রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলা সাহিত্যের অনন্য রত্ন। তিনি শুধু কবি নন, ছিলেন এক সাহসী প্রতিরোধের কণ্ঠ। তার লেখা দিয়ে সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন। তার কবিতা, সংগীত ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড- সবকিছুই প্রগাঢ় জাতীয়তাবোধ, প্রেম এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে লেখালেখির আগ্রহ ছিল। স্কুলজীবনে লেখালেখি শুরু। পরে তা হয়ে ওঠে জীবনের প্রধান দিক। তার কবিতা কখনোই শুধু সৌন্দর্য বিচারের জন্য ছিল না; বরং হয়ে উঠেছিল জাতীয় জীবনের কঠিন সত্যের প্রতিবাদ। দেশের বাস্তবতা অবলোকন করে চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতেন; যা তাকে সাধারণ থেকে আলাদা করেছিল। এ বিষয় নিয়েই এবারের সাহিত্য পাতার প্রধান ফিচার
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কাটে ঢাকায়। শিক্ষাজীবনে রুদ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
রুদ্রের কবিতা, তার সাহিত্য সৃষ্টি আমাদের সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর গভীর অনুসন্ধান। ১৯৭৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’ প্রকাশিত হয়; যা তার সাহিত্যিক যাত্রার মাইলফলক। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১), মানুষের মানচিত্র (১৯৮৩), ছোবল (১৯৮৪), গল্প (১৯৮৫), দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৬), মৌলিক মুখোশ (১৯৮৮), রাজনৈতিক কবিতা (১৯৮৯)। তার কবিতায় উঠে এসেছে বর্ণবাদ, ধর্মীয় উগ্রতা, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সামাজিক অস্থিরতার মতো বহু সমস্যা।
রুদ্র কখনোই রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আপস করেননি, বরং সমাজের প্রতি তার দৃঢ় প্রতিবাদে কবিতা হয়ে ওঠে শক্তিশালী মাধ্যম। তার কবিতায় যে দ্রোহ ও প্রতিবাদ ছিল, তা সর্বশক্তি দিয়ে কবিতায় ফুটে উঠেছে। তার কবিতা কখনো কখনো রক্তাক্ত, শোকাহত কিন্তু এক ধরনের শক্তিশালী প্রতিবাদও। তার কবিতায় দেশপ্রেম, স্বাধীনতা এবং জনগণের অধিকার নিয়ে লিখেছেন। যা তাকে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দিয়েছে। তার কবিতার মধ্যে যে ধরনের তীব্র কণ্ঠের প্রতিবাদ ছিল, তা গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যধারার প্রতিনিধিত্ব করেছে।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ শুধু কবি ছিলেন না, একজন সমাজসচেতন ও সংস্কৃতিপ্রেমীও ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবি পরিষদ গঠন করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল কবিদের একত্রিত করা এবং তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্যিক সংলাপ সৃষ্টি করা। তিনি মনে করতেন, কবিরা যদি একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারেন এবং একত্র হতে পারেন। তবে তারা সমাজে আরও শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারবেন। এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে তিনি ‘অন্তরও বাজাও’ নামের একটি সংগীত দল গঠন করেন। যেখানে কবিতা এবং সংগীতের সমন্বয়ে নতুন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। তার সংগীত দলটি ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ; যা বাঙালি সংস্কৃতির সঠিক অর্থ এবং মূল্যবোধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাটকীয় পরিবর্তনের শিকার হয়। গণতন্ত্রহীন অবস্থায়, জাতির অন্ধকার সময়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তার কবিতার মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তার কবিতায় উঠে আসে সেই সময়ে দেশবাসীর ভোগান্তি, কষ্ট, শোষণ এবং নিপীড়ন। ‘ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি’ কিংবা ‘রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে সে আমার ভাই’—এ ধরনের ভয়াবহ চিত্র তার কবিতায় ছিল; যা গভীর শোক এবং ক্ষোভের প্রকাশ। তিনি ছিলেন সেই কবি- যিনি কোনো ধরনের মেকি সৌন্দর্যকে অস্বীকার করতেন। যে কোনো পরিস্থিতির কঠিন বাস্তবতা দেখিয়ে দিতেন। তার কবিতা ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক হাতিয়ার। তবে এই শোকের মধ্যে ছিল এক অদম্য ভালোবাসা, যে ভালোবাসা তার প্রতি জাতীয়তাবোধ এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রবাহিত করেছিল।
১৯৯১ সালের ২১ জুন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাদের শোকাহত রেখে প্রয়াত হন। তার সাহিত্য, সংগীত এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। তার লেখার মধ্য দিয়ে যে দ্রোহ, প্রেম এবং প্রতিবাদের সশক্ত ভাষা পাওয়া যায়, তা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। তার প্রস্থান সত্ত্বেও তার কবিতাগুলো এখনো আমাদের চিন্তা ও অনুভূতিকে উদ্দীপ্ত করে।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আজও আমাদের মনে জীবিত, তার সাহসী কণ্ঠস্বর আমাদের মনে অমলিন হয়ে আছে। রুদ্রের কবিতার মধ্যে যে অটুট সংগ্রাম ছিল, তা আমাদের জীবনের প্রতি গভীর মনোযোগ ও সচেতনতার পথ দেখায়। তার সাহিত্য আমাদের মনে একটি প্রশ্ন রেখে যায়: সত্যিই কি আমরা সমাজ ও জীবনের সঠিক পথে আছি?
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ