্প্রচার করা হয়। মুসলিম উম্মাহর দুনিয়া ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও দিক-নির্দেশনায় আসবে এ খুতবা থেকে। মুসলিম উম্মাহর চলমান সংকট ও উত্তরণের উপায় সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করা হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রসঙ্গের পাশাপাশি ধর্মীয় বিভিন্ন বিধি বিধানের আলোচনা থাকবে হজের খুতবায়। হজ পালনকারীরা তাসবিহ-তাহলিল-তাকবির ও ইসতেগফারের মাধ্যমে দিনটি অতিবাহিত করবে। অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। রোনাজারি করবে গুনাহ মাফে। এ ময়দানেই তো আল্লাহ তাআলা হজরত আদম ও হাওয়া আলাইসি সালামকে ক্ষমা করে মিলিত করেছিলেন। সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে হজপালনকারীরা। জিলহজের ৯ তারিখ সূর্যাস্তের পর ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দান থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে হজপালনকারীরা। সেখানে গিয়ে তারা মাগরিব ও ইশা এক সঙ্গে আদায় করবেন। জিলহজের ৯ তারিখ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করা সুন্নাত। আর ১০ জিলহজ ফজরের নামাজের পর সূর্য ওঠার আগে সামান্য সময় মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। ১০ জিলহজ সূর্য ওঠার আগেই মিনার উদ্দেশ্যে মুজদালিফা ত্যাগ করতে হবে। মিনায় গিয়ে দুপুরের আগেই জামরাতে আকাবায় অর্থাৎ বড় জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষে করতে হবে। ১০ জিলহজ কংকর নিক্ষেপের পর কোরবানি আদায় করতে হবে। কোরবানি যদি ব্যাংকের মাধ্যমে আদায় করতে হয় তবে কোরবানির সময় জেনে নেয়া। কেননা কোরবানির পরের কাজই হলো মাথা মু-ন বা ন্যাড়া করা। তাই কোরবানির সঠিক সময় জেনে নিয়েই মাথা ন্যাড়া করতে হবে।
সাবধানতা অবলম্বন: ১০ জিলহজ কংকর নিক্ষেপ, কোরবানি ও মাথা ন্যাড়া করা-এ ৩টি কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা করাও ওয়াজিব। তবে ইফরাদ হজ পালনকারীদের জন্য কোরবানি করতে হবে না। তারা কংকর নিক্ষেপের পরপরই মাথা ন্যাড়া করে নেবে।
১০ জিলহজ মাথা ন্যাড়া করার মাধ্যমে ইহরাম থেকে হালাল হবে হজ পালনকারীরা। তারা স্ত্রীসহবাস ব্যতিত বাকি সব কাজ করতে পারবে। অতঃপর ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগেই তওয়াফে জিয়ারত আদায় করতে হবে। তওয়াফে জিয়ারত আদায় করে পুনরায় মিনায় অবস্থান করতে হবে।
১১ জিলহজ সৌদি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে ছোট, মধ্যম ও বড় জামরাতে কংকর নিক্ষেপ করতে হবে।
১২ জিলহজ ও সৌদি হজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে ছোট, মধ্যম ও বড় জামরাতে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করতে হবে। যদি কেউ ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারে তবে তাকে ১৩ তারিখও মিনায় অবস্থান করতে হবে। আর ১৩ তারিখও ছোট, মধ্যম ও বড় জামরাতে ৭টি করে ২১টি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। মিনার জামরাতগুলোতে বাংলায় কংকর নিক্ষেপের দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয় তা মনোযোগ সহকারে শুনে কংকর নিক্ষেপ করা সহজ। নারী ও দুর্বল হজ পালনকারীদের জন্য রাতে কংকর নিক্ষেপ করা নিরাপদ। অতঃপর ১৩ জিলহজের পর বিদায়ী তওয়াফের মাধ্যমে নিজ নিজ গন্তব্যে (দেশে) ফিরবে হজ পালনকারীরা। ১৩ জিলহজের পর যে কোনো নফল তওয়াফই বিদায়ী তওয়াফ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
মনে রাখতে হবে: মক্কা থেকে দেশে ফিরতে দেরী হলে দেশে ফেরার আগে অবশ্যই বিদায়ের নিয়তে পুনরায় তওয়াফ করতে হবে। আর এভাবেই শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা। পবিত্র হজকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সৌদি হজ কর্তৃকপক্ষ নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি অতিরিক্ত লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করেছে। পাশাপাশি রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, জরুরি চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। আল্লাহ তাআলা হজ পালনকারীদের সুষ্ঠু নিরাপদ হজ পালনের তাওফিক দান করুন। সবাইকে হজে মাবরুর দান করুন। আমিন।