নিজস্ব প্রতিবেদক: মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের’ চেয়ারম্যান খায়রুল বাশারের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দুপুরের দিকে বাশারকে আদালতে হাজির করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁকে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করা হয়। শুনানি নিয়ে আদালত আদেশ দেন।
মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় গত সোমবার (১৪ জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে বাশারকে গ্রেফতার করে সিআইডি। গত ৪ মে গুলশান থানায় সিআইডি মামলাটি করে। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে বাশারের বিরুদ্ধে।
সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, সংস্থাটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খায়রুল বাশার তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশারকে সঙ্গে নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র গড়ে তোলেন। চক্রটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ, স্কলারশিপ এবং ভিসা প্রক্রিয়াকরণের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ভুয়া ভিসা প্রসেসিং, মনগড়া প্রতিনিধিত্ব ও চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা হতো। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের অনেকের নামে বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করা হয়নি। আবার অনেকে বিদেশে গিয়ে নানাভাবে প্রতারিত হয়েছেন।
সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী প্রতারিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন ভুক্তভোগী প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা করেছেন। সিআইডি জানায়, গ্রেফতার খায়রুল বাশার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতেন এবং সেখান থেকে অর্থ উত্তোলন করে স্থাবর সম্পদ ক্রয়, ব্যবসা পরিচালনা ও অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করেছেন।
বিদেশে পড়তে যেতে গিয়ে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের ফাঁদে: জাহিদুল হক খান ও রওনক জাহান দম্পতি পেশায় আইনজীবী। তাঁরা উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডায় যেতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তাঁরা বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আইনজীবী জাহিদুল বলেন, কানাডায় দুজনের শিক্ষার্থী ভিসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তাঁরা প্রতিষ্ঠানটিকে ১৭ লাখ করে মোট ৩৪ লাখ টাকা দেন; কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আর ভিসার ব্যবস্থা করে দেয়নি। ভিসা না পেয়ে তাঁরা টাকা ফেরত চান। তবে প্রতিষ্ঠানটি টাকা ফেরত দেয়নি। প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জাহিদুল-রওনক দম্পতিসহ মোট ১৮ ব্যক্তির পক্ষে গত ৫ মে রাজধানীর গুলশান থানায় বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হয়। আইনজীবী জাহিদুল বলেন, ‘আমার মতো অনেকে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের প্রতারণার শিকার। আমরা আমাদের কষ্টের টাকা ফেরত চাই।’
মামলাটি তদন্ত করছেন গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।’
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত সোমবার বাশারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আবুল কালাম আজাদ এক বার্তায় জানান, মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে বাশারকে গ্রেফতার করা হয়।
১৪১ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ১৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে গত ৪ মে গুলশান থানায় বাশারের বিরুদ্ধে মামলাটি করে সিআইডি। মামলার বাদী সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। মামলায় অভিযোগ, বাশার, তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশন ও ছেলে আরশ ইবনে বাশার চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ১৪১ শিক্ষার্থীকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তাঁরা ১৮ কোটি ২৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬৮০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
বিস্তর অভিযোগ: সিআইডি বলছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাশার তাঁর স্ত্রী রওশন ও ছেলে আরশকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রতারণা চক্র গড়ে তোলেন। চক্রটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ, স্কলারশিপ, ভিসা প্রক্রিয়াকরণের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী প্রতারিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ব্যক্তি প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা করেছেন। রাজধানীর গুলশান থানা এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে বাশারের বিরুদ্ধে অন্তত ১০০ ব্যক্তির মামলার তথ্য জানা গেছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এসব মামলা হয়। এসব মামলায় বাশারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বাশারের বিরুদ্ধে গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে একের পর এক মামলা হচ্ছে। অনেক মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তাঁর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে।
টাকা ফেরত চাই: শরীয়তপুরের আমির হোসেন ঢাকায় থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ককে ১৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। তাঁকে কানাডার ভিসার ব্যবস্থা করার কথা ছিল; কিন্তু ভিসার ব্যবস্থা করেনি প্রতিষ্ঠানটি। টাকাও ফেরত দেয়নি। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর আমির হোসেনসহ ২৩ জন বাশারের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আমির হোসেন বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল তিন মাসের মধ্যে ভিসা হবে, আমি কানাডায় উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে পারব; কিন্তু বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক আমার ভিসার ব্যবস্থা করতে পারেনি। আমি বিদেশেও যেতে পারিনি। আমি জমি বিক্রি করে ১৩ লাখ দিয়েছি। আমার মতো আরো অনেকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। আমরা আমাদের কষ্টের টাকা ফেরত চাই। প্রতারকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ জান্নাতুল ফেরদৌস নামের আরেক শিক্ষার্থী গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাশার ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। জান্নাতুলের অভিযোগ, শিক্ষার্থী ভিসায় তাঁকে কানাডায় পাঠানোর কথা বলে তাঁর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। উল্লিখিত মামলায় বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মহাব্যবস্থাপক আবু জাহিদ গ্রেফতার হন গত বছরের ১১ ডিসেম্বর। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আদালত থেকে জামিন পান। আবু জাহিদের আইনজীবী রুবায়েত হাসান বলেন, বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছে। অনেক শিক্ষার্থীকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর যাঁরা বিদেশে যেতে পারেননি, তাঁদের টাকা ফেরত দেবে তারা। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠানোর কথা বলে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আমার থানায় নয়টি মামলা আছে। এসব মামলায় তাঁকে গ্রেফতার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।’
আদালতে বিএসবির বাশারকে কিল-ঘুষি-লাথি, ডিম নিক্ষেপ: মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে গুলশান থানার মামলায় বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান খায়রুল বাশারের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিমান্ড শুনানিতে বাশারকে আদালতে আনা হলে তাকে কিল, ঘুষি, লাথি মেরেছেন ভুক্তভোগীরা। এসময় তার ওপর ডিমও নিক্ষেপ করেন তারা।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে। গুলশান থানার এ মামলায় খায়রুল বাশারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপ-পরিদর্শক খালিদ সাইফুল্লাহ। এদিন দুপুর ১টার দিকে খায়রুল বাশারকে আদালতে হাজির করা হয়। তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এর আগেই তার কাছ থেকে প্রতারিত শতাধিক শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবকরা আদালতে হাজির হন। তার বিচারের দাবিতে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। ভুক্তভোগীদের চাপে বাশারকে আদালতে তুলতে বেগ পেতে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। বাড়ানো হয় বাড়তি নিরাপত্তা।
দুপুর ৩টা ২০ মিনিটের দিকে তাকে হাজতখানা থেকে এজলাসে তোলার জন্য বের করা হয়। এসময় তার হাতে হাতকড়া, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট ছিল। সিএমএম আদালতের গেটে পৌঁছানো মাত্র তার ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হয়। পরে তাকে দ্রুত সিএমএম আদালতের তৃতীয় তলায় ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্যাহর আদালতে নেওয়া হয়। এসময় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ভুক্তভোগীরা তাকে কিল, ঘুষি, লাথি মারেন। আদালতের ঢোকার সময়ও তার ওপর হামলা চালানে হয়। অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী, ভুক্তভোগীদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আদালতের হস্তক্ষেপে কিছুটা নীরব হয় পরিবেশ। পরে রিমান্ডের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। বাদীপক্ষে অ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন খন্দকার ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করেন।