সৈকত মল্লিক : শোনেন, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আমার মনে হয়, এই সরকার চাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিকঠাক হোক। আমার বিশ্বাস তারা ব্যাপক চেষ্টাও করছে। কিন্তু যাদের দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা ঠিকঠাকের কাজ করবে; যে বাহিনীগুলো দিয়ে, বিশেষত পুলিশ বাহিনী। তারা তো কনফিডেন্স পাচ্ছেন না, তাদের মন খারাপ, তারা ভীত, এমনকি হয়তো ট্রমাটাইজডও। হবেই বা না কেন? যে বাহিনী সরাসরি নিজ দেশের নিজস্ব জনগণকে গুলি করে হত্যা করেছে, হাজারো ছাত্র-জনতাকে খুন করেছে, ১৮ হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত করেছে, পঙ্গু করেছে, অন্ধ করেছে! তারা তো ট্রমাটাইজড হবেই, তারা তো গ্লানিতে ভুগবেই, ভয় তো পাবেই। তারা এমনকি নতুন সরকারের আমলে বিপদেই আছে! তাদের সংসার চালানোও এখন কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়! কেন?
ধরা যাক, একজন পুলিশ সদস্যের (মাঝারি লেবেলের) বেতন সব মিলে ৩০ হাজার কিংবা ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা তাদের বেতনের চাইতে বেশি টাকা বাসা ভাড়া দেয়, তাদের নিয়মিত বেতন ব্যাংক থেকে হয়তো তোলেন না। অন্যান্য কামাই- মানে যেগুলোকে আমরা ঘুষ-দুর্নীতি বলি। গ্রেফতার-বাণিজ্য, মামলা-বাণিজ্য, হুমকি-বাণিজ্য ইত্যাদি ইত্যাদির আয় দিয়েই তার সংসার-আরাম-আয়েস-বিলাস হয়ে যেতো অনায়াসে। এই মাধ্যমগুলো তো এখন আর নেই; বলা ভালো আপাতত নাই। এখন এই নতুন পরিস্থিতিতে বেচারা বাসা ভাড়া কীভাবে দিবে, বাচ্চার দামী স্কুলের বেতন কীভাবে দিবে? বিপদ না! এই চাপে তো তার এখন আর ‘ভালো লাগে না’, রাস্তার মোড়ে বা থানায় বসে চিন্তামগ্ন থাকে; দেখে মনে হয় ঝিমাচ্ছেন; বাট তারা আসলে কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন- সেটা ভাবেন। বিপদ আরও আছে…!
সে এক বছর আগে ২০ লাখ টাকা কিংবা ৩০ লাখ টাকা কিংবা ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে পুলিশের চাকরিটা নিয়েছেন। এখন যাকে ঘুষ দিয়েছেন সে এখন পলাতক হলেও যার কাছ থেকে ধার করে ঘুষের টাকা জোগাড় করেছিলেন সে তো তার চাপ অব্যাহত রাখছে। কিংবা বাপের জমিটুকু বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়েছিলেন, সে জমিও উদ্ধার করতে পারছে না। আশা ছিল, কিছু দিনের মধ্যেই টাকা তুলে ফেলবেন বিভিন্ন কায়দায়। কিন্তু এখন? এখন সে কী করবে?
আবার শেখ হাসিনার পক্ষে লড়তে গিয়ে, ক্ষমতার ছায়া আরও একটু বেশি পাওয়ার আশায় আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সে যে পরিমাণ নৃশংসতা করেছে, খুন করেছে; সেটারও একটা আফটার ইফেক্ট আছে, একটা ট্রমা আছে। কারণ জনগণ টের পেয়েছে যে পুলিশই অন্যতম প্রধান অস্ত্র ছিল শেখ হাসিনার। জনগণের মধ্যে যেতে এখন সে ভয় পায়, রাতের বেলা সে একা বের হয় না, সে ডিউটি করার সময়ও খুবই চাপে থাকে। ‘কিছুই বলে না, কিছুই করে না’- টাইপ অবস্থা। তার যে নরমাল দায়িত্ব সেটাও সে পালন করতে পারছে না। কারণ জনগণকে চরম ভয় পেতে শুরু করেছে। শহীদ পরিবারগুলো যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন, যদি আহত সন্তানের পিতা-মাতা রাস্তা-ঘাটে তার হাতে কামড় দেয়! ওরা ঘুমাতে পারেন না শান্তিতে। ওরা ডিউটি করবেন কীভাবে?
তাইলে সরকার এখন কী করবে? কী করা যায়? সমাধান কী? ‘ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশান তো ঠিক করতে হবে?
১. পুলিশের সব সদস্যই একই রকমভাবে ফ্যাসিস্ট শোষণের তাবেদার ছিল না। হুকুম ক্যারি করা আর স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে অ্যাকশানে যাওয়া এক ব্যাপার নয়। এটা বিবেচনায় নিয়ে বাহিনীতে চিরুনী অভিযান চালানো দরকার। যাতে সৎ ও নিরপেক্ষ পুলিশ সদস্য সামনে আসতে পারে কনফিডেন্টলি।
২. দুর্নীতিগ্রস্থ, হামলায়-খুনে সরাসরি যুক্তদেরকে চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে হুকুমদাতাদের পরিচয় বের করে হুকুমদাতাদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যাতে তারাও রিলিফ পেতে পারেন।
৩. নিয়োগ-বদলির সময় কাকে, কী পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়েছে- তার হিসেব সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্টদের নাম পরিচয় জনগণের সামনে প্রকাশ করা দরকার। তাইলে অটোমেটিক্যালি একটা তালিকা পেয়ে যাবেন। এবং সেই অর্থ উদ্ধার করে ওই পুলিশ সদস্যদের ঋণ থাকলে তা শোধ করা দরকার, যাতে সে আর্থিক চাপমুক্ত হতে পারে। আর বাকি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যোগ করা দরকার। তাহলে ঘুষখোরদের নাম-পরিচয়টাও মানুষ জানতে পারবে ও তারা সমাজে সেইভাবেই গণ্য হবে, যা ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে।
৪. গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত ছাত্র-জনতাকে কমিউনিটি পুলিশিং এর সঙ্গে যুক্ত করে সমাজের সাথে রাষ্ট্রের ব্রিজ তৈরি করা দরকার আশু। এবং সরাসরি ছাত্র-জনতাকে খুন করা ও ব্যাপক দুর্নীতির সাথে যুক্ত হুকুমদাতা অফিসারদের বিচার ও টারমিনেট করে, ওই পদগুলোতে সৎ ও সক্রিয়দের পাদায়ন করা দরকার। যারা তখন কনফিডেন্টলি কাজ করবে।
৫. পুলিশ সদস্যদেরকে সরকারি উদ্যোগে কাউন্সেলিং করা দরকার, তাদের কাজটা যে কত বড় এবং দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা তাদেরকে অনুধাবন করানো দরকার।
৬. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা দরকার। যাতে পুলিশ বাহিনী দলীয় চাপের বাইরে স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিককে সমানভাবে ট্রিট করতে পারে। এবং নিয়োগ-পদোন্নতি কোনও ক্ষেত্রেই যেন দলীয় কোনও ভূমিকা না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখবেন, ম্যাজিকের মতো কাজ করছে।
পরিশেষে বলি, বাংলাদেশের মানুষের সম্ভাবনা বিশাল। তাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে একটা গণতান্ত্রিক সিস্টেম দরকার। ভয়হীন পরিবেশ দরকার। যোগ্যদের কদর করা দরকার, সুযোগের সমবন্টন দরকার যাতে সকল নাগরিকের ইন্ডিভিজুয়াল যোগ্যতাগুলো এক হয়ে ‘জাতীয় যোগ্যতা’ অর্জিত হতে পারে। ইনক্লুসিভ সমাজ গঠনের এখনই সময়।
লেখক: রাজনৈতিক ও শ্রমিক অধিকারকর্মী