হাসান জাহিদ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বা আমরা যাকে সংক্ষিপ্ত নামে জানি ‘এসএমআই’ বলে, তিনি আর কোনোদিন ফিরবেন না। ঢাবির কলা ভবনে ইংরেজি বিভাগের একটি কক্ষে পাইপ মুখে তিনি বই পড়তেন। পুরো কক্ষটাই ছিল বইয়ে ঠাঁসা। স্যারের ক্লাসে কখনো কোনো টুঁ শব্দটি হতো না। তার পড়াবার স্টাইল, বাচনভঙ্গি ও অগাধ জ্ঞানের আলোকে আমরা সমৃদ্ধ হতাম।
সেটি বহুকাল আগের কথা। কিন্তু অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মতো আমার সাথে সেই দীর্ঘকাল আগের সম্পর্কটা অটুঁট ছিল। মূলত নিজস্ব কায়দায় ও দর্শনে তিনি ছিলেন শিক্ষকতায় অনন্য। তার অনেক ছাত্র-ছাত্রী দেশে-বিদেশে স্বনামধন্য হয়েছেন। বড় সরকারি চাকরি করেছেন, রাষ্ট্রদূত হয়েছেন।
তাকে নিয়ে অনেকেই লিখবেন, তাদের নিজস্ব উপলব্ধি ও এসএমআইকে নিয়ে তাদের সম্পৃক্ততা-অভিজ্ঞতা নিয়ে। অনেক সমৃদ্ধ লেখা হবে, অনেক অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে লিখবেন। আমার মতো নগণ্য এক কথাশিল্পী ও সংগীতশিল্পীর লেখাটা কিন্তু একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতার। সে কথাই বলবো সংক্ষেপে।
এই তো সেদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এলেন। যাওয়ার আগে তার সাথে হোয়াটসঅ্যাপে দুই দুইবার কথা হয় আমার। সাহিত্য, সংগীত ও পারিবারিক বিষয়ে। আমার বিষয়ে তার এতা আগ্রহ দেখে আমি নতুনভাবে আলোড়িত হলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘অনেকেই এমেরিটাস প্রফেসর হয়ে ক্লাস নেন না। তিনি নেন। অলসতা তার পছন্দ নয়।’ তিনি বললেন, ‘আমি জানি, আমি যাদের ক্লাসে পড়াই; তারা কোনো জড় পদার্থ নয়। তাদের কেউ অমনোযোগী হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আমি তাকে বিনীতভাবে ক্লাস ছেড়ে চলে যেতে বলি। হয়তো তার অমনোযোগিতার কারণে পুরো ক্লাসই বরবাদ হয়ে যেতে পারে।’
সালটা ঠিক মনে নেই। ১৯৭৪ বা ৭৫ হবে। তিনি পত্রিকায় গল্প প্রকাশ করলেন। এরপর নীরবতা। নব্বই দশকে তিনি ছিলেন অ্যাভারেস্টের চূড়ায়। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। বই প্রকাশ করেন। খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। লেখায় অনেকেই তাকে উত্তরাধুনিক ঘরানার একজন পথিকৃৎ মনে করেন।
দীর্ঘ বিরতির কারণে তিনি কোনো দশকওয়ারি বিভাজনে পড়েন না কথাশিল্পী হিসেবে। তবে তার ক্লাসিক ও জাদুবাস্তবীয় লেখাগুলো পাঠকেরা, তার অনুরাগী ও সমালোচকেরা সাদরে বরণ করলেন।
ঢাবি ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময় তার নেতৃত্বে আমরা গুটিকয় ছাত্র-ছাত্রী নেপাল ও ভারত ভ্রমণ করেছিলাম। সেই ভ্রমণের স্মৃতি এখনো মনের কোণে সাজানো আছে। তার গাইডেন্স পেতে, লেখা নিতে আমি ছাত্রজীবন শেষ করে, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও তার অফিসকক্ষে যেতাম। আমি তখন পরিবেশে কাজ করি। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে স্মরণিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তেছিল। একবার আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, লেখক-কবিদের লেখা নেবো পরিবেশ বিষয়ে। স্যারের কাছে গিয়ে তার লেখাও নিলাম।
সম্ভবত ২০১০ সালে তিনি আমার মোহাম্মদপুরের বাসায় নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি আমাকে উত্তরাধুনিকতাবাদ ও জাদুবাস্তবতা বিষয়ে অনেকগুলো বইয়ের নাম বললেন। আমি লিখে নিলাম।
এটি অনেকটা বিস্ময়কর ও আমার জন্য গর্বের বিষয়, তিনি আমার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সামনাসামনি বসে আমার গান শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। এটা মাত্র মাস দুয়েক আগের মুঠো ফোনালাপ। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে অন্যরকম ছিল, এটা আমার কল্পনাতেও আসেনি। কথা ছিল, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এলে আমি ছোটখাটো একটা গানের অনুষ্ঠান করবো, তিনি সেখানে উপস্থিত থাকবেন।
স্যার এলেন। কিন্তু তাকে যেতে হলো হাসপাতালে ও লাইফ সাপোর্টে। গত বুধবার আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ভাবি ও তাদের ছেলে সাফাকের সাথে কথা হয়। দেখা হয়নি তিনি সিসিইউতে গুরুতর অবস্থায় থাকার কারণে।
এক জীবনে একজন মানুষ কত কিছু করে যেতে পারেন, মনজুর স্যার সেই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আমরা অনেকেই জানি, উপমহাদেশের প্রভাবশালী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী স্যারের মামা ছিলেন। একটা বিষয় জানতাম না। সেটা জানলাম আমাদের ব্যাচের বন্ধুর ফরোয়ার্ডকৃত ফেসবুক ম্যাসেজ থেকে; যেখানে মকবুল চৌধুরী তার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন সিলেট অঞ্চলের বিখ্যাত বিয়ের গান ‘লিলা বালি লিলা বালি, বর ও যুবতী সইগো, বর ও যুবতী সইগো’র রচয়িতা ছিলেন স্যারের মা।
লিখতে লিখতে মনে হলো, স্যার যেন শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন আমার মনের কোণে। স্যার আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ