ঢাকা ০২:১৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

স্ট্রেস কমাতে সুস্থ বিনোদন কতটা জরুরি?

  • আপডেট সময় : ০৯:৩৮:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ মে ২০২১
  • ১৪৭ বার পড়া হয়েছে


ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ : সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তিন জন চিকিৎসকের নাচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। ‘করোনা অতিমারির এই থমথমে সময়ে কোথায় মুখ কালো করে অধোবদনে হাসপাতালে ডিউটি করবেন, না তারা নেচে বেড়াচ্ছেন!’—এই ধরনের কথা বলা জনাকয়েক কূপম-ূক নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে অভিনন্দনের জোয়ারেই ভাসছেন তারা। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার বিবেচনায় এই তিন চিকিৎসক প্রশংসারযোগ্য কাজই করেছেন।

করোনা অতিমারিতে একদিকে সংক্রমণের ভয়, জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, শিক্ষা বিপর্যস্ততা সবকিছুতেই বিপন্ন হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য। আর চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের মানসিক চাপ সবচেয়ে বেশি। একদিকে সরাসরি সংক্রমণের ঝুঁকিতে থেকে সেবা দেওয়া, প্রতিরক্ষা সামগ্রীর অপ্রতুলতা, সহকর্মীদের মৃত্যু, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি আর কখনও কখনও কর্তৃপক্ষের অবিমৃষ্যকারী ও বিরূপ আচরণ চিকিৎসাকর্মীদের মনোবলের ওপর ক্ষত তৈরি করে। কখনও চিকিৎসকের শত চেষ্টার পরেও অক্সিজেন বা আইসিইউ’র স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রীর অভাবে অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও চিকিৎসকের মনে ‘মর‌্যাল ইনজুরি’ করে। সবকিছু মিলে বিশ্বজুড়েই এই করোনাকালে চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা তীব্র মানসিক চাপ (স্ট্রেস), বার্ন আউট, ঘুমের সমস্যা, উদ্বিগ্নতা (এংজাইটি), বিষন্নতা (ডিপ্রেশন) ইত্যাদি মনোসামাজিক সমস্যায় ভুগছে।

কোভিডকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনলাইন জরিপে ১১১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে ৯৩% বাড়তি চাপ অনুভব করছেন, ৮৬%-এর মধ্যে উদ্বিগ্ন ভাব দেখা দিচ্ছে আর ৭৭% হতাশ হয়ে পড়ছেন। ৩৯% মনে করছেন তারা সমাজের অন্যদের কাছ থেকে যথেষ্ট মানসিক সাপোর্ট পাচ্ছেন না। আর ৭৬% ভয় পাচ্ছেন যে তাদের কারণে প্রিয়জনেরা সংক্রমিত হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কোভিড প্যানডেমিকের প্রভাব বিষয়ে ২৪টি আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে বিষন্নতার হার ৯%-৫০%, উদ্বিগ্নতার হার ১৪%-৪৪% এবং ঘুমের সমস্যা রয়েছে ৩৪%-এর মধ্যে। পুরুষদের তুলনায় নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছে, এছাড়া যাদের অন্য কোনও শারীরিক রোগ রয়েছে, যাদের পরিবারে ছোট শিশু রয়েছে তাদের মধ্যেও মানসিক সমস্যা বেশি পাওয়া গেছে। উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৫০%-এরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী এই করোনাকালে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশে খুব অল্প সংখ্যক (১১৪ জন) চিকিৎসকদের ওপর পরিচালিত একটি অনলাইন জরিপে দেখা গেছে ৩২%-এর মধ্যে অতি উদ্বিগ্নতা (এংজাইটি) আর ৩৪%-এর মধ্যে বিষন্নতা (ডিপ্রেশন)-এর লক্ষণ রয়েছে। মোদ্দা কথা এই করোনাকালে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানসিক চাপ (স্ট্রেস) ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।

এই চাপ বাড়লে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে মনের মধ্যে চাপ আর হতাশা নিয়ে চিকিৎসা সেবার গুণগত মান বজায় রাখা সম্ভব হবে না। যার প্রভাব পড়বে চিকিৎসা সেবায়, প্রভাব পড়বে সামগ্রিক করোনা অতিমারি নিয়ন্ত্রণে। একজন চিকিৎসক যদি দুশ্চিন্তার কারণে রাতে ঠিকমত ঘুমাতে না পারেন পরদিন সকালে তিনি রোগীর সেবায় শতভাগ মনোনিবেশ করতে পারবেন না, তার দক্ষতায় ঘাটতি হবে। মনে কষ্ট নিয়ে, ক্ষুব্ধতা নিয়ে আর হতাশা নিয়ে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে উত্তরণের পথ কী। ফুঁ দিয়ে তো আর করোনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। করোনা তো আর আন্ত-উপজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট না যে বেলুন উড়িয়ে ফলাফল ঘোষণা করে বিদায় করে দেবো। এমনকি করোনা কোনও উন্নয়ন প্রকল্পও না যে নোটাংশ লিখে গোটাকতক কাগজের পতাকা চিহ্নিত পৃষ্ঠায় অনুমোদন দিলেই ফাইল ক্লোজ হয়ে যাবে। করোনা একটি বিজ্ঞান, করোনা একটি স্বাস্থ্য-সমস্যা। তাই কেবল বিজ্ঞান দিয়েই এর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে। কোনও দৈববশে করোনা যাবে না। যেহেতু বিজ্ঞান বলছে অনেক ভ্যারিয়েন্টের ওপর কাজ করতে পারে এমন টিকা আবিষ্কার করতে হবে, বিজ্ঞান বলছে আগামী কয়েক বছর কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে তাই এই সময়ে ভরসা রাখতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর। সেই ভরসার জায়গাটিকে যদি আমরা বিপন্ন করে তুলি, তাদের মনোবল নষ্ট করে দেই, তাহলে সমূহ বিপদ। তাই সকলের স্বার্থেই স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। তাদের স্ট্রেস আর বার্নআউট যাতে না হয় সেজন্য সচেষ্ট হতে হবে। এসবের জন্য যদিও সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে উপযুক্ত ‘কর্তৃপক্ষ’ আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কিন্তু দিনশেষে স্বাস্থ্যকর্মীরা একদম একা। ‘কর্তৃপক্ষ’ ত্রাতার ভূমিকায় না এসে সর্বদা চোখ রাঙানিতে ব্যস্ত আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ উদ্যত অবিরাম সমালোচনায়। তাই স্বাস্থ্যকর্মীদের ভালো থাকতে হবে নিজেদেরই। নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নিজেদেরই নিতে হবে।

স্ট্রেস কমিয়ে মানসিকভাবে চাঙা থাকতে স্বাস্থ্যকর্মীদের যা যা করা উচিত:

ক্স একটি রুটিন মেনে চলুন । কর্মস্থলে এবং বিশ্রামের জায়গাতেও।

ক্স নিজের নিরাপত্তা বিধিগুলো বারবার অভ্যাস করুন। যেমন- ডনিং, ডফিং । এতে আপনার কনফিডেন্ট বাড়বে

ক্স কাজের সময় ছাড়া অন্য সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাবেন। রাতে জেগে থেকে দিনে ঘুমাবেন না। সারা রাত ইন্টারনেটে সময় কাটাবেন না।

ক্স নিয়ম মেনে বিশ্রাম গ্রহণ করবেন। ডিউটি না থাকলে বাড়তি কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। কখনও অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হলে অতিরিক্ত বিশ্রাম নিবেন।

ক্স ফোন/ ইন্টারনেটের সাহায্যে পরিবারের সদস্য, বন্ধু প্রিয়জনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। কর্মক্ষেত্রেও সহকর্মীদের খোঁজ-খবর নেবেন।

ক্স একঘেয়ে কাজের বাইরে আপনার যদি কোনও শখ থাকে তবে বিশ্রামে থাকাকালে তার চর্চা করতে পারেন। সুস্থ বিনোদনের চর্চা করতে পারেন। গান গাইতে পারেন, ছবি আঁকতে পারেন। চাইলে নেচে নিতে পারেন এক চক্কর।

ক্স একটানা কাজ করবেন না। প্রতি ৫০ মিনিট পরপর ৫ মিনিট বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করবেন। স্ব-স্ব ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করতে পারেন। কয়েক ঘণ্টা পরপর হালকা ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি বা সংগীতের তালে সামান্য নেচে নিতে পারেন।

ক্স আপনার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা লিখে রাখতে পারেন। শিষ্টাচার মেনে আপনার অবসরের সময়গুলো ভিডিও করে অন্যদের জানাতে পারেন। এতে তারাও উৎসাহিত হবে।

ক্স অবসরে পরিবার আর বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ছাড়াও কিছুটা সময় নিজেকে নিয়ে ভাববেন (গব ঞরসব)।

ক্স প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে নিজের সারাদিনের অর্জনগুলো একবার করে স্মরণ করে আপনি যে একটি মহৎ কাজে নিয়োজিত এজন্য নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দেবেন।

ক্স প্রয়োজনে রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ, ইয়োগা (যোগব্যায়াম), মাইন্ডফুলনেস, মেডিটেশন, ব্রিদিং এক্সারসাইজ-এর চর্চা করতে পারেন। সমস্যা গুরুতর হলে সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।

মনের চাপ কমাতে সুস্থ বিনোদন খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শুরুতেই ঢাকা মেডিক্যালের নাচের ভিডিওটি নিয়ে বলছিলাম। মানসিক স্বাস্থ্যে নাচের মাধ্যমে মনের যতœ নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘ডান্স থেরাপি’ বলা হয়। কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারত, চীনে এই করোনাকালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নেচে গেয়ে নিজেদের স্ট্রেস কমাচ্ছেন। নিজেরা ভালো থাকার চেষ্টা করছেন আর এর মধ্য দিয়ে তারা আসলে সকলকেই ভালো রাখতে চাচ্ছেন। কারণ মানসিকভাবে সুস্থ স্বাস্থ্যকর্মীই কিন্তু মানসম্মত সেবা দিতে পারবেন।

মানসিক চাপ কমাতে নাচ বা সংগীত যে কার্যকর ভূমিকা রাখে এ নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। সম্প্রতি করোনা অতিমারির সময়ে কোভিড আক্রান্ত মৃদু ও মাঝারি লক্ষণযুক্ত ২১৫ জন রোগীর ওপর ভারতের তামিল নাড়ুতে একটি গবেষণা হয়। সেই গবেষণায় দেখা গেছে রোগীরা নিজেরা সংগীতচর্চা করে আর নেচে তাদের স্ট্রেস অনেকাংশেই কমাতে সক্ষম হয়েছে এবং যা তাদের কোভিড থেকে সেরে উঠতেও সাহায্য করেছে। এই গবেষণাটিতে দেখা গেছে ২৩% রোগীর স্ট্রেস কমেছে টিভি দেখে বা গান শুনে আর ৪০% রোগীর স্ট্রেস কমেছে যখন তারা নিজেরা গান গেয়েছে বা নেচেছে তখন! ৪৪% মনে করেছে নাচের পরে তাদের ফিটনেস আরও বেড়েছে। ৩৭% মনে করে নাচ আর গান করা তাদের আবেগকে অনেক সুসংহত করেছে, স্ট্রেস বিষন্নতা আর ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কমিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে নাচ, গান, বই পড়া, বাগান করা, ছবি আঁকার মতো সুস্থ বিনোদন যে মানসিক চাপ কমাতে পারে, তা বহু গবেষণাতেই প্রমাণিত।

তাই স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদের মনের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে হলে অপরের কৃপা প্রত্যাশা না করে নিজের যতœ নিজেকেই নিতে হবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যে যেভাবে পারেন সেভাবে একটুখানি সুস্থ বিনোদনের চর্চা করে নিন। নিজেকে ভালোবাসুন, মনের যতœ নিন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিডঁফঁ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

স্ট্রেস কমাতে সুস্থ বিনোদন কতটা জরুরি?

আপডেট সময় : ০৯:৩৮:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ মে ২০২১


ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ : সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তিন জন চিকিৎসকের নাচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। ‘করোনা অতিমারির এই থমথমে সময়ে কোথায় মুখ কালো করে অধোবদনে হাসপাতালে ডিউটি করবেন, না তারা নেচে বেড়াচ্ছেন!’—এই ধরনের কথা বলা জনাকয়েক কূপম-ূক নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে অভিনন্দনের জোয়ারেই ভাসছেন তারা। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার বিবেচনায় এই তিন চিকিৎসক প্রশংসারযোগ্য কাজই করেছেন।

করোনা অতিমারিতে একদিকে সংক্রমণের ভয়, জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, শিক্ষা বিপর্যস্ততা সবকিছুতেই বিপন্ন হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য। আর চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের মানসিক চাপ সবচেয়ে বেশি। একদিকে সরাসরি সংক্রমণের ঝুঁকিতে থেকে সেবা দেওয়া, প্রতিরক্ষা সামগ্রীর অপ্রতুলতা, সহকর্মীদের মৃত্যু, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি আর কখনও কখনও কর্তৃপক্ষের অবিমৃষ্যকারী ও বিরূপ আচরণ চিকিৎসাকর্মীদের মনোবলের ওপর ক্ষত তৈরি করে। কখনও চিকিৎসকের শত চেষ্টার পরেও অক্সিজেন বা আইসিইউ’র স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রীর অভাবে অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও চিকিৎসকের মনে ‘মর‌্যাল ইনজুরি’ করে। সবকিছু মিলে বিশ্বজুড়েই এই করোনাকালে চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা তীব্র মানসিক চাপ (স্ট্রেস), বার্ন আউট, ঘুমের সমস্যা, উদ্বিগ্নতা (এংজাইটি), বিষন্নতা (ডিপ্রেশন) ইত্যাদি মনোসামাজিক সমস্যায় ভুগছে।

কোভিডকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনলাইন জরিপে ১১১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে ৯৩% বাড়তি চাপ অনুভব করছেন, ৮৬%-এর মধ্যে উদ্বিগ্ন ভাব দেখা দিচ্ছে আর ৭৭% হতাশ হয়ে পড়ছেন। ৩৯% মনে করছেন তারা সমাজের অন্যদের কাছ থেকে যথেষ্ট মানসিক সাপোর্ট পাচ্ছেন না। আর ৭৬% ভয় পাচ্ছেন যে তাদের কারণে প্রিয়জনেরা সংক্রমিত হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কোভিড প্যানডেমিকের প্রভাব বিষয়ে ২৪টি আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে বিষন্নতার হার ৯%-৫০%, উদ্বিগ্নতার হার ১৪%-৪৪% এবং ঘুমের সমস্যা রয়েছে ৩৪%-এর মধ্যে। পুরুষদের তুলনায় নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছে, এছাড়া যাদের অন্য কোনও শারীরিক রোগ রয়েছে, যাদের পরিবারে ছোট শিশু রয়েছে তাদের মধ্যেও মানসিক সমস্যা বেশি পাওয়া গেছে। উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৫০%-এরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী এই করোনাকালে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশে খুব অল্প সংখ্যক (১১৪ জন) চিকিৎসকদের ওপর পরিচালিত একটি অনলাইন জরিপে দেখা গেছে ৩২%-এর মধ্যে অতি উদ্বিগ্নতা (এংজাইটি) আর ৩৪%-এর মধ্যে বিষন্নতা (ডিপ্রেশন)-এর লক্ষণ রয়েছে। মোদ্দা কথা এই করোনাকালে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানসিক চাপ (স্ট্রেস) ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।

এই চাপ বাড়লে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে মনের মধ্যে চাপ আর হতাশা নিয়ে চিকিৎসা সেবার গুণগত মান বজায় রাখা সম্ভব হবে না। যার প্রভাব পড়বে চিকিৎসা সেবায়, প্রভাব পড়বে সামগ্রিক করোনা অতিমারি নিয়ন্ত্রণে। একজন চিকিৎসক যদি দুশ্চিন্তার কারণে রাতে ঠিকমত ঘুমাতে না পারেন পরদিন সকালে তিনি রোগীর সেবায় শতভাগ মনোনিবেশ করতে পারবেন না, তার দক্ষতায় ঘাটতি হবে। মনে কষ্ট নিয়ে, ক্ষুব্ধতা নিয়ে আর হতাশা নিয়ে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে উত্তরণের পথ কী। ফুঁ দিয়ে তো আর করোনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। করোনা তো আর আন্ত-উপজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট না যে বেলুন উড়িয়ে ফলাফল ঘোষণা করে বিদায় করে দেবো। এমনকি করোনা কোনও উন্নয়ন প্রকল্পও না যে নোটাংশ লিখে গোটাকতক কাগজের পতাকা চিহ্নিত পৃষ্ঠায় অনুমোদন দিলেই ফাইল ক্লোজ হয়ে যাবে। করোনা একটি বিজ্ঞান, করোনা একটি স্বাস্থ্য-সমস্যা। তাই কেবল বিজ্ঞান দিয়েই এর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে। কোনও দৈববশে করোনা যাবে না। যেহেতু বিজ্ঞান বলছে অনেক ভ্যারিয়েন্টের ওপর কাজ করতে পারে এমন টিকা আবিষ্কার করতে হবে, বিজ্ঞান বলছে আগামী কয়েক বছর কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে তাই এই সময়ে ভরসা রাখতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর। সেই ভরসার জায়গাটিকে যদি আমরা বিপন্ন করে তুলি, তাদের মনোবল নষ্ট করে দেই, তাহলে সমূহ বিপদ। তাই সকলের স্বার্থেই স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। তাদের স্ট্রেস আর বার্নআউট যাতে না হয় সেজন্য সচেষ্ট হতে হবে। এসবের জন্য যদিও সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে উপযুক্ত ‘কর্তৃপক্ষ’ আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কিন্তু দিনশেষে স্বাস্থ্যকর্মীরা একদম একা। ‘কর্তৃপক্ষ’ ত্রাতার ভূমিকায় না এসে সর্বদা চোখ রাঙানিতে ব্যস্ত আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ উদ্যত অবিরাম সমালোচনায়। তাই স্বাস্থ্যকর্মীদের ভালো থাকতে হবে নিজেদেরই। নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নিজেদেরই নিতে হবে।

স্ট্রেস কমিয়ে মানসিকভাবে চাঙা থাকতে স্বাস্থ্যকর্মীদের যা যা করা উচিত:

ক্স একটি রুটিন মেনে চলুন । কর্মস্থলে এবং বিশ্রামের জায়গাতেও।

ক্স নিজের নিরাপত্তা বিধিগুলো বারবার অভ্যাস করুন। যেমন- ডনিং, ডফিং । এতে আপনার কনফিডেন্ট বাড়বে

ক্স কাজের সময় ছাড়া অন্য সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাবেন। রাতে জেগে থেকে দিনে ঘুমাবেন না। সারা রাত ইন্টারনেটে সময় কাটাবেন না।

ক্স নিয়ম মেনে বিশ্রাম গ্রহণ করবেন। ডিউটি না থাকলে বাড়তি কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। কখনও অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হলে অতিরিক্ত বিশ্রাম নিবেন।

ক্স ফোন/ ইন্টারনেটের সাহায্যে পরিবারের সদস্য, বন্ধু প্রিয়জনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। কর্মক্ষেত্রেও সহকর্মীদের খোঁজ-খবর নেবেন।

ক্স একঘেয়ে কাজের বাইরে আপনার যদি কোনও শখ থাকে তবে বিশ্রামে থাকাকালে তার চর্চা করতে পারেন। সুস্থ বিনোদনের চর্চা করতে পারেন। গান গাইতে পারেন, ছবি আঁকতে পারেন। চাইলে নেচে নিতে পারেন এক চক্কর।

ক্স একটানা কাজ করবেন না। প্রতি ৫০ মিনিট পরপর ৫ মিনিট বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করবেন। স্ব-স্ব ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করতে পারেন। কয়েক ঘণ্টা পরপর হালকা ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি বা সংগীতের তালে সামান্য নেচে নিতে পারেন।

ক্স আপনার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা লিখে রাখতে পারেন। শিষ্টাচার মেনে আপনার অবসরের সময়গুলো ভিডিও করে অন্যদের জানাতে পারেন। এতে তারাও উৎসাহিত হবে।

ক্স অবসরে পরিবার আর বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ছাড়াও কিছুটা সময় নিজেকে নিয়ে ভাববেন (গব ঞরসব)।

ক্স প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে নিজের সারাদিনের অর্জনগুলো একবার করে স্মরণ করে আপনি যে একটি মহৎ কাজে নিয়োজিত এজন্য নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দেবেন।

ক্স প্রয়োজনে রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ, ইয়োগা (যোগব্যায়াম), মাইন্ডফুলনেস, মেডিটেশন, ব্রিদিং এক্সারসাইজ-এর চর্চা করতে পারেন। সমস্যা গুরুতর হলে সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।

মনের চাপ কমাতে সুস্থ বিনোদন খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শুরুতেই ঢাকা মেডিক্যালের নাচের ভিডিওটি নিয়ে বলছিলাম। মানসিক স্বাস্থ্যে নাচের মাধ্যমে মনের যতœ নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘ডান্স থেরাপি’ বলা হয়। কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারত, চীনে এই করোনাকালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নেচে গেয়ে নিজেদের স্ট্রেস কমাচ্ছেন। নিজেরা ভালো থাকার চেষ্টা করছেন আর এর মধ্য দিয়ে তারা আসলে সকলকেই ভালো রাখতে চাচ্ছেন। কারণ মানসিকভাবে সুস্থ স্বাস্থ্যকর্মীই কিন্তু মানসম্মত সেবা দিতে পারবেন।

মানসিক চাপ কমাতে নাচ বা সংগীত যে কার্যকর ভূমিকা রাখে এ নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। সম্প্রতি করোনা অতিমারির সময়ে কোভিড আক্রান্ত মৃদু ও মাঝারি লক্ষণযুক্ত ২১৫ জন রোগীর ওপর ভারতের তামিল নাড়ুতে একটি গবেষণা হয়। সেই গবেষণায় দেখা গেছে রোগীরা নিজেরা সংগীতচর্চা করে আর নেচে তাদের স্ট্রেস অনেকাংশেই কমাতে সক্ষম হয়েছে এবং যা তাদের কোভিড থেকে সেরে উঠতেও সাহায্য করেছে। এই গবেষণাটিতে দেখা গেছে ২৩% রোগীর স্ট্রেস কমেছে টিভি দেখে বা গান শুনে আর ৪০% রোগীর স্ট্রেস কমেছে যখন তারা নিজেরা গান গেয়েছে বা নেচেছে তখন! ৪৪% মনে করেছে নাচের পরে তাদের ফিটনেস আরও বেড়েছে। ৩৭% মনে করে নাচ আর গান করা তাদের আবেগকে অনেক সুসংহত করেছে, স্ট্রেস বিষন্নতা আর ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কমিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে নাচ, গান, বই পড়া, বাগান করা, ছবি আঁকার মতো সুস্থ বিনোদন যে মানসিক চাপ কমাতে পারে, তা বহু গবেষণাতেই প্রমাণিত।

তাই স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদের মনের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে হলে অপরের কৃপা প্রত্যাশা না করে নিজের যতœ নিজেকেই নিতে হবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যে যেভাবে পারেন সেভাবে একটুখানি সুস্থ বিনোদনের চর্চা করে নিন। নিজেকে ভালোবাসুন, মনের যতœ নিন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিডঁফঁ