মীর হাসিব মাহমুদ

একটি স্টার্টআপ শুরু করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। বাজারে নতুন ধারণা নিয়ে আসা, সঠিকভাবে পরিচালনা করা, এবং সেই ধারণাকে সফলভাবে বাস্তবে রূপান্তরিত করা প্রতিটি স্টার্টআপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবুও অনেক স্টার্টআপ শুধুমাত্র আইডিয়ার ভিত্তিতে টিকে থাকতে পারে না। এর পেছনের কারণ কী? অভিজ্ঞ টিম মেম্বারদের অভাব। সিবি ইনসাইটসের গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৪ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয় সঠিক টিমের অভাবে।
অন্যদিকে একটি শক্তিশালী এবং অভিজ্ঞ টিম প্রায়শই স্টার্টআপের ভবিষ্যৎ সাফল্যের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্যই বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে বিনিয়োগের আগে টিমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।
এই আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করেছি কেন ইনভেস্টররা টিমের গুরুত্বকে সর্বাধিক বিবেচনায় রাখেন এবং কীভাবে একটি শক্তিশালী টিম একটি স্টার্টআপের সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শক্তিশালী টিম মানে স্থায়িত্ব ও দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা: সফল স্টার্টআপের জন্য একটি অভিজ্ঞ টিম অপরিহার্য। পণ্য বা সেবা শুরুতে যতই ভালো হোক না কেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া এটি সফলভাবে পরিচালনা করা বেশ কঠিন। ইউইং মারিয়ন কাউফম্যান ফাউন্ডেশন (ঊরিহম গধৎরড়হ কধঁভভসধহ ঋড়ঁহফধঃরড়হ)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, যে স্টার্টআপের টিমে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা থাকেন, সেসব স্টার্টআপের সফলতার হার ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। উদাহরণস্বরূপ, উবার (টনবৎ)-এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাভিস কালানিক (ঞৎধারং কধষধহরপশ)-এর দল প্রথম থেকেই যাত্রাপথের প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষ ছিল, যা তাদের দ্রুত বৃদ্ধি পেতে সহায়ক হয়েছিল।
নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনা: একটি স্টার্টআপের সাফল্যের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ নেতার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাককিনসে (গপকরহংবু)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি অভিজ্ঞ নেতৃত্ব থাকা টিমগুলোর স্টার্টআপে সফলতার সম্ভাবনা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, টেসলা (ঞবংষধ)-এর ইলন মাস্ক তার টিমের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য স্থির করে এবং টিমের সদস্যদের নিরলসভাবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে, কোম্পানিটি গাড়ি শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়।
বৈচিত্র্যময় দক্ষতার সমন্বয়: স্টার্টআপ জিনোমের গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈচিত্র্যময় দক্ষতাসম্পন্ন টিমের স্টার্টআপগুলোয় সফলতার হার প্রায় ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। একটি স্টার্টআপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা সম্পন্ন টিম মেম্বার থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনÑ একজন আর্থিক বিশেষজ্ঞ, একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং একজন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম স্টার্টআপকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শক্তিশালী করে তোলে। স্টাইপের প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিক কলিসন এবং তার ভাই জন কলিসন এই বৈচিত্র্যময় দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে তাদের টিম গঠন করেছিলেন, যা তাদের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ।
সংকট মোকাবিলার ক্ষমতা: স্টার্টআপের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কয়েক বছরে বিভিন্ন সংকট তৈরি হতে পারে এবং এসব সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে টিমের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফার্স্ট রাউন্ড ক্যাপিটালের গবেষণায় দেখা যায় যে, সফল স্টার্টআপগুলোর প্রায় ৬৫ শতাংশ অভিজ্ঞ টিমের কারণে সংকটকালীন সময় পার করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণস্বরূপÑ এয়ারবিএনবির প্রতিষ্ঠাতা এবং তার টিম প্রাথমিক সংকটে পড়লেও তাদের অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় সংকল্পের কারণে তারা অল্প সময়ে মার্কেটে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।
অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ: টিমের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অপরিহার্য। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে স্টার্টআপগুলোর টিমে সুষ্ঠু যোগাযোগ বিদ্যমান থাকে, তাদের মধ্যে সফলতার সম্ভাবনা প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপÑ জুমের টিম তাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগকে সুনির্দিষ্ট করে বাজারে নিজেদের একটি বিশেষ স্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
টিমের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ: একটি সফল স্টার্টআপের অন্যতম গুণ হলো উদ্ভাবনী শক্তি। সিবি ইনসাইটসের গবেষণায় জানা যায়, সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী টিম মেম্বারদের উপস্থিতিতে স্টার্টআপগুলোর উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রায় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে, অ্যাপলের টিম তাদের ক্রিয়েটিভ এবং উদ্ভাবনী মনোভাবের জন্য পরিচিত; যা তাদের পণ্যকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তুলেছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন: পিচবুকের এক জরিপ অনুযায়ী ৮৫ শতাংশ বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে বিনিয়োগের আগে টিমের দক্ষতা যাচাই করেন। শক্তিশালী টিম তৈরি করতে সক্ষম স্টার্টআপগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীরা সহজেই আস্থা রাখেন। উদাহরণ হিসেবে, স্ট্রাইপ (ঝঃৎরঢ়ব)-এর প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিক কলিসন তার টিমের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা বিনিয়োগকারীদের সামনে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার ফলে তারা বড় ধরনের অর্থায়ন পায়।
পণ্যের স্থায়িত্ব, টিমের দক্ষতায় স্থায়ী উন্নতি: একটি স্টার্টআপের পণ্য বা সেবা কেবল একটি ভালো আইডিয়া নয় বরং এর সঠিক বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে দক্ষ টিম প্রায়শই পণ্য বা সেবা স্থায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ম্যাককিনসের গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষ টিমের কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ স্টার্টআপ পণ্য বা সেবা স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে সফল হয়। উদাহরণস্বরূপ, অ্যামাজন (অসধুড়হ)-এর টিম তাদের পণ্যের স্থায়িত্বে সফল হয়েছে কারণ তারা প্রতিটি পদক্ষেপে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে।
টিমের ভিশন এবং মিশন: সফল স্টার্টআপে টিমের ভিশন এবং মিশন স্পষ্ট থাকে। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্টার্টআপগুলোর সফলতার জন্য টিমের ভিশন স্পষ্ট থাকা জরুরি। উদাহরণস্বরূপÑ টেসলার টিম তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য স্থাপন করেছিল এবং প্রতিটি পদক্ষেপে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে।
টিম বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে সাপোর্টিভ কালচার গঠন: স্টার্টআপের সাফল্যের জন্য টিম বিল্ডিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। ইউইং মারিয়ন কাউফম্যান ফাউন্ডেশনের মতে, সাপোর্টিভ কালচার গঠন স্টার্টআপের অগ্রগতির জন্য বিশেষ সহায়ক হয়। উদাহরণ হিসেবে, গুগলের টিম নিজেদের মধ্যে সাপোর্টিভ কালচার তৈরি করেছিল। ফলে তারা তাদের ইনোভেশনে ক্রমাগত উন্নতি করতে পেরেছিল।
আস্থা তৈরি ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক: বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তুলতে টিমের দক্ষতা প্রয়োজন। স্টার্স্টআপ ডটকমের মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা স্টার্টআপের সফলতার অন্যতম কারণ। উদাহরণস্বরূপ- হোয়াসটসঅ্যাপের টিম তাদের ব্যবহারকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি করেছিল; যা পরবর্তীতে তাদের সাফল্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল জনপ্রিয় হতে।
অন্যদিকে একটি স্টার্টআপে টিম কেবল একটি সংকলন নয়। এটি সেই প্রতিষ্ঠানটির হৃদয়; যা পুরো কাঠামোকে সংহত করে রাখে। স্টার্টআপের প্রতিটি স্তরে টিমের সদস্যদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। সফল স্টার্টআপগুলোর বিশ্লেষণে প্রায়ই দেখা যায় যে, তাদের প্রতিটি সদস্যের বিশেষ যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকে; যা তাদের একসঙ্গে মিলিত হওয়াকে অমূল্য করে তোলে।
আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলোর আলোকে দেখতে পাওয়া যায় যে, একটি ভালো টিম ছাড়া শুধু পণ্য বা সেবার ওপর নির্ভর করে একটি স্টার্টআপ সফল হতে পারে না। সিবি ইনসাইটসের মতে, সঠিক টিমের অভাবেই প্রায় ১৪ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়। এর মানে হলো, শুধু নতুন ধারণা বা বাজারে প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে নয়; বরং একটি দক্ষ টিমের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। যেমন- উবার, হোয়াটসঅ্যাপ, স্ট্রাইপের মতো বড় বড় সফল প্রতিষ্ঠানগুলোয় দেখা যায়,তাদের পেছনে শক্তিশালী ও বহুমুখী দক্ষতাসম্পন্ন একটি টিম ছিল- যারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছেন।
বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রেও এই টিমের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৮৫ শতাংশ বিনিয়োগকারী একটি স্টার্টআপে বিনিয়োগ করার আগে এর টিমের দক্ষতা, সামর্থ্য এবং অভিজ্ঞতা যাচাই করেন। কারণ বিনিয়োগকারীরা জানেন যে, একটি শক্তিশালী টিম না থাকলে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। একটি সফল টিমের মিশন এবং ভিশনের পরিষ্কার ধারণা থাকে যা তাদের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে।
টিম মেম্বারদের মধ্যে সম্পর্ক এবং সাপোর্টিভ কালচারও স্টার্টআপের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। গুগল এবং টেসলার মতো সফল কোম্পানিগুলোতে টিম সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় এবং সহযোগিতা ছিল অত্যন্ত দৃঢ়, যা তাদের আরও উদ্ভাবনী এবং প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে।
পরিশেষে বলা যায়, স্টার্টআপের টিমই প্রতিষ্ঠানটির মূল চালিকা শক্তি। সঠিক নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ সমন্বয়, দক্ষ টিম মেম্বার এবং সঠিক দিকনির্দেশনা-এগুলো স্টার্টআপের স্থায়িত্ব ও সাফল্যের অন্যতম কারণ। স্টার্টআপে বিনিয়োগকারীরা যখন একটি টিমের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা যাচাই করেন, তখন তারা মূলত একটি শক্তিশালী ভিত্তির সন্ধান করছেন, যেটি প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে এবং বেড়ে উঠতে সহায়ক হবে। তাই যেকোনো স্টার্টআপের জন্য টিম বিল্ডিং ও টিম ম্যানেজমেন্টকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে এবং প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে।
লেখক: স্টার্টআপ পরামর্শক

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ