ক্যাম্পাস ও ক্যারিয়ার ডেস্ক : মাছে-ভাতে বাঙালি। প্রাচীনকাল থেকে মাছ আমাদের ঐতিহ্য। অন্যান্য প্রাণিজ আমিষের চেয়ে তুলনামূলক দামে সস্তা ও সহজ-প্রাপ্য। দেশের প্রাণিজ আমিষের ৬০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় এখান থেকে। দারিদ্র্য আর জনসংখ্যার আধিক্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল মাৎস্যবিজ্ঞান বা ফিশারিজই পারে মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্যের মতো প্রাণিজ আমিষের এই সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়টিকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে এবং বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে। এ নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেনÑ শামীম ফরহাদ
কেন ফিশারিজ?
জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে বার্ষিক চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ মৎস্যসম্পদ আহরণ ও উৎপাদন করা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই এ চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সম্পর্ক মেলাতে প্রয়োজন আরও গবেষণা, আরও গবেষক। আর কাক্সিক্ষত গবেষক তৈরি করতে পারে মাৎস্যবিজ্ঞান বা ফিশারিজ।
বাংলাদেশে মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে মৎস্য খাত থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতের ফ্যাক্টরিগুলোয় বর্তমানে মোট উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণ চিংড়ি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার কারণে। তাই চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতের ফ্যাক্টরিগুলোর উৎপাদনক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে মাৎস্যবিজ্ঞান ভূমিকা রাখতে সক্ষম। পৌনে চার লাখ হেক্টর আয়তনের পুকুর ও ৯ হাজার ৬০ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার দেড় কোটি মাছচাষির কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী অপার সম্ভাবনাময় খাতটি জিডিপিতে অবদান রাখছে প্রায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। জনসংখ্যার ১১ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতটি ৮৪ মিলিয়ন টন মাছ রপ্তানি করে প্রতিবছর আয় করছে ৪ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। গ্রামীণ জনপদের প্রতি পাঁচজনের চারজনই জলজ সম্পদের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। মৎস্যসম্পদ ও তত সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহারের পথ বাতলে দিতে সক্ষম ফিশারিজ। এ জন্যই মাছকে আরও সহজলভ্য ও সুলভ্য করার মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবেন মাৎস্যবিজ্ঞানীরা।
পড়াশোনা
মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে মৎস্য সেক্টরকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৭ প্রতিষ্ঠা লাভ করে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট কৃষি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাকৃবির অধীন জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ফিশারিজ কলেজসহ প্রায় ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান ও ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো
ভালো স্কোর নিয়ে বিএসসি ফিশারিজ কমপ্লিট করার পর একজন গ্র্যাজুয়েট দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নি¤œলিখিতভাবে যোগ দিতে পারেনÑ বৃত্তিসহ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সে (যেমন এমএস) অংশগ্রহণ, বৃত্তিসহ গবেষণামূলক এমফিল/পি-এইচডি কোর্সে অংশগ্রহণ, ফিশারিজ অনুষদে শিক্ষক হিসেবে যোগদান কিংবা রিসার্চ ফেলো বা গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান।
কাজের সুযোগ
নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সময়োপযোগী আর প্রয়োজনীয় গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মকা-ে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ মাৎস্যবিজ্ঞানে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবলের। এ ছাড়া মৎস্যসম্পদ আহরণ ও উৎপাদনক্ষেত্র, বিভিন্ন মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য উৎপাদন ও রপ্তানি প্রতিষ্ঠান, মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতে ব্যবহৃত নানাবিধ উপকরণ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানার বিস্তৃতির ফলে মৎস্য খাতে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের, যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটদের রয়েছে অফুরন্ত কাজের সুযোগ।
সরকারি সংস্থাগুলো
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা বা অফিসগুলোয় ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমনÑ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্যসম্পদ গবেষণাকেন্দ্র (বিএফআরআই) এবং এর শাখা ও উপকেন্দ্রগুলো, বাংলাদেশ মৎস্যসম্পদ উন্নয়নকেন্দ্র (বিএফডিসি) ও এর শাখা কেন্দ্রগুলো, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণাকেন্দ্র (বিএআরসি বা বার্ক), ফিশারিজ ও ফিশারিজসংশ্লিষ্ট একাডেমি ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে সহায়তাকারী বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা বা দপ্তরগুলোয় ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
বেসরকারি সংস্থাগুলো
দেশের বিভিন্ন এনজিও এর নানা ধরনের আত্মনির্ভরশীল উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের অন্যতম একটি হচ্ছে ফিশারিজ খাত। যেমনÑ বিভিন্ন মাছের একক ও মিশ্র চাষ, নার্সারি ব্যবস্থাপনা, বাঁওড়ে মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন ইত্যাদি। এসব খাতে ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটের কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও ফিশারিজবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, যেখানে ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আত্মকর্মসংস্থান
বিএসসি ফিশারিজ ডিগ্রি অর্জনের পর একজন ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েট নিজেই তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। অর্থ জোগানোর জন্য দেশের বিভিন্ন ব্যাংকগুলোয় ঋণের সুযোগও রয়েছে। প্রথমে স্বল্প পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর সে প্রচেষ্টাকে বৃহৎ পরিসরে বর্ধিত করে নিশ্চিতভাবেই অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটের পক্ষে সম্ভব। যেমনÑ হ্যাচারি ও রেণু উৎপাদন, পোনা ও টেবিল-সাইজ মৎস্য উৎপাদন, মুক্তা উৎপাদন, কঁাঁকড়া উৎপাদন, বাহারি মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন, মৎস্যখাদ্য উৎপাদন, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মৎস্যসংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম (যেমনÑ জাল) উৎপাদন, চাষকৃত পুকুর বা দিঘিতে মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতা আয়োজন, মৎস্য পর্যটন (ফিশারিজ হটস্পট যেমনÑ সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, হাকালুকি হাওর, চলনবিল, মেঘনার ইলিশ অভয়াশ্রম ইত্যাদি স্থানে ফিশারিজকে গুরুত্ব দিয়ে পরিদর্শনের আয়োজন। আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোর্স অনুযায়ী শিক্ষা সফরের আয়োজন), মৎস্য রোগপ্রবণ এলাকায় মৎস্য কিনিক স্থাপন, অনলাইন মৎস্য তথ্যকেন্দ্র পরিচালনা।
দেশের বাইরে
দেশের বাইরেও মৎস্যবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একজন ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েট যোগ দিতে পারেন। যেমনÑ ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষা (যেমনÑ এমএস, এমফিল, পিএইচডি, ডিএসসি ইত্যাদি) গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত গলফ ও আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোয় মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে মৎস্য পেশাজীবীর চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন দেশে মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি প্রতিষ্ঠানে যেমন কাজের সুযোগ রয়েছে, তেমনি ক্ষুদ্র পরিসরে এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
স্বনির্ভর পেশা ফিশারিজ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ