ঢাকা ১০:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

স্বর্ণময়ীদের জন্য হোক নারীবান্ধব কর্মস্থল

  • আপডেট সময় : ০৬:৩০:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

আবু আফজাল সালেহ

পরিবার ও কর্মস্থলে নারীদের জন্য অনিরাপদ হওয়া মানেই খুবই বিপজ্জনক অবস্থা। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ নেতিবাচকতার দিকে এগিয়ে। পরিবারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা যেকোনো সুযোগ সুবিধায় পিছিয়ে। শুরু হয় মা-বাবা দিয়েই। খাবারের ধরণে তার প্রমাণ মেলে। ব্যতিক্রম খুব কমই থাকে। এ অবস্থাকে যদি ভয়াভহ না বলা হয় তবে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অপমান, অবহেলা, অপদস্ত কিংবা নির্যাতন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেও পরিবারের পুরুষরাও পাশে থাকে খুব কমই, অন্তত মানসিক দিক থেকে। কেন চাকরি করতে গেল, কেন রাতে বের হতে গেল- ইত্যোকার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এ প্যারোমিটার থেকেই আমরা ধারনা করতে পারি যে, আমরা জাতি হিসাবে অনেক পিছিয়ে কিংবা অন্ধকারে।

বেসরকারি-সরকারি কর্মক্ষেত্রে নারীরা অনেক পিছিয়ে। সংবাদপত্রেও অনেক নারী নিগৃহীত হচ্ছেন, অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ফলে অনেক নারী আত্মহত্যা করতেও দ্বিধা করেন না; যার সর্বশেষ ঘটনার শিকার স্বর্ণময়ী। সংবাদপত্রে তারই সহকর্মী কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে এবং কর্তৃপক্ষ বরাবর ব্যবস্থার আবেদন করেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। পরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এ বিষয়টির প্রতি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি প্রমাণিত হয় তাহলে কঠোর ও অনুকরণীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। এ বিষয়ে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। মূলকথা নারী ও তাদের কর্মস্থলকে নিরাপদ করতে না পারলে আমাদের মঙ্গল নেই।

স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচার দাবি করেছেন ২৪৩ নাগরিক। এ ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, এটি বাংলাদেশের নারীকর্মীদের কর্মপরিবেশের ভয়াবহ বাস্তবতাকে প্রকাশ করে বলেও মনে করেন তারা। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এ ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন। নিন্দা জানানোর আগেই বা ব্যবস্থা নেওয়ার সময় কিংবা তারও আগেই যদি ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তাহলে এমন করুণ ঘটনা ঘটত না বলে আমার বিশ্বাস।

নারীর ঘটনাগুলো চাপা দিতে বাঙালি খুবই সিদ্ধহস্ত। অনেক নারী প্রতারণা কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়েও লজ্জা বা পরবর্তীকালে সমাজে ভিকটিম নারীকেই লজ্জা বা বঞ্চনার শিকার হতে হয়। ফলে কর্মস্থল বা গণপরিবহন কিংবা অন্যত্র সহকর্মী, বস, বন্ধু দ্বারা অনেক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তা আড়ালেই থেকে যায়। বিচারহীনতা এক্ষেত্রে প্রধান দায়ী বলে মনে করা হয়।

কেবল নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে নয়, আমরা সবাই মানবাধিকারের অধিকারী। বিভিন্ন সহিংসতা ও বৈষম্যমুক্ত জীবনযাপনের অধিকার; শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ উপভোগ করার অধিকার; শিক্ষিত হওয়া; সম্পত্তির মালিকানা লাভ করা; ভোটদান করা এবং সমান মজুরি অর্জনের অধিকার নারী ও পুরুষের সমতার কথা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এখনো অনেক নারী ও মেয়ে লিঙ্গ এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। লিঙ্গবৈষম্য অনেক সমস্যার মূল কারণ; যা নারী ও মেয়েদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে। যেমন- পারিবারিক ও যৌন সহিংসতা, কম বেতন, শিক্ষার সুযোগের অভাব, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে- ১৯(১) ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’; ১৯(২) ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’। অনুচ্ছেদ ২৭-এ ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৮ এ ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য নিয়ে কথা বলা হয়েছে- ২৮(১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। ২৮(২)-এ ‘রাষ্ট্র ও গণ জীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’; ২৮(৩)-এ ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিশু থেকে বৃদ্ধ, শহর কিংবা গ্রামে পৈচাশিক নারী নির্যাতন কিংবা নারী ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ক্রমেই অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে দেশ। নারীর অনিরাপদবোধ দেশের স্থিতি কিংবা শান্তির প্যারামিটার বলে দেয়। আছিয়ার মতো নির্যাতিত মেয়ে চোখ খুলতে সাহায্য করছে। কিন্তু ভয়াবহ এ অবস্থা/উপলব্ধি অন্য ইস্যুতে কিছুদিন পরেই হারিয়ে যায়। তনুর কথা প্রায়ই ভুলে গেছি। আছিয়ার ঘটনায় দেশের সবাই কষ্ট পেয়েছে। মুরাদনগরের -ঘটনাও কয়েকদিন পরে ভুলে যাবো আমরা। নারী নির্যাতন, নিগৃহীত, ধর্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন সময়ে জেগে ওঠে নারী। দেশের অর্ধেকের কিছু বেশি নারী। এ-অর্ধেক অবহেলিত থাকলে কিংবা অবহেলিত থাকলে কিংবা নিগৃহীত হলে দেশ সভ্য হবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সভ্যতার প্রধান একটি প্যারামিটার হচ্ছে নারী-নিরাপত্তা, অধিকার ভোগ কিংবা ক্ষমতা ভোগ। ক্ষমতায়নের যুগে নারী, এমনকি শিশু ধর্ষিত হবে, পথে পথে নিগৃহীত হবে কিংবা চলার পথে জীবন ও নিরাপত্তার অন্তরায় থাকবে- সে জাতি সভ্য নয়, সে জাতি উন্নয়নের চরম শিখরে উঠতে পারবে না! বাঙালি নারী সবসময়েই অবহেলিত, সব সময়েই নিরাপত্তার ঝুঁকিতে-নিজের বাড়ি থেকে আত্মীয় বাড়ি, নিজ সমাজ থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে, খাবার কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্তরে। মাঝেমধ্যেই (প্রায়ই) ধর্ষণ পত্রিকা ও মানুষের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে যায়।

গণপরিবহনে নারীকে নিরাপত্তা দিতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুরক্ষা দিতে হবে। পুরুষ হিসাবে নারীর হাত ধরে পাশাপাশি চলতে দেওয়ার পরিবেশ তৈরিতে আমাদেরকেই হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বাস-ট্রেন কিংবা পরিবহনে, সড়ক কিংবা বাজারে, কর্মক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা দিতে হবে। এজন্য ধর্মীয় নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বকে ইতিবাচক এগিয়ে আসতে হবে। আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। নারীকে সুরক্ষা দিতেই হবে। নারীকে সুরক্ষা না-দিতে পারলে দেশ কিংবা সমাজের মুক্তি নেই। আমাদের মনে গেঁথে রাখতে হবে- (১) নারীর অধিকার মানেই তা মানবধিকার ও মৌলিক অধিকার; (২) নারীকে সুরক্ষা দিতে পারলে উন্নততর রাষ্ট্র উপহার দেওয়া যাবে; (৩) নারী ও পুরুষ একত্রে স্বাচ্ছন্দে ও নিরাপদ বোধ করলে সামগ্রিক উন্নয়ন শক্তিশালী হবে। এসব বাস্তবায়ন করতে হলে নারীর যাতায়াত ও কর্মক্ষেত্র নিরাপদ করতে হবে। রাষ্ট্রকেই প্রথম/প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে। নারীর সুরক্ষা দিতে অধিকতর কঠোর হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

উন্নত জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে হলে নারী ও তাদের পরিবেশ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবেই। যেসব আইন আছে সেগুলো যথার্থ বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্মস্থলে নারী নির্যাতন বা বঞ্চনার শিকার হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব বিষয়ে শৈথিল্যপ্রদর্শন করা যাবে না। নারীদের জন্য সমাজকে নিরাপদ করতে হবে। কর্মস্থল, গণপরিবহণ কিংবা নারীর প্রবেশাধিকার যেখানে আছে যেখানে নারীবান্ধব পরিবেশ গ্রহণ তৈরি করতে হবে। সহকর্মী কিংবা বস কর্তৃক নিগৃহীত হলে দ্বিগুণ শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। জাতিকে মুক্তির জন্য এসব চিন্তাভাবনা গ্রহণের বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

স্বর্ণময়ীদের জন্য হোক নারীবান্ধব কর্মস্থল

আপডেট সময় : ০৬:৩০:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

আবু আফজাল সালেহ

পরিবার ও কর্মস্থলে নারীদের জন্য অনিরাপদ হওয়া মানেই খুবই বিপজ্জনক অবস্থা। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ নেতিবাচকতার দিকে এগিয়ে। পরিবারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা যেকোনো সুযোগ সুবিধায় পিছিয়ে। শুরু হয় মা-বাবা দিয়েই। খাবারের ধরণে তার প্রমাণ মেলে। ব্যতিক্রম খুব কমই থাকে। এ অবস্থাকে যদি ভয়াভহ না বলা হয় তবে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অপমান, অবহেলা, অপদস্ত কিংবা নির্যাতন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেও পরিবারের পুরুষরাও পাশে থাকে খুব কমই, অন্তত মানসিক দিক থেকে। কেন চাকরি করতে গেল, কেন রাতে বের হতে গেল- ইত্যোকার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এ প্যারোমিটার থেকেই আমরা ধারনা করতে পারি যে, আমরা জাতি হিসাবে অনেক পিছিয়ে কিংবা অন্ধকারে।

বেসরকারি-সরকারি কর্মক্ষেত্রে নারীরা অনেক পিছিয়ে। সংবাদপত্রেও অনেক নারী নিগৃহীত হচ্ছেন, অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ফলে অনেক নারী আত্মহত্যা করতেও দ্বিধা করেন না; যার সর্বশেষ ঘটনার শিকার স্বর্ণময়ী। সংবাদপত্রে তারই সহকর্মী কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে এবং কর্তৃপক্ষ বরাবর ব্যবস্থার আবেদন করেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। পরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এ বিষয়টির প্রতি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি প্রমাণিত হয় তাহলে কঠোর ও অনুকরণীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। এ বিষয়ে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। মূলকথা নারী ও তাদের কর্মস্থলকে নিরাপদ করতে না পারলে আমাদের মঙ্গল নেই।

স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচার দাবি করেছেন ২৪৩ নাগরিক। এ ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, এটি বাংলাদেশের নারীকর্মীদের কর্মপরিবেশের ভয়াবহ বাস্তবতাকে প্রকাশ করে বলেও মনে করেন তারা। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এ ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন। নিন্দা জানানোর আগেই বা ব্যবস্থা নেওয়ার সময় কিংবা তারও আগেই যদি ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তাহলে এমন করুণ ঘটনা ঘটত না বলে আমার বিশ্বাস।

নারীর ঘটনাগুলো চাপা দিতে বাঙালি খুবই সিদ্ধহস্ত। অনেক নারী প্রতারণা কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়েও লজ্জা বা পরবর্তীকালে সমাজে ভিকটিম নারীকেই লজ্জা বা বঞ্চনার শিকার হতে হয়। ফলে কর্মস্থল বা গণপরিবহন কিংবা অন্যত্র সহকর্মী, বস, বন্ধু দ্বারা অনেক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তা আড়ালেই থেকে যায়। বিচারহীনতা এক্ষেত্রে প্রধান দায়ী বলে মনে করা হয়।

কেবল নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে নয়, আমরা সবাই মানবাধিকারের অধিকারী। বিভিন্ন সহিংসতা ও বৈষম্যমুক্ত জীবনযাপনের অধিকার; শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ উপভোগ করার অধিকার; শিক্ষিত হওয়া; সম্পত্তির মালিকানা লাভ করা; ভোটদান করা এবং সমান মজুরি অর্জনের অধিকার নারী ও পুরুষের সমতার কথা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এখনো অনেক নারী ও মেয়ে লিঙ্গ এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। লিঙ্গবৈষম্য অনেক সমস্যার মূল কারণ; যা নারী ও মেয়েদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে। যেমন- পারিবারিক ও যৌন সহিংসতা, কম বেতন, শিক্ষার সুযোগের অভাব, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে- ১৯(১) ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’; ১৯(২) ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’। অনুচ্ছেদ ২৭-এ ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৮ এ ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য নিয়ে কথা বলা হয়েছে- ২৮(১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। ২৮(২)-এ ‘রাষ্ট্র ও গণ জীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’; ২৮(৩)-এ ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিশু থেকে বৃদ্ধ, শহর কিংবা গ্রামে পৈচাশিক নারী নির্যাতন কিংবা নারী ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ক্রমেই অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে দেশ। নারীর অনিরাপদবোধ দেশের স্থিতি কিংবা শান্তির প্যারামিটার বলে দেয়। আছিয়ার মতো নির্যাতিত মেয়ে চোখ খুলতে সাহায্য করছে। কিন্তু ভয়াবহ এ অবস্থা/উপলব্ধি অন্য ইস্যুতে কিছুদিন পরেই হারিয়ে যায়। তনুর কথা প্রায়ই ভুলে গেছি। আছিয়ার ঘটনায় দেশের সবাই কষ্ট পেয়েছে। মুরাদনগরের -ঘটনাও কয়েকদিন পরে ভুলে যাবো আমরা। নারী নির্যাতন, নিগৃহীত, ধর্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন সময়ে জেগে ওঠে নারী। দেশের অর্ধেকের কিছু বেশি নারী। এ-অর্ধেক অবহেলিত থাকলে কিংবা অবহেলিত থাকলে কিংবা নিগৃহীত হলে দেশ সভ্য হবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সভ্যতার প্রধান একটি প্যারামিটার হচ্ছে নারী-নিরাপত্তা, অধিকার ভোগ কিংবা ক্ষমতা ভোগ। ক্ষমতায়নের যুগে নারী, এমনকি শিশু ধর্ষিত হবে, পথে পথে নিগৃহীত হবে কিংবা চলার পথে জীবন ও নিরাপত্তার অন্তরায় থাকবে- সে জাতি সভ্য নয়, সে জাতি উন্নয়নের চরম শিখরে উঠতে পারবে না! বাঙালি নারী সবসময়েই অবহেলিত, সব সময়েই নিরাপত্তার ঝুঁকিতে-নিজের বাড়ি থেকে আত্মীয় বাড়ি, নিজ সমাজ থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে, খাবার কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্তরে। মাঝেমধ্যেই (প্রায়ই) ধর্ষণ পত্রিকা ও মানুষের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে যায়।

গণপরিবহনে নারীকে নিরাপত্তা দিতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুরক্ষা দিতে হবে। পুরুষ হিসাবে নারীর হাত ধরে পাশাপাশি চলতে দেওয়ার পরিবেশ তৈরিতে আমাদেরকেই হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বাস-ট্রেন কিংবা পরিবহনে, সড়ক কিংবা বাজারে, কর্মক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা দিতে হবে। এজন্য ধর্মীয় নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বকে ইতিবাচক এগিয়ে আসতে হবে। আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। নারীকে সুরক্ষা দিতেই হবে। নারীকে সুরক্ষা না-দিতে পারলে দেশ কিংবা সমাজের মুক্তি নেই। আমাদের মনে গেঁথে রাখতে হবে- (১) নারীর অধিকার মানেই তা মানবধিকার ও মৌলিক অধিকার; (২) নারীকে সুরক্ষা দিতে পারলে উন্নততর রাষ্ট্র উপহার দেওয়া যাবে; (৩) নারী ও পুরুষ একত্রে স্বাচ্ছন্দে ও নিরাপদ বোধ করলে সামগ্রিক উন্নয়ন শক্তিশালী হবে। এসব বাস্তবায়ন করতে হলে নারীর যাতায়াত ও কর্মক্ষেত্র নিরাপদ করতে হবে। রাষ্ট্রকেই প্রথম/প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে। নারীর সুরক্ষা দিতে অধিকতর কঠোর হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

উন্নত জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে হলে নারী ও তাদের পরিবেশ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবেই। যেসব আইন আছে সেগুলো যথার্থ বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্মস্থলে নারী নির্যাতন বা বঞ্চনার শিকার হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব বিষয়ে শৈথিল্যপ্রদর্শন করা যাবে না। নারীদের জন্য সমাজকে নিরাপদ করতে হবে। কর্মস্থল, গণপরিবহণ কিংবা নারীর প্রবেশাধিকার যেখানে আছে যেখানে নারীবান্ধব পরিবেশ গ্রহণ তৈরি করতে হবে। সহকর্মী কিংবা বস কর্তৃক নিগৃহীত হলে দ্বিগুণ শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। জাতিকে মুক্তির জন্য এসব চিন্তাভাবনা গ্রহণের বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ