লে. কর্নেল খন্দকার মাহমুদ হোসেন : আমরা প্রায়ই ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘আবাধ স্বাধীনতা’ এই দুটি শব্দ ব্যবহার করে থাকি এবং এর যে কোনো একটি বা উভয়ই পাওয়ার জন্য দাবি করে থাকি। এই বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
মানুষ জন্মসূত্রে স্বাধীন—এটি একটি বহু উচ্চারিত সত্য। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, স্বাধীনতা মানে কি সবকিছু করার অবাধ অধিকার? নাকি স্বাধীনতারও থাকে নির্দিষ্ট সীমানা, দায়িত্ব ও কর্তব্য? এই দ্বন্দ্বেই নিহিত রয়েছে স্বাধীনতা ও অবাধ স্বাধীনতার মৌলিক পার্থক্য।
স্বাধীনতা (ঋৎববফড়স): স্বাধীনতা হল এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তি নিজ চিন্তা, মত, বাক, কর্ম, ধর্ম ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রাখে, তবে সেতা যেন সামাজিক, নৈতিক ও আইনি সীমার মধ্যে থেকে [(ঋৎববফড়স রং ঃযব ঢ়ড়বিৎ ড়ৎ ৎরমযঃ ঃড় ধপঃ, ংঢ়বধশ, ড়ৎ ঃযরহশ ধং ড়হব ধিহঃং রিঃযড়ঁঃ যরহফৎধহপব ড়ৎ ৎবংঃৎধরহঃ, নঁঃ রিঃযরহ ঃযব নড়ঁহফং ড়ভ ষধি ধহফ ৎবংঢ়বপঃ ভড়ৎ ড়ঃযবৎং. (ঙীভড়ৎফ ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু)]।
অবাধ স্বাধীনতা (অনংড়ষঁঃব ঋৎববফড়স): অবাধ স্বাধীনতা হল এমন এক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি কোনো নিয়ম, সীমা বা দায়িত্ব ছাড়াই যেকোনো কিছু করার অধিকার দাবি করে। এতে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ বা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে [(অনংড়ষঁঃব ভৎববফড়স রং ঃযব ধনংবহপব ড়ভ ধষষ পড়হংঃৎধরহঃং, ধষষড়রিহম রহফরারফঁধষং ঃড় ফড় ধং ঃযবু রিংয, ৎবমধৎফষবংং ড়ভ রঃং রসঢ়ধপঃ ড়হ ড়ঃযবৎং ড়ৎ ঃযব ংড়পরধষ ড়ৎফবৎ- ঔবধহ-ঔধপয়ঁবং জড়ঁংংবধঁ (রহ ঃযব পড়হঃবীঃ ড়ভ ‘ঝড়পরধষ ঈড়হঃৎধপঃ ঞযবড়ৎু’)] ।
ঔড়যহ ঝঃঁধৎঃ গরষষ তার বই ঙহ খরনবৎঃু-এ বলেন, ঞযব ষরনবৎঃু ড়ভ ঃযব রহফরারফঁধষ সঁংঃ নব ঃযঁং ভধৎ ষরসরঃবফ; যব সঁংঃ হড়ঃ সধশব যরসংবষভ ধ হঁরংধহপব ঃড় ড়ঃযবৎং. অর্থাৎ ব্যক্তির স্বাধীনতা যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের ক্ষতি না করে, ততক্ষণই তা গ্রহণযোগ্য।
ঔবধহ-ঔধপয়ঁবং জড়ঁংংবধঁ তার ঞযব ঝড়পরধষ ঈড়হঃৎধপঃ এ বলেন, গধহ রং নড়ৎহ ভৎবব, ধহফ বাবৎুযিবৎব যব রং রহ পযধরহং. অর্থাৎ মানুষ স্বাধীন জন্মালেও সামাজিক জীবনে টিকে থাকতে হলে তাকে কিছু নিয়ম মানতেই হয়। এই ‘চেইন’ বা শৃঙ্খল আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা—যা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলার মাঝে পরিচালিত রাখে।
ওংধরধয ইবৎষরহ তার দ্বৈত স্বাধীনতার তত্ত্বে (চড়ংরঃরাব ধহফ ঘবমধঃরাব খরনবৎঃু) বোঝান যে, ঘবমধঃরাব ষরনবৎঃু হলো বাধাহীনতা (ঙনংঃধপষব-ভৎবব ঈড়হফরঃরড়হ)। চড়ংরঃরাব ষরনবৎঃু হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ ও যুক্তিবোধের মাধ্যমে স্বাধীনতা চর্চা। এই ধারণা থেকেই বোঝা যায়, স্বাধীনতা মানে কেবল বাধাহীন চলাচল নয়, বরং নিজেকে যুক্তি, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের অধীনে পরিচালনা করাও একটি বড় স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ- যখন তা ব্যক্তিকে নিজের বিকাশে সহায়তা করে এবং সমাজে শান্তি, সহনশীলতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। পক্ষান্তরে, অবাধ স্বাধীনতা ব্যক্তি ও সমাজ—দু’টির জন্যই ক্ষতিকর। আধুনিক সমাজে যখন অধিকারের নামে দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে, তখন প্রয়োজন দায়িত্ববান স্বাধীনতা চর্চা। কারণ, যেখানে সীমা নেই, সেখানে শৃঙ্খলা নেই। আর যেখানে শৃঙ্খলা নেই, সেখানে প্রকৃত স্বাধীনতাও নেই।
স্বল্প পরিসরে স্বাধীনতা হলো একটি নিয়ন্ত্রিত, সচেতন ও দায়িত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাধীনতায় ব্যক্তি নিজের মত করে চিন্তা, মত প্রকাশ, চলাফেরা, কাজকর্ম করতে পারে, তবে তা আইন, নৈতিকতা এবং সামাজিক নিয়মের ভিতরে থেকে যা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে না। যেমন- আমি স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি, তবে তা কারও অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে নয়।
অন্যদিকে অবাধ স্বাধীনতা হলো এটা এমন স্বাধীনতা যেখানে কোনো নিয়ম-কানুন, বাধা, দায়িত্ববোধ বা সীমারেখা নেই। এই ধরনের স্বাধীনতা দায়িত্বহীনতা, বিশৃঙ্খলা, এমনকি অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সৃষ্টি করে। এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যেমন, আমি যা খুশি বলব, যেটা ইচ্ছে করব, অন্য কেউ কিছু বলার অধিকার রাখে না – এই চিন্তা অবাধ স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি।
অবাধ স্বাধীনতার অসুবিধা বা ঝুঁকি: সীমাহীন স্বাধীনতা অনেক সময় অন্যের অধিকার লঙ্ঘনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা অমান্য করার প্রবণতা দেখা যেতে পারে। যখন সবাই নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করে, তখন সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হয়। বেশি স্বাধীনতায় মানুষ কেবল নিজের কথা ভাবতে শুরু করে, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ কমে যায়।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট: আজকের বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে সেটা গত ১৬ বছরে একেবারে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক সময় এই স্বাধীনতার অপব্যবহার হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসভ্যভাবে, বিভ্রান্তিকর বা উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে, চরিত্র হনন হচ্ছে, যার ফলে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। ফেসবুক বা ইউটিউবে কোনো মত প্রকাশের সময় অনেকেই শালীনতা বা তথ্যভিত্তিক যুক্তির বদলে ব্যক্তি আক্রমণ ও গুজব ছড়িয়ে দেন। এটি স্পষ্টতই অবাধ স্বাধীনতার চর্চা, যা ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। কিন্তু অনেক সময় কিছু ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র ‘আমিই সত্য বা আমরাই ঠিক’—এই মনোভাব পোষণ করে, যার ফলে অন্যদের এবং বিরোধীদলের কথা বলার স্বাধীনতা খর্ব হয়। আবার কিছু সময় বিরোধী পক্ষ নিজেদের অবাধ অধিকার দাবি করে সহিংসতা, অবরোধ বা সরকারি সম্পদ বিনষ্টের মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার পাশাপাশি মত প্রকাশের একটা বিরাট ক্ষেত্র। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অনেক সময় ছাত্র রাজনীতি অবাধ স্বাধীনতার রূপ নেয়; যেখানে একটি গ্রুপ অন্য গ্রুপের মত প্রকাশের অধিকার দমন করে, এমনকি শারীরিক নির্যাতন ও দখলদারিত্বের মাধ্যমে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করে; বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর পরই কিছু ছাত্রগোষ্ঠীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ- দখলদারিত্ব, প্রতিহিংসামূলক কার্যক্রম, ক্ষমতার অপব্যবহার (গধংং ঔঁংঃরপব); উদ্বেগের বিষয়।আন্দোলন হচ্ছে অন্যায়ের প্রতিবাদ, অধিকার আদায়ের পদ্ধতিগত প্রয়াস। এটি যদি পরবর্তীতে ক্ষমতা প্রদর্শনের বাহন হয়ে ওঠে, তাহলে তার প্রাথমিক নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, যে আন্দোলন শৃঙ্খলা ভাঙে, সে আন্দোলন একদিন নিজের নীতিকেও ভাঙে।
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম মুক্ত হলেও অনেক সময় কিছু গণমাধ্যম বা সাংবাদিক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্টতা, গুজব ছড়ানো বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার করে থাকেন। আবার কখনো প্রেস ফ্রিডম হুমকির মুখেও পড়ে। এই দ্বৈত অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে—স্বাধীনতা কি নিরপেক্ষতা ও সত্য বলার সাহসের নাম, নাকি ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ?
বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে কটূক্তি কিংবা সহিংস উসকানি মাঝে মধ্যে দেখা যায়। কেউ কেউ ধর্মের নামে অতিরিক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবি তুলে বিভাজনমূলক বক্তব্য প্রচার করেন। আবার কেউ কেউ ধর্মের সমালোচনার নামে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। দুই ধরনের চর্চাই অবাধ স্বাধীনতার উদাহরণ; যা পারস্পরিক সহাবস্থানের পরিপন্থী।
যে সৎ, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, যে দেশকে ভালোবাসে, যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল- সে কখনই অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী থাকতে পারে না। সে সরকারি সম্পদ ধ্বংস করতে পারে না, উল্টোপথে গাড়ি চালতে পারে না, কালোবাজারি করতে পারে না, অতি মুনাফা করে না। জনগণের জন্য ব্যবহারযোগ্য স্থাপনা, রাস্তা, ফুটপাথ দখল করতে পারে না। স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র কখনই এমন শিক্ষা দেয় না।
স্বাধীনতা মানুষের স্বাভাবিক অধিকার- এ কথা যেমন সত্য; তেমনি এটাও সত্য যে, এই স্বাধীনতা কখনোই দায়িত্ব ও শৃঙ্খলার বাইরে থাকতে পারে না। একে যথাযথভাবে রক্ষা ও চর্চা করতে হলে দরকার আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা টেকসই ও কল্যাণকর করতে হলে নাগরিকদের চর্চা করতে হবে দায়িত্ববান ও নৈতিক স্বাধীনতা।
যখন মতপ্রকাশ, আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচি অবাধ স্বাধীনতার রূপ নেয়, তখন তা ব্যক্তি ও সমাজ- উভয়ের জন্যই হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যেন কখনোই ভুলে না যাই যে, ‘অধিকার’ ও ‘কর্তব্য’ একে অপরের পরিপূরক। যতদিন ব্যক্তি নিজের স্বাধীনতা চর্চার সময় অন্যের অধিকার ও সমাজের শৃঙ্খলাকে সম্মান করবে, ততদিনই স্বাধীনতা হবে অর্থবহ, প্রগতিশীল এবং সুন্দর ভবিষ্যতের পথে সহায়ক। অন্যথায় অবাধ স্বাধীনতা শুধু অরাজকতাই ডেকে আনবে; যা ব্যক্তি ও জাতির উন্নতির পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা