ঢাকা ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বপ্ন

  • আপডেট সময় : ১০:৫৮:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ জুন ২০২৩
  • ২৬০ বার পড়া হয়েছে

সাখাওয়াত হোসেন সজীব  : সকাল না হতেই সোলায়মান সাহেবের ঘুম ভাঙলো কানের কাছে জোরে জোরে ইট ভাঙার শব্দ আর সেই সঙ্গে সবজিওয়ালার ডাক শুনে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়! হোয়াইট প্যালেস ভবনের পাশে এসব আওয়াজ শোনা তো দূরের কথা, কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। তিনি চোখ বন্ধ রেখেই কলিং বেলটা টিপ দেওয়ার জন্য খুঁজতে লাগলেন। যেন তার সেক্রেটারি এসে হাজির হয়। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, তিনি খাটের পাশে কোনো কলিং বেল খুঁজে পেলেন না।
এমন সময় তার স্ত্রী জোহরা বানুর আওয়াজ শোনা গেল, ‘কই গো, শুনছো! শুক্রবারের সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল, বাজারে তো যেতে হবে। ফ্রিজ তো একদম খালি। তাড়াতাড়ি নাস্তাটা করে নাও!’
তিনি চোখ খুলে দেখলেন, জোহরা বানু হাতে খুন্তি নিয়ে তার খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘তোমার হাতে খুন্তি কেন, বাবুর্চিরা গেল কই?’
জোহরা বানু এক গাল হেসে বললেন, ‘স্যার, বিয়ের পয়ত্রিশ বছর ধরে আমিই আপনার বাড়ির বাবুর্চি। আমিই বিনা বেতনে কাজের বুয়া। এবার উঠে পড়ুন!’
সোলায়মান সাহেবের এখনো বিস্ময় কাটছে না। তিনি বিশ্বের সেরা ধনী; তার এত বড় হোয়াইট প্যালেস গেল কোথায়? তার এতগুলো চাকর-বাকর, বাবুর্চি সব আজ কোথায় গেল! ভাবতে ভাবতেই জোহরা বানু আবার রান্নাঘর থেকে অনুরোধ করলেন, ‘টেবিলে গরম গরম রুটি দিচ্ছি! খেয়ে তাড়াতাড়ি বাজারে যাও!’
তিনি বাথরুম ঢুকে কয়েকবার চোখে-মুখে পানির ঝাপ্টা দিলেন; স্বপ্ন দেখছে না তো? কই, স্বপ্ন হলে তো এতক্ষণে ভেঙে যেত!
তিনি মুখ মুছতে মুছতে টেবিলের কাছে আসতেই ছেলে সায়েম এসে বলল, ‘বাবা, আমাকে ত্রিশ টাকা দাও; আমার জুতাটা কালি করাতে হবে। কাল সকালে আরেকটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে।’
এবার সোলায়মান সাহেব খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই এখানে কী করিস? তুই না লন্ডনে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলি! দেশে কবে ফিরলি?’
এবার সায়েম হেসে তার মাকে বলে, ‘মা, বাবার মাথা খারাপ হলো নাকি?’
রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে জোহরা বানু জবাব দিলেন, ‘মাথা খারাপ কি না জানি না! তবে গত রাতে খুব ঝাল দিয়ে চটপটি খেয়েছিল। হয়তো তাতেই পেট খারাপ করেছে।’
জোহরা বানু এবার সোলায়মান সাহেবের প্লেটে গরম রুটি রাখতে রাখতে বললেন, ‘সায়েম এদিক সেদিক চাকরি খুঁজতে খুঁজতে একেবারে হয়রান হয়ে পড়ল। তুমি একটু তোমার অফিসের বসের সঙ্গে কথা বলে দেখো না, কোথাও ঢুকিয়ে দিতে পারো কি না?’
সোলায়মান সাহেব মাথা নিচু করে ভাবতে যাবেন, তার সঙ্গে কী হচ্ছে? ঠিক তখনই আবার জোহরা বানু তাড়া দিয়ে উঠলেন, ‘এই নাও বাজারের ব্যাগ! খাওয়া হয়ে গেলে এবার ওঠো। এই নাও কাগজ, কী কী লাগবে তা আমি লিখে দিয়েছি!’
‘ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো’। সোলায়মান সাহেবের মুখে এ কথা শুনতেই জোহরা বানু এবার চোখ-মুখ শক্ত করে বলেন, ‘দেখো, সকাল থেকে অনেক মজা হয়েছে, আর না! এবার যাও।’
সোলায়মান সাহেব নিজের এ পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না। গতকাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা ধনী। তার হুকুমের বাইরে সংসারে কিছুই হতো না। সেখানে আজকে তিনি একটি আধা ময়লা বাজারের ব্যাগ নিয়ে কাঁচা বাজারের উদ্দেশ্যে হাঁটছেন? কেউ তার সঙ্গে কোনো ফাজলামি করছে না তো? কিন্তু তার সঙ্গে দুষ্টুমি করার দুঃসাহস কার আছে?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রাস্তার পানিতে পা পড়ল। পেছনের লোক হেসে বলল, ‘ভাই, রাস্তা কাইটা রাখসে ম্যালা দিন ধইরা। এদিকে ময়লা পানি সয়লাব! লাফ দিয়া ইট দেইখা পার হন।’
নোংরা পায়জামা ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি কাঁচা বাজারে ঢুকলেন। সবজির বাজারে ঢুকে অবশ্য তিনি মোটামুটি খুশি হলেন। সেরা ধনী থাকা অবস্থায় তার অনেক বছর কাঁচা বাজারে যাওয়া হয়নি। সবজি বিক্রেতাকে তাই একটু খুশি মনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, ফুলকপি কত?’
‘আশি টাকা!’
‘আমি জোড়া ফুলকপির দাম জিজ্ঞেস করিনি!’
‘চাচা, আমিও জোড়া কই নাই, একটা ফুলকপি ৮০ টাকা।’
‘কী বলো, ডাকাতি হচ্ছে নাকি! এতটুকু একটা ফুলকপির দাম ৮০ টাকা?’
সবজি বিক্রেতা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘চাচা শুক্রবারের বন্ধের দিন, এত প্যাচাল কইরেন না তো। নিলে নেন, না নিলে অন্য দোকান দেখেন। সব জায়গায় একই রেট।’
তিনি এবার হার মানলেন। চড়া দামে সব সবজি কিনলেন। সবশেষে বললেন, ‘বাবা, আমাকে দশ টাকার কাঁচা মরিচ দাও তো।’
‘দশ টাকার কাঁচা মরিচ নাই চাচা। বিশ টাকার আছে।’
‘কী বলো! আচ্ছা বিশ টাকারই দাও।’
সবজি বিক্রেতা গুনে গুনে বিশটা কাঁচা মরিচ দিলে সোলায়মান সাহেবের রাগ আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেল।
‘তুমি কি ফাইজলামি পেয়েছো নাকি? বিশ টাকায় এগুলো কী মরিচ দিলে?’
‘চাচা, কাঁচা মরিচের কেজি ৪০০ টাকা। হুদাই আমার ওপরে রাগ দেখাইলে লাভ আছে?’
এবার তিনি বলেই বসলেন, ‘আমাকে আরেকবার সেরা ধনী হতে দাও। তখন দেখবে আমি কী করি!’
এবার সবজি বিক্রেতা হেসে বলেন, ‘চাচা, আমি যদি একবার সেরা ধনী হতে পারি, তবে নিজেই একটা সুপার স্টোর দিমু। নাম দিমু আক্কাস সুপার স্টোর। আপনি আইসেন, আপনারে সবকিছু কম দামে দিমুনে। হে হে হে।’
বাজার থেকে ফেরার পথে রাস্তার ময়লা পানির ভয়ে নিজেই একটি রিকশা ঠিক করলেন। কিন্তু রিকশায় উঠে মনে হলো, তিনি তার জীবনের অন্যতম বড় ভুল করেছেন। যে রাস্তায় তিনি দশ মিনিটে হেঁটে চলে আসলেন, সে রাস্তায় উনি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে জ্যামে বসে আছেন। কী আজব ব্যাপার! গতকাল পর্যন্ত তিনি যে রাস্তা দিয়ে গেছেন, আজ পর্যন্ত কখনো কোনো জ্যাম পাননি। একবারে হাইস্পিডে গাড়ি চালিয়েছে তার ড্রাইভার। অসহায়ভাবে তার মুখ ফসকে আবারো বের হয়ে এলো, ‘আমি যদি আবার সেরা ধনী হই, দেখবো জ্যাম কেমনে থাকে!’
তার কথা শুনে রিকশাওয়ালা হেসে বলল, ‘স্যার, আমি সেরা ধনী হইলে একটা প্লেন কিনুম। যাত্রীরে প্লেন দিয়া উড়াইয়া নিয়া যামু। ট্রাফিকও নাই, যাত্রী গো চিল্লাপাল্লাও নাই।’

ঘণ্টাখানেক পর ঘামে কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরলেন সোলায়মান সাহেব। সোফায় গা এলাতেই জোহরা বানু এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে হাজির। তিনি ঠান্ডা পানির গ্লাসটি হাতে নিতে বললেন, ‘বাথরুমে আমার কাপড় দাও। গোসল করব।’
জোহরা বানু তখন বললেন, ‘পানি নেই! আমি তোমার জন্য কোনোমতে আধা বালতি পানি জমিয়ে রেখেছি। তা দিয়ে কষ্ট করে গোসলটা সেরে নাও।’
সোলায়মান সাহেব এবার প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এই গরমে একটা মানুষ শান্তিতে গোসলও করতে পারবে না? এইটুকু শান্তি কি তার জীবনে নেই?’
জোহরা বানু হতাশ মুখে বললেন, ‘গত চার মাস ধরেই তো এলাকায় পানির সংকট। এই কষ্ট করেই তো আমরা চলছি। কী আর করা! কোনোমতে কষ্টে গোসলটা সেরে নাও।’
সোলায়মান সাহেব মনে মনে বললেন, ‘কী দিন আসলো! সেরা ধনীকেও মাপা পানি দিয়ে গোসল করতে হয়!’
সন্ধ্যায় চা পান করে সোলায়মান সাহেব টিভির সামনে বসলেন একটু খবর দেখবেন বলে। কিন্তু জোহরা বানু টিভিতে একটি হিন্দি সিরিয়াল ছেড়ে বসে আছেন। যেখানে বউ-শাশুড়ির তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। ধুম-তানা টাইপ আওয়াজ হচ্ছে।
সোলায়মান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ‘একটু নিউজ চ্যানেল দাও, আজকের খবরটা দেখব।’
জোহরা বানু অবাক হয়ে বললেন, ‘খবর আজকাল কে দেখে! তা-ও আবার নিউজ চ্যানেলে।’
সোলায়মান সাহেবের জেদের মাথায় জোহরা বানু নিউজ চ্যানেল চালু করে টিভির সামনে থেকে উঠে গেলেন।
সংবাদ চালু হলো। বেশ প্রসন্ন মনে সোলায়মান সাহেব বসে রইলেন খবর জানার জন্য। সেরা ধনী থাকা অবস্থায় টিভি চ্যানেলটি একটুও দেখার সুযোগ হতো না। শুধু বার্ষিকীর উৎসবে কিছুক্ষণের জন্য বক্তৃতা দিয়ে চলে আসতেন। আজ যেহেতু দেখার সুযোগ হয়েছে, মন্দ কি! কিন্তু এ কী বলছেন জো বাইডেন! সব কিছু নাকি স্বাভাবিক আছে! সব কিছুই নাকি একদম হাতের নাগালে! কোথাও কোনো যুদ্ধ নেই।
সোলায়মান সাহেবের রাগে যেন গা জ্বলে যাচ্ছে। লোকটি এত গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও কীভাবে অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছেন!
সায়েম রুম থেকে বের হয়ে বাবার মুখের অবস্থা দেখে হেসে বলল, ‘কী বাবা! খবর দেখার সাধ মিটেছে? এর থেকে হিন্দি সিরিয়ালে বউ-শাশুড়ির ঝগড়া দেখলে ভালো হতো না?’
ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে তিনি টিভির সামনে থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সোলায়মান সাহেব ঘুমাতে গেলেন। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলেন, সারাদিন তার সঙ্গে কী হলো, কেন হলো! তিনি বিশ্বের সেরা ধনী হয়েও আজ কেন এভাবে দিন কাটালেন। তাহলে কি সেরা ধনী হওয়াটা তার স্বপ্ন ছিল?
এদিক-সেদিক ভাবতেই হঠাৎ চারদিক অন্ধকার করে তার মাথার ওপরের ফ্যানটি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, ‘সারাদিন বিদ্যুৎ ছিল না মানা যায়; কিন্তু এই গরমে সাধারণ মানুষ কি একটু শান্তির ঘুমও দিতে পারবে না? ঘুমানোর সময় কি বিদ্যুৎ যাওয়া খুব দরকার?’
জোহরা বানু একটি মোমবাতি নিয়ে রুমে ঢুকে বললেন, ‘আহা! তুমি এত রাগ করছ কেন? এ তো প্রতিদিনের রুটিন। এই নাও হাতপাখা।’
স্বামীর গোমড়া মুখ দেখে বললেন, ‘আচ্ছা! আমিই করছি’ বলে জোহরা বানু হাতপাখাটি নিয়ে ঘোরানো শুরু করলেন।’
সোলায়মান সাহেব অসহায় হয়ে শুয়ে রইলেন। কারণ জোহরা বানু যথেষ্ট জোরে হাতপাখা ঘোরাচ্ছেন কিন্তু সেই বাতাস তার গায়ে লাগছে না। তার পিঠ ঘামে ভিজে বিছানার চাদরের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। কী যে অসহ্য গরম! নিজের অসহায়ত্বের কথা ভাবতে ভাবতেই সোলায়মান সাহেব এক সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

স্বপ্ন

আপডেট সময় : ১০:৫৮:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ জুন ২০২৩

সাখাওয়াত হোসেন সজীব  : সকাল না হতেই সোলায়মান সাহেবের ঘুম ভাঙলো কানের কাছে জোরে জোরে ইট ভাঙার শব্দ আর সেই সঙ্গে সবজিওয়ালার ডাক শুনে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়! হোয়াইট প্যালেস ভবনের পাশে এসব আওয়াজ শোনা তো দূরের কথা, কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। তিনি চোখ বন্ধ রেখেই কলিং বেলটা টিপ দেওয়ার জন্য খুঁজতে লাগলেন। যেন তার সেক্রেটারি এসে হাজির হয়। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, তিনি খাটের পাশে কোনো কলিং বেল খুঁজে পেলেন না।
এমন সময় তার স্ত্রী জোহরা বানুর আওয়াজ শোনা গেল, ‘কই গো, শুনছো! শুক্রবারের সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল, বাজারে তো যেতে হবে। ফ্রিজ তো একদম খালি। তাড়াতাড়ি নাস্তাটা করে নাও!’
তিনি চোখ খুলে দেখলেন, জোহরা বানু হাতে খুন্তি নিয়ে তার খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘তোমার হাতে খুন্তি কেন, বাবুর্চিরা গেল কই?’
জোহরা বানু এক গাল হেসে বললেন, ‘স্যার, বিয়ের পয়ত্রিশ বছর ধরে আমিই আপনার বাড়ির বাবুর্চি। আমিই বিনা বেতনে কাজের বুয়া। এবার উঠে পড়ুন!’
সোলায়মান সাহেবের এখনো বিস্ময় কাটছে না। তিনি বিশ্বের সেরা ধনী; তার এত বড় হোয়াইট প্যালেস গেল কোথায়? তার এতগুলো চাকর-বাকর, বাবুর্চি সব আজ কোথায় গেল! ভাবতে ভাবতেই জোহরা বানু আবার রান্নাঘর থেকে অনুরোধ করলেন, ‘টেবিলে গরম গরম রুটি দিচ্ছি! খেয়ে তাড়াতাড়ি বাজারে যাও!’
তিনি বাথরুম ঢুকে কয়েকবার চোখে-মুখে পানির ঝাপ্টা দিলেন; স্বপ্ন দেখছে না তো? কই, স্বপ্ন হলে তো এতক্ষণে ভেঙে যেত!
তিনি মুখ মুছতে মুছতে টেবিলের কাছে আসতেই ছেলে সায়েম এসে বলল, ‘বাবা, আমাকে ত্রিশ টাকা দাও; আমার জুতাটা কালি করাতে হবে। কাল সকালে আরেকটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে।’
এবার সোলায়মান সাহেব খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই এখানে কী করিস? তুই না লন্ডনে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলি! দেশে কবে ফিরলি?’
এবার সায়েম হেসে তার মাকে বলে, ‘মা, বাবার মাথা খারাপ হলো নাকি?’
রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে জোহরা বানু জবাব দিলেন, ‘মাথা খারাপ কি না জানি না! তবে গত রাতে খুব ঝাল দিয়ে চটপটি খেয়েছিল। হয়তো তাতেই পেট খারাপ করেছে।’
জোহরা বানু এবার সোলায়মান সাহেবের প্লেটে গরম রুটি রাখতে রাখতে বললেন, ‘সায়েম এদিক সেদিক চাকরি খুঁজতে খুঁজতে একেবারে হয়রান হয়ে পড়ল। তুমি একটু তোমার অফিসের বসের সঙ্গে কথা বলে দেখো না, কোথাও ঢুকিয়ে দিতে পারো কি না?’
সোলায়মান সাহেব মাথা নিচু করে ভাবতে যাবেন, তার সঙ্গে কী হচ্ছে? ঠিক তখনই আবার জোহরা বানু তাড়া দিয়ে উঠলেন, ‘এই নাও বাজারের ব্যাগ! খাওয়া হয়ে গেলে এবার ওঠো। এই নাও কাগজ, কী কী লাগবে তা আমি লিখে দিয়েছি!’
‘ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো’। সোলায়মান সাহেবের মুখে এ কথা শুনতেই জোহরা বানু এবার চোখ-মুখ শক্ত করে বলেন, ‘দেখো, সকাল থেকে অনেক মজা হয়েছে, আর না! এবার যাও।’
সোলায়মান সাহেব নিজের এ পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না। গতকাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা ধনী। তার হুকুমের বাইরে সংসারে কিছুই হতো না। সেখানে আজকে তিনি একটি আধা ময়লা বাজারের ব্যাগ নিয়ে কাঁচা বাজারের উদ্দেশ্যে হাঁটছেন? কেউ তার সঙ্গে কোনো ফাজলামি করছে না তো? কিন্তু তার সঙ্গে দুষ্টুমি করার দুঃসাহস কার আছে?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রাস্তার পানিতে পা পড়ল। পেছনের লোক হেসে বলল, ‘ভাই, রাস্তা কাইটা রাখসে ম্যালা দিন ধইরা। এদিকে ময়লা পানি সয়লাব! লাফ দিয়া ইট দেইখা পার হন।’
নোংরা পায়জামা ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি কাঁচা বাজারে ঢুকলেন। সবজির বাজারে ঢুকে অবশ্য তিনি মোটামুটি খুশি হলেন। সেরা ধনী থাকা অবস্থায় তার অনেক বছর কাঁচা বাজারে যাওয়া হয়নি। সবজি বিক্রেতাকে তাই একটু খুশি মনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, ফুলকপি কত?’
‘আশি টাকা!’
‘আমি জোড়া ফুলকপির দাম জিজ্ঞেস করিনি!’
‘চাচা, আমিও জোড়া কই নাই, একটা ফুলকপি ৮০ টাকা।’
‘কী বলো, ডাকাতি হচ্ছে নাকি! এতটুকু একটা ফুলকপির দাম ৮০ টাকা?’
সবজি বিক্রেতা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘চাচা শুক্রবারের বন্ধের দিন, এত প্যাচাল কইরেন না তো। নিলে নেন, না নিলে অন্য দোকান দেখেন। সব জায়গায় একই রেট।’
তিনি এবার হার মানলেন। চড়া দামে সব সবজি কিনলেন। সবশেষে বললেন, ‘বাবা, আমাকে দশ টাকার কাঁচা মরিচ দাও তো।’
‘দশ টাকার কাঁচা মরিচ নাই চাচা। বিশ টাকার আছে।’
‘কী বলো! আচ্ছা বিশ টাকারই দাও।’
সবজি বিক্রেতা গুনে গুনে বিশটা কাঁচা মরিচ দিলে সোলায়মান সাহেবের রাগ আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেল।
‘তুমি কি ফাইজলামি পেয়েছো নাকি? বিশ টাকায় এগুলো কী মরিচ দিলে?’
‘চাচা, কাঁচা মরিচের কেজি ৪০০ টাকা। হুদাই আমার ওপরে রাগ দেখাইলে লাভ আছে?’
এবার তিনি বলেই বসলেন, ‘আমাকে আরেকবার সেরা ধনী হতে দাও। তখন দেখবে আমি কী করি!’
এবার সবজি বিক্রেতা হেসে বলেন, ‘চাচা, আমি যদি একবার সেরা ধনী হতে পারি, তবে নিজেই একটা সুপার স্টোর দিমু। নাম দিমু আক্কাস সুপার স্টোর। আপনি আইসেন, আপনারে সবকিছু কম দামে দিমুনে। হে হে হে।’
বাজার থেকে ফেরার পথে রাস্তার ময়লা পানির ভয়ে নিজেই একটি রিকশা ঠিক করলেন। কিন্তু রিকশায় উঠে মনে হলো, তিনি তার জীবনের অন্যতম বড় ভুল করেছেন। যে রাস্তায় তিনি দশ মিনিটে হেঁটে চলে আসলেন, সে রাস্তায় উনি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে জ্যামে বসে আছেন। কী আজব ব্যাপার! গতকাল পর্যন্ত তিনি যে রাস্তা দিয়ে গেছেন, আজ পর্যন্ত কখনো কোনো জ্যাম পাননি। একবারে হাইস্পিডে গাড়ি চালিয়েছে তার ড্রাইভার। অসহায়ভাবে তার মুখ ফসকে আবারো বের হয়ে এলো, ‘আমি যদি আবার সেরা ধনী হই, দেখবো জ্যাম কেমনে থাকে!’
তার কথা শুনে রিকশাওয়ালা হেসে বলল, ‘স্যার, আমি সেরা ধনী হইলে একটা প্লেন কিনুম। যাত্রীরে প্লেন দিয়া উড়াইয়া নিয়া যামু। ট্রাফিকও নাই, যাত্রী গো চিল্লাপাল্লাও নাই।’

ঘণ্টাখানেক পর ঘামে কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরলেন সোলায়মান সাহেব। সোফায় গা এলাতেই জোহরা বানু এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে হাজির। তিনি ঠান্ডা পানির গ্লাসটি হাতে নিতে বললেন, ‘বাথরুমে আমার কাপড় দাও। গোসল করব।’
জোহরা বানু তখন বললেন, ‘পানি নেই! আমি তোমার জন্য কোনোমতে আধা বালতি পানি জমিয়ে রেখেছি। তা দিয়ে কষ্ট করে গোসলটা সেরে নাও।’
সোলায়মান সাহেব এবার প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এই গরমে একটা মানুষ শান্তিতে গোসলও করতে পারবে না? এইটুকু শান্তি কি তার জীবনে নেই?’
জোহরা বানু হতাশ মুখে বললেন, ‘গত চার মাস ধরেই তো এলাকায় পানির সংকট। এই কষ্ট করেই তো আমরা চলছি। কী আর করা! কোনোমতে কষ্টে গোসলটা সেরে নাও।’
সোলায়মান সাহেব মনে মনে বললেন, ‘কী দিন আসলো! সেরা ধনীকেও মাপা পানি দিয়ে গোসল করতে হয়!’
সন্ধ্যায় চা পান করে সোলায়মান সাহেব টিভির সামনে বসলেন একটু খবর দেখবেন বলে। কিন্তু জোহরা বানু টিভিতে একটি হিন্দি সিরিয়াল ছেড়ে বসে আছেন। যেখানে বউ-শাশুড়ির তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। ধুম-তানা টাইপ আওয়াজ হচ্ছে।
সোলায়মান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, ‘একটু নিউজ চ্যানেল দাও, আজকের খবরটা দেখব।’
জোহরা বানু অবাক হয়ে বললেন, ‘খবর আজকাল কে দেখে! তা-ও আবার নিউজ চ্যানেলে।’
সোলায়মান সাহেবের জেদের মাথায় জোহরা বানু নিউজ চ্যানেল চালু করে টিভির সামনে থেকে উঠে গেলেন।
সংবাদ চালু হলো। বেশ প্রসন্ন মনে সোলায়মান সাহেব বসে রইলেন খবর জানার জন্য। সেরা ধনী থাকা অবস্থায় টিভি চ্যানেলটি একটুও দেখার সুযোগ হতো না। শুধু বার্ষিকীর উৎসবে কিছুক্ষণের জন্য বক্তৃতা দিয়ে চলে আসতেন। আজ যেহেতু দেখার সুযোগ হয়েছে, মন্দ কি! কিন্তু এ কী বলছেন জো বাইডেন! সব কিছু নাকি স্বাভাবিক আছে! সব কিছুই নাকি একদম হাতের নাগালে! কোথাও কোনো যুদ্ধ নেই।
সোলায়মান সাহেবের রাগে যেন গা জ্বলে যাচ্ছে। লোকটি এত গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও কীভাবে অনর্গল মিথ্যা বলে যাচ্ছেন!
সায়েম রুম থেকে বের হয়ে বাবার মুখের অবস্থা দেখে হেসে বলল, ‘কী বাবা! খবর দেখার সাধ মিটেছে? এর থেকে হিন্দি সিরিয়ালে বউ-শাশুড়ির ঝগড়া দেখলে ভালো হতো না?’
ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে তিনি টিভির সামনে থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সোলায়মান সাহেব ঘুমাতে গেলেন। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলেন, সারাদিন তার সঙ্গে কী হলো, কেন হলো! তিনি বিশ্বের সেরা ধনী হয়েও আজ কেন এভাবে দিন কাটালেন। তাহলে কি সেরা ধনী হওয়াটা তার স্বপ্ন ছিল?
এদিক-সেদিক ভাবতেই হঠাৎ চারদিক অন্ধকার করে তার মাথার ওপরের ফ্যানটি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, ‘সারাদিন বিদ্যুৎ ছিল না মানা যায়; কিন্তু এই গরমে সাধারণ মানুষ কি একটু শান্তির ঘুমও দিতে পারবে না? ঘুমানোর সময় কি বিদ্যুৎ যাওয়া খুব দরকার?’
জোহরা বানু একটি মোমবাতি নিয়ে রুমে ঢুকে বললেন, ‘আহা! তুমি এত রাগ করছ কেন? এ তো প্রতিদিনের রুটিন। এই নাও হাতপাখা।’
স্বামীর গোমড়া মুখ দেখে বললেন, ‘আচ্ছা! আমিই করছি’ বলে জোহরা বানু হাতপাখাটি নিয়ে ঘোরানো শুরু করলেন।’
সোলায়মান সাহেব অসহায় হয়ে শুয়ে রইলেন। কারণ জোহরা বানু যথেষ্ট জোরে হাতপাখা ঘোরাচ্ছেন কিন্তু সেই বাতাস তার গায়ে লাগছে না। তার পিঠ ঘামে ভিজে বিছানার চাদরের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। কী যে অসহ্য গরম! নিজের অসহায়ত্বের কথা ভাবতে ভাবতেই সোলায়মান সাহেব এক সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।