শরিফুল রোমান
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ২৩ অক্টোবর দিনটি চিরস্থায়ী এক বেদনার প্রতীক। আজ থেকে তেরো বছর আগে ২০১২ সালের এই দিনে, থেমে যায় কথার জাদুকর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলম। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নিজ বাড়িতে চিরবিদায় নেন বাংলা সাহিত্যের এই বহুমাত্রিক শিল্পী। কিন্তু চলে গেলেও তার শব্দ, কাব্য আর দর্শন আজও বাঙালি পাঠকের অন্তরে জ্বলজ্বল করছে অনন্ত আলোয়।
১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে জন্ম নেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। মাত্র চার বছর বয়সে পরিবারসহ কলকাতায় আসেন তিনি। কৈশোরেই সাহিত্যপ্রেম তাকে টেনে নেয় লেখার জগতে। তরুণ বয়সেই বাংলা কবিতায় তিনি নিয়ে আসেন নতুন এক ভাষা, নতুন এক স্বর।
১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কৃত্তিবাস’ কবিতা পত্রিকা—যা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের নবীন কবিদের উর্বর জমিন। এখান থেকেই উঠে আসেন পরবর্তী প্রজন্মের অনেক সাহিত্যতরুণ। আর সুনীল হয়ে ওঠেন তাদের পথপ্রদর্শক।
দুই শতাধিক বইয়ের লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করেছেন। কিন্তু কবিতাই ছিল তার প্রথম প্রেম। তার কবিতায় প্রেম, জীবন, একাকিত্ব আর অস্তিত্বের মেলবন্ধন এক অপূর্ব ভাষায় ধরা দিয়েছে। ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘ভোরবেলার উপহার’, ‘সাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে’, ‘আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি’ ও ‘ভালোবাসা খণ্ডকাব্য’- এসব কবিতা আজও বাংলা সাহিত্যের আবেগময় মাইলফলক।
শুধু কবি নয়, ঔপন্যাসিক হিসেবেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছেন নতুন দিগন্ত। ১৯৬৫ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ বাংলা কথাসাহিত্যে এক নবীন কণ্ঠের শক্ত উপস্থিতি জানান দেয়। পরে তার মহাকাব্যিক ঐতিহাসিক উপন্যাস সেই সময় বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করে এক নতুন যুগ। পলাশীর যুদ্ধ থেকে উনিশ শতকের সূচনা পর্যন্ত সময়কে কেন্দ্র করে লেখা এই অসাধারণ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৫ সালে তিনি অর্জন করেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। এর পাশাপাশি প্রথম আলো ও পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসও পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়।
শিশু-কিশোর সাহিত্যেও সুনীলের অবদান অবিস্মরণীয়। তার সৃষ্টি কাকাবাবু সিরিজ আজও বাঙালি শিশুদের রোমাঞ্চের প্রতীক। ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত এই সিরিজের প্রায় ৩৫টি গল্প আজও সমান জনপ্রিয়, যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে একাধিক সফল চলচ্চিত্র- মিশর রহস্য, সবুজ দ্বীপের রাজা সহ আরও অনেক। সাহিত্যজগতে তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ব্যবহার করেছেন একাধিক সাহিত্যিক ছদ্মনাম- নীল লোহিত, সনাতন পাঠক ও নীল উপাধ্যায়।
সুনীলের সৃষ্টিশীলতা ছুঁয়ে গেছে চলচ্চিত্রকেও। সত্যজিৎ রায় তার গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী ও অরণ্যের দিনরাত্রি—যা আজও বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের ক্লাসিক সম্পদ। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার—আনন্দ পুরস্কার (১৯৭২ ও ১৯৮৯), বঙ্কিম পুরস্কার (১৯৮২) এবং সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫)।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কেবল একজন লেখক নন। তিনি ছিলেন সময়ের প্রতিধ্বনি, সমাজের বিশ্লেষক এবং প্রেম ও মানবতার অনন্ত অনুবাদক। তার কলমে প্রেম পেয়েছে কবিতার রোমাঞ্চ, আবার সমাজ ও ইতিহাস পেয়েছে গভীর মানবিক বিশ্লেষণ। আজ তার প্রয়াণ দিবসে বাঙালি পাঠক আবারও ফিরে তাকায় সেই কালজয়ী স্রষ্টার দিকে—যিনি প্রমাণ করেছিলেন, শব্দই পারে মানুষকে অমর করে তুলতে।
অনুভবে, স্মৃতিতে আর অগণিত পাঠকের হৃদয়ে আজও জীবন্ত তিনি- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























