ঢাকা ০২:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫

স্বস্তিহীন বস্তি জীবন

  • আপডেট সময় : ১১:১৫:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১
  • ১০০ বার পড়া হয়েছে

হানগর প্রতিবেদন ঃ নোংরা-আবর্জনার মধ্যে গাদাগাদি করে বসবাস। এক ঘরেই ঠিকানা ছেলে-মেয়ে-ছেলের বউ, নাতি-নাতনির। অবৈধ পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে চলে নিত্যদিনের কারবার। এর জন্য আবার গুনতে হয় মাসে হাজার টাকা। শৌচাগারের সংকট তীব্র। দেড়শ পরিবারের জন্য বরাদ্দ মাত্র পাঁচটি শৌচাগার। অনেক সময় শৌচাগারের পানি গড়িয়ে আসে ঘরে। এতে রোগাক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এভাবেই অস্বস্তি নিয়ে বসবাস করছে ঢাকার বস্তিবাসী।
গতকাল রোববার রাজধানী মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ের ৭০৭ নম্বর বস্তিতে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখে একটি সংবাদসংস্থা বিস্তারিত তুলে ধরেছে এক প্রতিবেদনে। এই বস্তিতে গত ৪০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বাস করছেন হেলেনা বেগম। তিনি জানান, গত ৪০ বছর ধরে নিজ খরচে বস্তিতে ঘর তৈরি করে পরিবার নিয়ে থাকছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ ছয়জন বসবাস করেন। বস্তিতে ঘর ভাড়া দিতে না হলেও অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানির জন্য মাসে এক হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়।
‘ছোট একটা ঘরে আমগো ছয়জনের থাকতে হয়। রাতের বেলায় ঘরের মধ্যে নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়ে যায়। তার উপর বস্তির চিপা গলিতে চলাফেরা করা অনেক কঠিন। নিয়মিত পানি ও বিদ্যুৎ বিল দিলেও সব সময় এ সুবিধা পাওয়া যায় না। পাঁচটা শৌচাগার দেড়শ পরিবারকে ব্যবহার করতে হয়। অনেক কষ্টের মধ্যে বস্তিতে থাকতে হয়।’
এই বস্তিতে আরেক ঘরে থাকেন রাজিয়া বেগম। গত চার বছর আগের স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে ও ছেলের বউসহ নাতি-নাতনি নিয়ে একটি ঘরে বসবাস করেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনো মতে জীবন যাপন করলেও এখানে শৌচাগার সমস্যা খুবই তীব্র। দেড়শ পরিবারের জন্য পাঁচটি শৌচাগার নির্ধারিত। সেগুলো আবার অনেকটা ভাঙাচোরা। কষ্ট করে সেগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত শৌচাগার ব্যবহার নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। শৌচাগারে ব্যবহৃত পানি গড়িয়ে অনেক ঘরে প্রবেশ করায় ছোট-বড় সবার রোগ-ব্যাধি লেগেই থাকে। এই বৃদ্ধা আরও জানান, পরিবারের আয়ের যোগান দেন তার ছেলে। তার উপার্জনে পুরো পরিবার চলে। সে কারণে ভালো একটি বাসা ভাড়া নেওয়ার সামর্থ্য হয় না বলে বস্তিতে থাকছেন। তিনি বলেন, বস্তিতে ঘর ভাড়া লাগে না, পানি ও বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। প্রতিদিন পানির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। এখানেও প্রতিদিন ঝগড়া লাগে। কার আগে কেডা পানি লইবো এইটা নিয়া ঝগড়া বিবাদ হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৪০ বছর ধরে সরকারি এই জায়গায় বস্তি বানিয়ে নি¤œআয়ের মানুষ বসবাস করছেন। অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগের মাধ্যমে কোনো মতে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। এ বস্তিতে ১৩৪টি ঘর থাকার কথা থাকলেও সেখানে ১৪৪টি ঘর গড়ে তোলা হয়েছে। এতে প্রায় এক হাজার মানুষ বসবাস করছেন। নোংরা-আবর্জনা ও বদ্ধ স্থানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠছে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এ বস্তিতে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হচ্ছে। বিভিন্ন মহলে মাসোহারা দিয়ে বস্তিতে বসবাসকারী কিছু বখাটে নিয়মিত মাদকদ্রব্যের কারবার করে। বস্তির অনেকে সে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। বাইরের লোকজন এসে এখান থেকে মাদক কিনছেন বলে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ জানানো হয়।
জনতা হাউজিং বস্তিতে পিয়ারা বেগম স্বামী ছাড়া তার তিন সন্তানকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, বস্তির সঙ্গে মেইন রাস্তা হওয়ায় ছোট পোলাপানরা বাহির হইতে পারে না। ঘরের মধ্যে তাগরে সারাদিন বন্দি থাকতে হয়। গত একমাস আগে তার এক বছরের বাচ্চা ঘর থেকে একা একা বের হয়ে রাস্তায় বের হওয়ায় চলাচলরত একটি সিএনজি অটোরিকশায় ধাক্কা লেগে আহত হয়। শিশু হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসার পরে সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, আমগো জীবনের কোনো দাম নাই, পোলাপান মানুষ করতে পারি না। বস্তির মধ্যে মাদক ও সন্ত্রাসী কাজ হওয়ায় দিনরাত ভয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় মাদক কেনাবেচা নিয়ে সংঘাত লেগে যায়। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মো. মোস্তাফিজুর রহমান রোববার বলেন, জনতা হাউজিং বস্তিতে মাদক বিক্রির অপরাধে আমরা বিভিন্ন সময়ে একাধিক জনকে আটক করে জেলহাজতে পাঠিয়েছি। বর্তমানে সেখানে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে না। এরপরও যদি কেউ এ ধরনের কাজ করে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

স্বস্তিহীন বস্তি জীবন

আপডেট সময় : ১১:১৫:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১

হানগর প্রতিবেদন ঃ নোংরা-আবর্জনার মধ্যে গাদাগাদি করে বসবাস। এক ঘরেই ঠিকানা ছেলে-মেয়ে-ছেলের বউ, নাতি-নাতনির। অবৈধ পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে চলে নিত্যদিনের কারবার। এর জন্য আবার গুনতে হয় মাসে হাজার টাকা। শৌচাগারের সংকট তীব্র। দেড়শ পরিবারের জন্য বরাদ্দ মাত্র পাঁচটি শৌচাগার। অনেক সময় শৌচাগারের পানি গড়িয়ে আসে ঘরে। এতে রোগাক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এভাবেই অস্বস্তি নিয়ে বসবাস করছে ঢাকার বস্তিবাসী।
গতকাল রোববার রাজধানী মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ের ৭০৭ নম্বর বস্তিতে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখে একটি সংবাদসংস্থা বিস্তারিত তুলে ধরেছে এক প্রতিবেদনে। এই বস্তিতে গত ৪০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বাস করছেন হেলেনা বেগম। তিনি জানান, গত ৪০ বছর ধরে নিজ খরচে বস্তিতে ঘর তৈরি করে পরিবার নিয়ে থাকছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ ছয়জন বসবাস করেন। বস্তিতে ঘর ভাড়া দিতে না হলেও অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানির জন্য মাসে এক হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়।
‘ছোট একটা ঘরে আমগো ছয়জনের থাকতে হয়। রাতের বেলায় ঘরের মধ্যে নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়ে যায়। তার উপর বস্তির চিপা গলিতে চলাফেরা করা অনেক কঠিন। নিয়মিত পানি ও বিদ্যুৎ বিল দিলেও সব সময় এ সুবিধা পাওয়া যায় না। পাঁচটা শৌচাগার দেড়শ পরিবারকে ব্যবহার করতে হয়। অনেক কষ্টের মধ্যে বস্তিতে থাকতে হয়।’
এই বস্তিতে আরেক ঘরে থাকেন রাজিয়া বেগম। গত চার বছর আগের স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে ও ছেলের বউসহ নাতি-নাতনি নিয়ে একটি ঘরে বসবাস করেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনো মতে জীবন যাপন করলেও এখানে শৌচাগার সমস্যা খুবই তীব্র। দেড়শ পরিবারের জন্য পাঁচটি শৌচাগার নির্ধারিত। সেগুলো আবার অনেকটা ভাঙাচোরা। কষ্ট করে সেগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত শৌচাগার ব্যবহার নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। শৌচাগারে ব্যবহৃত পানি গড়িয়ে অনেক ঘরে প্রবেশ করায় ছোট-বড় সবার রোগ-ব্যাধি লেগেই থাকে। এই বৃদ্ধা আরও জানান, পরিবারের আয়ের যোগান দেন তার ছেলে। তার উপার্জনে পুরো পরিবার চলে। সে কারণে ভালো একটি বাসা ভাড়া নেওয়ার সামর্থ্য হয় না বলে বস্তিতে থাকছেন। তিনি বলেন, বস্তিতে ঘর ভাড়া লাগে না, পানি ও বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। প্রতিদিন পানির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। এখানেও প্রতিদিন ঝগড়া লাগে। কার আগে কেডা পানি লইবো এইটা নিয়া ঝগড়া বিবাদ হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৪০ বছর ধরে সরকারি এই জায়গায় বস্তি বানিয়ে নি¤œআয়ের মানুষ বসবাস করছেন। অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগের মাধ্যমে কোনো মতে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। এ বস্তিতে ১৩৪টি ঘর থাকার কথা থাকলেও সেখানে ১৪৪টি ঘর গড়ে তোলা হয়েছে। এতে প্রায় এক হাজার মানুষ বসবাস করছেন। নোংরা-আবর্জনা ও বদ্ধ স্থানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠছে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এ বস্তিতে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হচ্ছে। বিভিন্ন মহলে মাসোহারা দিয়ে বস্তিতে বসবাসকারী কিছু বখাটে নিয়মিত মাদকদ্রব্যের কারবার করে। বস্তির অনেকে সে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। বাইরের লোকজন এসে এখান থেকে মাদক কিনছেন বলে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ জানানো হয়।
জনতা হাউজিং বস্তিতে পিয়ারা বেগম স্বামী ছাড়া তার তিন সন্তানকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, বস্তির সঙ্গে মেইন রাস্তা হওয়ায় ছোট পোলাপানরা বাহির হইতে পারে না। ঘরের মধ্যে তাগরে সারাদিন বন্দি থাকতে হয়। গত একমাস আগে তার এক বছরের বাচ্চা ঘর থেকে একা একা বের হয়ে রাস্তায় বের হওয়ায় চলাচলরত একটি সিএনজি অটোরিকশায় ধাক্কা লেগে আহত হয়। শিশু হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসার পরে সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, আমগো জীবনের কোনো দাম নাই, পোলাপান মানুষ করতে পারি না। বস্তির মধ্যে মাদক ও সন্ত্রাসী কাজ হওয়ায় দিনরাত ভয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় মাদক কেনাবেচা নিয়ে সংঘাত লেগে যায়। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মো. মোস্তাফিজুর রহমান রোববার বলেন, জনতা হাউজিং বস্তিতে মাদক বিক্রির অপরাধে আমরা বিভিন্ন সময়ে একাধিক জনকে আটক করে জেলহাজতে পাঠিয়েছি। বর্তমানে সেখানে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে না। এরপরও যদি কেউ এ ধরনের কাজ করে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।